কিছু বিখ্যাত মানুষের দৈনন্দিন রুটিন

অনেকেই হয়তো ভাবেন সফল মানুষগুলো খুবই আলাদা। তাদের মধ্যে হয়তো কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে যা সাধারণ মানুষের নেই। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে এমন নয়। তাঁরা নিয়মিত কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে মেধাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের এমন উচ্চতায় নিয়ে যান যে নিচ থেকে তাঁদের দেখতে ঈশ্বর সমান উচু মনে হয়। কিন্তু তাঁদের এই উচ্চতা যে একদিনে তৈরি হয় নি তা আমাদের চোখে পড়ে না। এই লেখায় কিছু বিখ্যাত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের রুটিন দেখবো। তাহলে দেখা যাবে তাদেরও সাধারণ মানুষের মতো প্রতিদিন কঠিন পরিশ্রম করতে হয়।

মোজার্ট

মোজার্ট ছিলেন আঠারো শতকের একজন বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ। এত বছর পরেও তিনি ও তাঁর কাজ সমুজ্জ্বল। তিনি ৬০০টির মতো কাজ কম্পোজ করেছিলেন। ১৭৮১ সালের দিকে মোজার্ট ভিয়েনাতে কাজ করেছেন। তাঁকে এসময় অনেক কাজ করতে হতো। পিয়ানো শেখানো, কনসার্ট সহ আরও অনেক কিছু। ফলে তিনি কম্পোজ করার জন্য খুব একটা সময় পেতেন না। ১৭৮২ সালে তাঁর বোনকে পাঠানো এক চিঠিতে তিনি লিখছেন,

“আমি সকল ছয়টায় চুল আঁচড়াই এবং সাতটার মধ্যে কাপড় পরি। তারপর আমি নয়টা পর্যন্ত কম্পোজ করি সকাল নয়টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত ক্লাস নিই তারপর আমি দুপুরের খাবার খাই এবং অনেক সময় কিছু বাড়িতে দাওয়াত থাকে, যেখানে তারা দুপুর দুইটা অথবা তিনটায় খাবার খায়. . .আমি সন্ধ্যা পাঁচটা অথবা ছয়টার আগে কাজ শুরু করতে পারি না। মাঝে মাঝে কনসার্ট থাকার কারণে এই সময়েও কাজ করা হয় না

কনসার্ট না থাকলে রাত নয়টা পর্যন্ত কম্পোজ করি তারপর আমি আমার প্রিয়তমা কন্সটানজির সাথে দেখা করতে যাই আমাদের একে অন্যকে দেখার আনন্দটা মাটি হয়ে যায় তার মায়ের তিক্ত ফোঁড়নে। তারপর সাড়ে দশটা কিংবা এগারোটার মাঝে আমি বাড়ি আসি। অবশ্য এটা নির্ভর করে তার মা কী পরিমাণ কথার বাণ নিক্ষেপ করে এবং আমি কী পরিমাণ তা সহ্য করতে পারি তার উপর। আমি সন্ধায় কম্পোজ করতে পারবো কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না কারণ অনেক সময় আমার কনসার্ট থাকে ,আবার আমি কোথায় কখন থাকবো তারও ঠিক থাকে না তাই আমার অভ্যাস হলো ঘুমানোর আগে একটু কম্পোজ করা। আমি সাধারণত রাত একটা পর্যন্ত কম্পোজ করি, তারপর আবার সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠি

মোজার্ট; Source: incimages.com

বিঠোভেন

বিঠোভেন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন আর রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেতেন। সকালের নাস্তায় খেতেন কেবল এক কাপ কফি। সকাল থেকে দুপুর দুইটা/তিনটা পর্যন্ত কাজ করতেন। রাতে খেতেন খুব অল্প করে। তার সব কিছুর মধ্যে একটা বদ অভ্যাস ছিলো অতিরিক্ত শরীর ধোয়া ও গোসল করা। তিনি মনে করতেন, মহানবী (স) নামাজের আগে ওজুর যে নিয়ম করেছিলেন তা ছিলো সঠিক। এই বেশী বেশী গোসল করার জন্য বাড়ির মালিকের সাথে তাঁর ঝামেলা লাগতো। কারণ পানি মেঝে চুইয়ে চুইয়ে নীচতলায় চলে যেত। তাই তাঁর বাড়ির মেঝেতে এসফাল্ট বিছানো থাকতো।

