খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের কথা। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যে বাস করতেন মার্কাস ভিট্রুভিয়াস পোলিও নামক এক স্থপতি। অবশ্য লোকমুখে তিনি শুধু ভিট্রুভিয়াস নামেই পরিচিত ছিলেন। স্থপতি ছাড়াও তিনি একাধারে ছিলেন একজন লেখক, বাস্তু প্রযুক্তিবিদ ও সমরযন্ত্রশিল্পী। ‘দে আর্কিতেকচুরা’ নামক স্থাপত্য বিষয়ক দশ খণ্ডের একটি বই লিখেছিলেন তিনি, যার প্রতিটি খণ্ডে সন্নিবেশন ঘটিয়েছিলেন স্থাপত্য, নগর পরিকল্পনা, যন্ত্রকলা প্রভৃতি বিষয়ের।
বইটির ব্যাপকতা বিশাল। সেই রোমান যুগ থেকে শুরু করে ইউরোপের রেনেসাঁ যুগ পর্যন্ত তো বটেই, এমনকি বর্তমান সময়ের আধুনিক স্থাপত্য শিল্পেও এর যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। তবে আপাতত আমরা আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব কেবল বইটির তৃতীয় খণ্ডে। এই খণ্ডটির মূল আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিল মন্দির নির্মাণ শিল্প। কিন্তু সেই মন্দির নির্মাণ নিয়ে আলোচনারই এক পর্যায়ে ভিট্রুভিয়াস সূত্রপাত ঘটিয়ে বসেন মানবদেহ বিষয়ক এক অসাধারণ ধারণার।
“মানবদেহকে প্রকৃতি এমনভাবে নকশা করেছে যে, এর মুখমণ্ডল অর্থাৎ থুতনি থেকে কপালের উপরিভাগ ও চুলের সর্বনিম্ন সীমা পর্যন্ত হলো পুরো উচ্চতার দশভাগের একভাগ; হাতের কব্জি থেকে মধ্যাঙ্গুলির ডগা পর্যন্তও একই; মাথা অর্থাৎ থুতনি থেকে মুকুট পর্যন্ত আট ভাগের এক ভাগ; আবার ঘাড় ও কাঁধ অর্থাৎ বুকের উপরিভাগ থেকে চুলের সর্বনিম্নাংশ পর্যন্ত হলো ছয় ভাগের এক ভাগ; বুকের মাঝখান থেকে মুকুটের চূড়া পর্যন্ত চার ভাগের এক ভাগ। আমরা যদি শুধু মুখমণ্ডলের উচ্চতা ধরি, থুতনির নিচ থেকে নাসারন্ধ্রের নিচের অংশ পর্যন্ত হলো এর তিন ভাগের এক ভাগ। নাক অর্থাৎ নাসারন্ধ্রের নিচের অংশ থেকে দুই ভ্রুর মাঝখানের রেখা পর্যন্তও একই; এবং সেখান থেকে কপালসহ চুলের সর্বনিম্নাংশ পর্যন্তও তিন ভাগের এক ভাগ। পায়ের দৈর্ঘ্য হলো পুরো দেহের দৈর্ঘ্যের ছয় ভাগের এক ভাগ; কনুই হতে কব্জি পর্যন্ত হাতের অংশ চার ভাগের এক ভাগ; বুকের প্রস্থও চার ভাগের এক ভাগ। শরীরের অন্যান্য অংশেরও রয়েছে তাদের নিজস্ব প্রতিসম অনুপাত, এবং সেগুলোকে কাজে লাগিয়েই অনাদিকাল থেকে চিত্রকর ও ভাস্কররা পেয়ে এসেছেন মহান ও অসীম খ্যাতি।
“একইভাবে, মন্দিরের অঙ্গসমূহের তথা প্রতিটি অংশের প্রতিসম সম্পর্কের সাথে সমগ্রকের পূর্ণাঙ্গ বিস্তারের মাঝে অবশ্যই থাকতে হবে এক শ্রেষ্ঠতম ঐকতান। আবার, স্বাভাবিকভাবেই মানবদেহের কেন্দ্রীয় বিন্দু হলো নাভি। কেননা একজন পুরুষ মানুষকে যদি তার পৃষ্ঠদেশের উপর ভর করে শুইয়ে দেয়া হয়, তার হাত ও পা থাকে প্রসারিত, এবং একজোড়া কম্পাসকে বসানো হয় তার নাভিকে কেন্দ্র করে, তাহলে তার হাত ও পায়ের আঙ্গুলগুলো স্পর্শ করবে ওখান থেকে সৃষ্ট বৃত্তের পরিধিকে। এবং ঠিক যেভাবে মানবদেহটি একটি বৃত্তাকার রেখা উৎপন্ন করে, ঠিক সেভাবেই এটি থেকে পাওয়া যেতে পারে একটি বর্গাকার ক্ষেত্রও। আমরা যদি পায়ের পাতা থেকে মাথার উপরিভাগ পর্যন্ত পরিমাপ করি, এবং সেই পরিমাণকে প্রয়োগ করি সম্প্রসারিত বাহুদ্বয়ের ক্ষেত্রে, প্রাপ্ত প্রস্থটি হবে ঠিক উচ্চতার সমান, যেমনটি হয়ে থাকে সমতল পৃষ্ঠের ক্ষেত্রে যেগুলো সম্পূর্ণ বর্গাকার।”