বিঠোভেন; Source: fraunhofer.de

সিগমুণ্ড ফ্রয়েড

সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের জীবন ছিলো কাজের ছকে বাঁধা। এমনকি খাবার টেবিলেও তিনি গভীর চিন্তায় হারিয়ে যেতেন। তাই তিনি তাঁর এক বন্ধুকে বলছেন, “কাজ ছাড়া জীবন স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হতে পারে এটা আমি চিন্তাই করতে পারি না।”

সকাল ৭টার দিকে তিনি ঘুম থেকে উঠেন। তারপর আটটা থেকে দুপুর পর্যন্ত রোগী দেখতেন। দুপুরের খাবার পর বিকাল তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত আবার রোগী দেখতেন। খাওয়ার মধ্যে তিনি ওয়াইন আর মুরগি অপছন্দ করতেন। তবে সিগারেটের প্রতি তার অত্যধিক আসক্তি লক্ষ্য করার মতো। মধ্য বিশ থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি দিনে প্রায় বিশটি সিগারেট খেতেন। একবার সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের ১৭ বছর বয়সী ভাতিজা সিদ্ধান্ত নিলো সে কখনও সিগারেট খাবে না। এতে ফ্রয়েড তাঁর জ্ঞানগর্ভ উক্তি করলেন,

“বাছা, সিগারেট হলো জীবনের সবচেয়ে দারুণ ও সস্তা আমোদ। তুমি যদি আগেভাগে সিগারেট না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকো তাহলে আমি তোমার জন্য শুধু দুঃখই প্রকাশ করতে পারি।”

আবার এই ফ্রয়েডই বলেছিলেন,

“চুমু খাওয়ার জন্য কেউ না থাকলে সিগারেট ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।”

সিগমুণ্ড ফ্রয়েড; Source: BBC.com

পাবলো পিকাসো

পিকাসো সারা জীবন রাতে দেরি করে ঘুমিয়েছেন আর সকালে দেরি করে উঠেছেন। তাঁর আঁকার স্টুডিওতে তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারতো না। তিনি চাইতেন তাঁর অন্তত এতটুকু টাকাপয়সা থাকুক যাতে করে তাঁকে জাগতিক বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে না হয়। তাঁর স্টুডিওতে পোষা জন্তুও থাকতো। তিনি দুপুর দুইটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা কাজ করতেন। খাবারের সময় কোনো কথা বলতেন না। যেন কোথাও হারিয়ে যেতেন। তিনি শুধু মেহমানদের সামনে সামাজিক হওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে তাঁর বিন্দুমাত্র কোনো বিরক্তি ছিলো না। সেটা হলো তাঁর কাজ। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। পিকাসো বলছেন,

“আমি যখন কাজ করি তখন আমার দেহকে দরজার ওপাশে রেখে আসি, ঠিক যেভাবে মুসলিমরা মসজিদে ঢোকার আগে জুতা খুলে রাখে।”

পাবলো পিকাসো; Source: biography.com

আইজাক আসিমভ

ছোটবেলায় আইজ্যাক আসিমভের সবচেয়ে আকর্ষণের জায়গা ছিলো তাঁর বাবার চকলেটের দোকান। তাঁর বাবা সেই দোকান খুলতেন সকাল ছয়টায় আর বন্ধ করতেন রাত একটায়। তাঁর বাবার এই দীর্ঘক্ষণ দোকান চালানোর যে অভ্যাস তা তাঁকে পরবর্তী জীবনে অনেকখানি প্রভাবিত করেছে।