ঠিক এভাবেই ‘দে আর্কিতেকচুরা’ বইটির তৃতীয় খণ্ডের একদম শুরুর দিকে, প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় পাতায়, ভিট্রুভিয়াস বর্ণনা দিয়েছিলেন স্থাপত্যকলার সুষম অনুপাত ও মানবদেহের মধ্যকার সম্পর্কের।
এবার চলুন এগিয়ে যাওয়া যাক ১৫০০ বছর। ইউরোপে তখন চলছে রেনেসাঁ তথা পুনর্জাগরণের সময়কাল। মধ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে ইউরোপে তখন শিল্প, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতি এক নবজন্ম লাভ করছে। সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য ধ্রুপদী দর্শন, সাহিত্য ও শিল্পের, যেগুলো অনাগত ভবিষ্যতে মানবসভ্যতাকে নিয়ে যাবে সম্পূর্ণ নতুন এক উচ্চতায়।
ঠিক এমনই একটি সময়ের কথা বলছি। ১৪৫২ সালে পৃথিবীর বুকে আবির্ভাব ঘটেছে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি নামের এক অসামান্য, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষের। কী নন তিনি! চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, স্থপতি, সঙ্গীতজ্ঞ, গণিতজ্ঞ, সমরযন্ত্রশিল্পী, প্রাণীবিজ্ঞানী, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, জীবাশ্মবিজ্ঞানী, ভূ-বিজ্ঞানী, সাহিত্য বিশারদ, মানচিত্র বিশারদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞান- এমন আরো অসংখ্য বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায় তাকে।
এই মানুষটির এক অদ্ভূত স্বভাব ছিল। সবসময় নিজের সঙ্গে একটি নোটবুক রাখতেন তিনি। যখনই নতুন কোনো ধারণা জন্ম নিত তার মাথায়, সেগুলোকে তিনি টুকে রাখতেন নোটবুকের পাতায়। আবার বিভিন্ন গবেষণালব্ধ বিষয়ও স্থান পেত সেখানে। থাকত অসংখ্য ছবিও। তবে অদ্ভূত বিষয়টি হলো এই যে, তিনি আর দশজন মানুষের মতো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে লিখতেন না সেসব লেখা। ইতালীয় ভাষাতেই লিখতেন বটে, কিন্তু সব উল্টো হরফে, যেন লেখাগুলোর মর্মোদ্ধার করতে দরকার হয় আয়নার।
১৪৮৭ থেকে ১৪৯২ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়। সৃজনশীল জীবনের মধ্যগগণে বিরাজমান দা ভিঞ্চি। এদিকে শারীরবিজ্ঞানের রহস্যোদ্ঘাটনের নেশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার। কবর থেকে লাশ তুলে এনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, নতুন যা যা জানছেন সেগুলোকে কখনো মূর্ত, আবার কখনো বিমূর্তভাবে ফুটিয়ে তুলছেন নিজের সৃষ্টিকর্মে। এরই এক পর্যায়ে, ভিট্রুভিয়াসের ‘দে আর্কিতেকচুরা’ বইয়ে মানবদেহ বিষয়ক অনুপাতগুলোর কথা পড়ে ভীষণ রকমের রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন তিনি। তার মানসপটে ভেসে উঠল অনুপাতগুলোর অবয়ব। তাই দেরি না করে নিজের নোটবুকের পাতায়, সাদামাটা কালিতেই তিনি এঁকে ফেললেন ভিট্রুভিয়াসের বর্ণনা অনুযায়ী ছবি।