“সম্ভবত আমি দীর্ঘক্ষণ কাজ করাকে উপভোগ করতাম। কারণ পরবর্তী জীবনে আমার মধ্যে কখনও এই চিন্তা আসে নি যে আমি আমার শৈশবে ও যৌবনে অনেক পরিশ্রম করেছি এখন একটু জীবনটাকে সহজভাবে নিই আর দুপুর পর্যন্ত ঘুমাই।

চকলেটের দোকানের অভিজ্ঞতা আমি আমার সাথে রেখে দিয়েছি। আমি সকালে পাঁচটা বাজে ঘুম থেকে উঠি। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজে লেগে যাই। যতক্ষণ পারি কাজ করি। এটা আমি সপ্তাহের প্রতিদিন করি। এমনকি বন্ধের দিনেও। আমি ইচ্ছা করে ছুটি নেই না। আর ছুটিতে থাকলেও আমি কাজ করার চেষ্টা করি। এমনকি আমি হাসপাতালে থাকলেও কাজ করার চেষ্টা করি।

অন্য কথায় আমি যেন এখনও চকলেটের সেই দোকানে আছি এবং চিরদিন থাকবো। যদিও আমি কাস্টমারের জন্য অপেক্ষা করছি না। টাকা নিচ্ছি না কিংবা ফেরত দিচ্ছি না। সবার প্রতি বিনয়ী ভাব দেখাতে আমি বাধ্য নই। কিন্তু আমি তাই করছি যা আমি করতে চাই। কিন্তু সেই রুটিনটা আমার সাথে আছে। যে রুটিনটা আমার সত্ত্বার সাথে জড়িয়ে আছে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন এই রুটিনের বিপক্ষে আমার হয়তো একসময় বিরুদ্ধ মনোভাব ছিলো।”

আইজাকের মতে, এই দীর্ঘ সময় কাজ করার অভ্যাসই তাঁকে জীবনে সুখী করেছে। হয়তো এজন্যই তিনি এত এত কাজ করে যেতে পেরেছেন, লিখেছেন প্রায় ৫০০ বই।

ছবিতে আইজ্যাক আসিমভ; Source: blahcultural.com

আলবার্ট আইনস্টাইন

আইনস্টাইনের জীবন ছিলো তাঁর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মতোই রহস্যে ঘেরা। দিনে ১০ ঘণ্টা ঘুমাতেন তিনি। বলতেন, এর চেয়ে ঘুম কম হলে তিনি কাজ করতে পারবেন না। হাঁটাহাঁটির শখ ছিলো তাঁর। আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময় আবহাওয়া থাকলে তিনি হেঁটেই অফিসে যেতেন। কখনও মোজা পরতেন না। কারণ ছোটবেলায় তিনি দেখেছেন পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের কারণে মোজা ছিঁড়ে যায়।

খুব ধূমপান করতেন আইনস্টাইন। মনে হতো সবসময় তিনি সাথে ধোয়া নিয়ে ঘুরছেন। তিনি মনে করতেন ধূমপান ভালো সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। তাঁর সময় কাটতো গবেষণা, চিঠির উত্তর দেয়া আর ভক্তদের সাথে দেখা করার মাধ্যমে। তাঁর জনপ্রিয়তার জন্য তাঁকে অনেক সময়ই অটোগ্রাফ দিতে হতো। তবে আইনস্টাইনের কাছ থেকে একটা বিষয় অবশ্যই শেখার আছে তা হলো শত বাঁধা বিপত্তির মাঝেও কীভাবে নিজের কাজ অব্যাহত রাখতে হয়। তাঁর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত নানা সমস্যা তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কখনও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি। এই মহাপ্রাণ তাই বলে গিয়েছেন,

“জীবন হলো সাইকেলের মতো। ভারসাম্য রাখতে হলে তোমাকে সামনের দিকে (অতীতকে পেছনে ফেলে) এগোতে হবে।”

Source: medium.com

তথ্যসূত্র

Daily Rituals: How Artists Work.

ফিচার ইমেজ: GEM magazine

Related Articles

Exit mobile version