ছবিটিতে তিনি একজন মানুষকে দুটি ভিন্ন বিন্যাসে দেখালেন। দুটি ভিন্ন বিন্যাসকে তিনি রাখলেন একটি বৃত্ত ও একটি বর্গের মাঝে। দুটি ক্ষেত্রের মাঝেই তারা এঁটে গেল খুবই সাযুজ্যপূর্ণভাবে।
দা ভিঞ্চির আঁকা এই ছবিটি ভিট্রুভিয়াসের মানবদেহ অনুপাত তত্ত্বেরই একটি চিত্রায়ন, যে কারণে ছবিটির নামকরণ হয়েছে ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’। অবশ্য ছবিটির প্রকৃত নাম কিন্তু ছিল ‘লে প্রোপোরজিওনি দেল করপো উমানো সেকোন্দো ভিত্রুভিও’, যার আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ‘ভিট্রুভিয়াস অনুসারে মানবদেহের অনুপাত’।
তবে ভিট্রুভিয়াসের বর্ণিত অনুপাতকে উপজীব্য করে আঁকা বলেই যে সবদিক থেকেই দা ভিঞ্চি ভিট্রুভিয়াসকে অনুসরণ করেছেন, তা কিন্তু নয়। একটি বড় পার্থক্য হলো: ভিট্রুভিয়াসের মতে বৃত্ত ও বর্গক্ষেত্র উভয়ের কেন্দ্রই মানবদেহটির নাভি হলেও, দা ভিঞ্চি মনে করেছেন বৃত্ত ও বর্গক্ষেত্রটির অভিন্ন কেন্দ্র হতে পারে না। তাই তিনি মানবদেহটির কটিসন্ধি বা কুঁচকিকে বর্গক্ষেত্রের কেন্দ্র হিসেবে দেখিয়েছেন। এছাড়া আরেকটি জায়গায়ও ভিট্রুভিয়াসের আদি লিপি থেকে সরে এসেছেন দা ভিঞ্চি। তিনি মানবদেহের হাত দুটিকে প্রথম বিন্যাসের ক্ষেত্রে (বৃত্তের পরিধি স্পর্শ করছে যেখানে) এমন উচ্চতায় উত্তোলিত করেছেন, যেখানে হাতের আঙ্গুলের ডগা আর মানবদেহটির মাথার সর্বোচ্চ চূড়া অভিন্ন সমতায় অবস্থান করছে। অথচ ভিট্রুভিয়াসের ধারণা অনুযায়ী হাতের উচ্চতা আরো নিচে হওয়ার কথা ছিল। তাছাড়া ছবিটিতে মানবদেহের কেবল দুটি দৃশ্যমান বিন্যাস থাকলেও, এর সূক্ষ্ম অবয়বগত সমাহার বিশ্লেষণের মাধ্যমে মোট ১৬টি আলাদা বিন্যাস শনাক্ত করা সম্ভব।
মজার ব্যাপার হলো, দা ভিঞ্চি কিন্তু ছবিটি নিছকই তার ব্যক্তিগত আগ্রহ ও পড়াশোনার অংশ হিসেবে এঁকেছিলেন। ধারণা করা হয় যে, তিনি কখনোই এটি সকলের সামনে উন্মুক্ত করার কথা ভাবেননি। এবং হয়তো তিনি কখনো আশাও করেননি যে সাধারণ মানুষ এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবে, এবং একে নিয়ে মাতামাতি করবে, ঠিক যেমনটি তারা করে থাকে তার অন্যান্য মহৎ সৃষ্টিকর্মের ব্যাপারে। কিন্তু বাস্তবে ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ আজ চিত্রজগতে একদমই স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে, এবং ‘দ্য লাস্ট সাপার’ ও ‘মোনালিসা’র পাশাপাশি এটিই বিবেচিত হয় দা ভিঞ্চির শ্রেষ্ঠতম কাজ হিসেবে।
‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’-এর মূল আবাসস্থল হলো ইতালির ভেনিস শহরের গ্যালারি দেল আকাদেমিয়া। সেই ১৮২২ সাল থেকেই এই জাদুঘরে রয়েছে এটি। তবে সাধারণ কাগজ-কলমে আঁকা অন্য সব ছবির মতো এটিও অধিকাংশ সময়ই গোপনে সংরক্ষিত থাকে, কেবল বিশেষ কিছু সময়ে প্রদর্শন করা হয়। এই মুহূর্তে অবশ্য ছবিটি অবস্থান করছে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামে, দা ভিঞ্চির অন্যান্য সৃষ্টিকর্মের সাথে। ২৪ অক্টোবর ২০১৯ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত এটি সেখানেই অবস্থান করবে।
‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ দা ভিঞ্চি নোটবুকের যে পাতায় লিখেছিলেন, সেখানে ছবিটির ঠিক উপরে তিনি উল্টো করে লিখেছিলেন, ভিট্রুভিয়াসের মতে এগুলো হলো একটি আদর্শ মানবদেহের পরিমাপ:
- চার আঙ্গুল সমান এক বিঘত
- চার বিঘত সমান এক ফুট
- ছয় বিঘত সমান এক কিউবিট
- চার কিউবিট সমান একজন
- চার কিউবিট সমান এক পেস
- ২৪ বিঘত সমান একজন মানুষের উচ্চতা
আর ছবিটির নিচে দা ভিঞ্চি নিজের ভাষায় ছবিটির বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন এভাবে:
“আপনি যদি আপনার পা-দুটো দু’পাশে এমনভাবে ছড়ান, যাতে আপনার উচ্চতা ১/১৪ (চৌদ্দ ভাগের এক ভাগ) কমে যাবে; এবং আপনার হাত দুটো দুই পাশে মেলে ধরেন, এমনভাবে যেন আপনার হাতের মধ্যমা আঙ্গুলটির ডগা ঠিক আপনার মাথার চূঁড়ার সমান হয়, তাহলে আপনার হাত দুটো আর পা দুটোর অবস্থানকে স্পর্শ করে পুরোপুরি একটা বৃত্ত আঁকা যাবে আর আপনার নাভি হবে সেই বৃত্তের কেন্দ্র; এই দুই পায়ের মাঝখানের ফাঁকটি হুবহু একটি সমবাহু ত্রিভুজ তৈরি করবে।”
এভাবেই দা ভিঞ্চি ভিট্রুভিয়াসের ধারণার সাথে মিল রেখে একটি আদর্শ মানবদেহের পরিমাপ বর্ণনা করেছিলেন। এছাড়াও তিনি পরবর্তীতে তার নোটবুকের বিভিন্ন জায়গায় ছবিটিকে ব্যাখ্যা করতে লিখেছিলেন:
- দুদিকে সমানভাবে হাত প্রসারিত করলে এক হাতের শীর্ষ থেকে অপর হাতের শীর্ষ আসলে মানবদেহের উচ্চতা
- কনুই থেকে হাতের অগ্রভাগ পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ
- লিঙ্গ মানবদেহের উচ্চতার প্রায় অর্ধেক বরাবর অবস্থান করে
- মাথার অগ্রভাগ থেকে থুতনির নিচ পর্যন্ত দূরত্ব হলো একটি মানবদেহের উচ্চতার ৮ ভাগের ১ ভাগ
- বুকের উপর থেকে মাথার অগ্রভাগ পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ৬ ভাগের ১ ভাগ
- বুকের উপর থেকে চুলের গোড়া পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ৭ ভাগের ১ ভাগ
- কাঁধের মাপ হলো উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ
- বুক থেকে মাথার অগ্রভাগ পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ
- কনুই থেকে বগল পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ৮ ভাগের ১ ভাগ
- কনুই থেকে আঙুলের শীর্ষ পর্যন্ত দূরত্ব উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ
- হাতের আঙুল থেকে কবজি পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ১০ ভাগের ১ ভাগ
- পায়ের পাতা, মানবদেহের উচ্চতার ৬ ভাগের ১ ভাগ
- পায়ের তলা থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ
- হাঁটুর নিচ থেকে লিঙ্গের গোড়া অবধি দূরত্ব হলো উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ
অর্থাৎ এখানেও দা ভিঞ্চির বর্ণনার সাথে ভিট্রুভিয়াসের বর্ণনার একটি আদর্শ মানবদেহের যথাযথ পরিমাপটি মিলে যায়।
তবে এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। অনেকেই মনে করে থাকে, ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ ছবিটিতে হয়তো দা ভিঞ্চি ‘গোল্ডেন রেশিও’ বা ‘সোনালী অনুপাত’কে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তাই এ ছবির অনুপাতগুলোকে অনেকে ঐশ্বরিক অনুপাত হিসেবেও অভিহিত করে। এ ধারণার পালে আরো হাওয়া দিয়েছে ‘দে ডিভাইনা প্রোপোরশন’ (Devine Proportion) বইয়ের লেখক লুকা পাচিওলির সাথে মিলে দা ভিঞ্চির কাজ করার বিষয়টি (দা ভিঞ্চি ওই বইয়ের ছবিগুলো এঁকেছিলেন)। তবে পরবর্তী সময়ে অনেক গণিতবিদ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’-এর অনুপাতগুলো সোনালী অনুপাতের কাছাকাছি হলেও, তাদের মধ্যে অবিকল কোনো মিল নেই। তাছাড়া সম্ভবত পাচিওলির সাথে সাক্ষাতের পূর্বেই দা ভিঞ্চি ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ ছবিটি এঁকেছিলেন।
আরো একটি কারণে দা ভিঞ্চির ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ ছবিটি চিত্রজগতে খুবই বিশেষ একটি জায়গা দখল করে আছে। তার আগেও আরো অনেক চিত্রকরই চেষ্টা করেছেন ভিট্রুভিয়াসের ধারণা অনুযায়ী এমন কোনো মানুষের নকশা তৈরি করতে, যাকে একই সাথে একটি বৃত্ত ও একটি বর্গক্ষেত্র দুইয়ের মাঝেই স্থাপন করা সম্ভব। তারা সেটি করে দেখাতে না পারলেও, দা ভিঞ্চি পেরেছেন। এটি অবশ্যই শারীরবিজ্ঞান সম্পর্কে দা ভিঞ্চির অগাধ জ্ঞানের কল্যাণে, যে কারণে তিনি কেবল ভিট্রুভিয়াসের আদি লিপিকেই আঁকড়ে ধরে থাকেননি, প্রয়োজনমতো সেখানে কিছু পরিবর্তনও এনেছেন।
এছাড়াও অনেকেরই ধারণা, দা ভিঞ্চি হয়তো তার বন্ধু ও ভ্রাতৃপ্রতিম গিয়াকোমো আন্দ্রেয়ার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবিটি এঁকেছিলেন। রেনেসাঁ যুগের এই প্রকৌশলী একজন ভিট্রুভিয়াস বিশেষজ্ঞও ছিলেন। তার ছবিটিতে অনেক মোছামুছির দাগ পাওয়া গেছে, যা দেখে ধারণা করা যায় তার ছবিটিও মৌলিকই ছিল। হতে পারে দা ভিঞ্চি আন্দ্রেয়ার ছবিটি দেখেই নিজেও ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ এঁকেছিলেন, কিংবা দুজনে হয়তো একসাথেই ছবি দুটি এঁকেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দা ভিঞ্চির আঁকা ছবিটিই যে মূল উদ্দেশ্য, তথা শারীরবিজ্ঞানের রহস্য উদ্ঘাটনে সফলতা পেয়েছিল, সে প্রমাণ তো আমাদের চোখের সামনেই বিরাজমান।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
১) শিল্পীবিজ্ঞানী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি
২) লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি