শীতের সকালে পরিবারের সকলে উঠবে, গরম গরম নতুন চালের পিঠা কিংবা বিয়েতে অথিতি আপ্যায়নের পিঠা বানানো হবে, গ্রামবাংলায় এই কাজে একসময় ঢেঁকির বিকল্প চিন্তা করা মুশকিল ছিল। শুধু বিশেষ উৎসবের পিঠার জন্যই নয় বরং দৈনন্দিন খাবারের জন্য ধানকে চালে পরিণত করতেও ঢেঁকি ছিল অপরিহার্য। তাইতো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি কমলকান্ত এই ঢেঁকির প্রয়োজনীয়তা চিন্তা করে বলেছিলেন,
“আমি ভাবি কি, যদি পৃথিবীতে ঢেঁকি না থাকিত, তবে খাইতাম কি? পাখীর মত দাঁড়ে বসিয়া ধান খাইতাম? না লাঙ্গুলকর্ণদুল্যমানা গজেন্দ্রগামিনী গাভীর মত মরাইয়ে মুখ দিতাম? নিশ্চয় তাহা আমি, পারিতাম না।”
কমলাকান্তের এখন আর চিন্তা নেই, এখন নিত্যদিন তো দূরে থাক, উৎসব কিংবা পালা পার্বনেও ঢেঁকির আওয়াজ পাওয়া যায় না। তবে ঢেঁকিতে ধান ভানার কাজটি যে অমানুষিক রকমের পরিশ্রমের ব্যাপার ছিল তা বলাই বাহুল্য। তবে এই কাজটিকে নিজেদের মতো করে উপভোগ করার ব্যবস্থাও ছিল গ্রামীণ সমাজে। ঢেঁকিতে ধান ভানার সময়ে গান ধরতেন অনেকেই, অনেকেই ছড়া কাটতেন সুর করে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ছড়া আর গানে মুখরিত ছিল ঢেঁকিঘর। তাই একসময় ঢেঁকিতে ধান ভানার সময় ঢেঁকিঘর থেকে বেরিয়ে আসতো,
“ও ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া
ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া-দুলিয়া
ও ধান ভানিরে..”
বৃহত্তর বাংলায় যেখানে ধান প্রধান ফসল, ধান ঘরে তোলা সেখানে ছিল উৎসব। এমনকি বিয়ের মতো উৎসবের দিন ধার্য করার ক্ষেত্রে ঘরে নতুন ধান কবে উঠবে সেই অপেক্ষা করা হতো। আর তাই ঢেঁকির প্রয়োজনীয়তা সেখানে ছিল আকাশচুম্বী। এমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গ্রামীণ লোকসাহিত্যের একটি বড় অংশজুড়ে থাকবে সেই ব্যাপারটিই ছিল স্বাভাবিক। জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে বিয়ে বাড়িতে ঢেঁকিতে ধান ভানার যে বিবরণটি পাওয়া যায় তা অনেকটা এইরকম,
“ঢেঁকির উপরে তখন আম্বিয়াও গান ধরেছে। বিয়ের ধান ভানতে এসেছে সে। সন্ধ্যা থেকে ঢেঁকির উপরে উঠেছে ও আর টুনি। তখন থেকে এক মুহূর্তের বিরাম নেই। উঠোনে মেয়েরা গান গাইছিল। তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য টুনি আর আম্বিয়া দুজন গলা ছেড়ে গান ধরলো-
ভাটুইরে না দিয়ো কলা
ভাটুইর হইবে লম্বা গলা
সর্ব লইক্ষণ কাম চিক্কন
পঞ্চ রঙের ভাটুইরে।”
(উপরের ভিডিওচিত্রটি জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের আলোকে নির্মিত একই নামের চলচ্চিত্র থেকে নেওয়া; Video © Shuchanda)
কীভাবে কাজ করে?
বাংলায় প্রচলিত প্রবাদ আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। প্রবাদের ভাবার্থ যা-ই হোক ঢেঁকি কিন্তু শুধুমাত্র ধান ভানতেই ব্যবহৃত হয় না, চাল থেকে চালের গুড়াও তৈরি করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঢেঁকিকে মসলা, ডাল কিংবা অন্য কোনো শস্য গুড়ো করতেও ব্যবহৃত হয়। তবে পরিমাণের উপর নির্ভর করে ‘যাতা’র মতো পেষকযন্ত্রও ব্যবহৃত হতো। পেষণের কাজে কম পরিমাণের জন্য যাতা ব্যবহার করা হয় আর বেশি পরিমাণের জন্য ঢেঁকি।
ঢেঁকি বেশ প্রাচীন যন্ত্র হলেও এটি চালানোর ব্যাপারে কিন্তু বিজ্ঞানের কারিগরি কাজে লাগানো হয়। যে দ্রব্যকে ভাঙ্গা কিংবা পেষণ করা হবে তাকে একটি গর্তে রেখে তার উপর ঢেঁকি চালানো হয়। সাধারণত মাটি নির্মিত মেঝেতে গর্ত করে সেখানে ভালো করে লেপে তা শুকিয়ে নেওয়া হয়, ঢেঁকি চালানোর সময় যাতে চাল কিংবা ধানে যাতে মাটি না লেগে যায় সেই জন্য গর্তে একটি কাপড় কিংবা পলিথিন রেখে তার উপর চাল কিংবা ধান রাখা হয়। এই গর্তটি ‘খোঁড়ল’ নামেও পরিচিত। ধান ভানার কল আসার আগে অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে ঢেঁকিতে ধান ভানার জন্য ছিল আলাদা একটি ঘর, যেটি ‘ঢেঁকিঘর’ হিসেবে পরিচিত।
ঢেঁকিতে থাকে একটি মূল কাঠের কাঠামো যেটি ধড় নামে পরিচিত, ধড়টিতে ৭২ ইঞ্চি লম্বা এবং ৬ ইঞ্চি ব্যাসবিশিষ্ট কাঠ ব্যবহার করা হয়। শক্তপোক্ত কাঠ দিয়ে ঢেঁকি নির্মাণ করা হয়ে থাকে যাতে টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। এর দুইটি ভাগ, যেদিকে পা দিয়ে বল প্রয়োগ করা আর যেদিকে থাকে মুষল অর্থাৎ পেষণের কাজ করা হয়। ঢেঁকিতে মূলত পা দিয়ে বল প্রয়োগ করলে ধড়টি উপরে উঠে আসে, পা ছেড়ে দিলে সেটি গর্তে থাকা শস্যে আঘাত করে একে ভাঙ্গে। এই কাজের জন্য ঢেঁকির যে পাশে পা দিয়ে আঘাত করা হবে সেই পাশটিকে ছোট দুটি খুঁটির উপরে তিন অনুপাত একভাগ করে ছোট হুড়কা কিংবা বল্টু দিয়ে আটকে দেওয়া হয়।
হুড়কা দিয়ে আটকে দেওয়ার সময় লক্ষ্য রাখা হয়, যে পাশে পা দিয়ে ঢেঁকি চালানো হবে সেইপাশটি দৈর্ঘ্যে ছোট হয়। অপর পাশটিতে ধড়ের একদম সামনের দিকে সিলিন্ডার আকারের কাঠের খণ্ড যুক্ত করা হয়। ঐ কাঠের খণ্ডের একদম সামনে আবার লোহার পাত যুক্ত করে দেওয়া হয়, এটি মুষলের মতোই কাজ করে। মূলত লোহার পাত কিংবা লোহার আস্তরণ জুড়ে দেওয়ার কারণে ধান থেকে চাল কিংবা চালকে গুড়া করতে একটু অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া যায়, তবে লোহার পাত ছাড়া সাধারণ মুষলও কাঠের মুষলও দেখা যায়।
ঢেঁকি চালানোর কাজটি পুরোটাই অসামান্য কায়িক শ্রমের কাজ। ঢেঁকির সামনের দিকের ছোট অংশে বল প্রয়োগ করলে হুড়কায় আটকানো অংশটি লিভারের মতো কাজ করে, এর ফলে লোহার পাতসহ ধড়ের বাকী অংশ উপরে উঠে আসে। এরপর পা ছেড়ে দিলে ধড়সহ মুষল বিপুল গতিতে গিয়ে পড়ে সেই খোঁড়লে, ধান ভানার কাজ শুরু হয়। এইভাবে ক্রমান্বয়ে বারবার পা দিয়ে আঘাত করে ঢেঁকিকে চালানো হয়ে থাকে, প্রতিবার পা দিয়ে আঘাত করে এবং এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুষল গিয়ে খোঁড়লে আঘাত করাকে ‘পাড়’ বলা হয়ে থাকে।
বিশাল ওজনের ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার কাজটি দুই থেকে তিনজন করে থাকেন। দুইজন একই সাথে মিলে পা দিয়ে ঢেঁকি চালিয়ে থাকেন সাধারণত। ফলে কষ্ট কিছুটা কমে আসে। আরেকজন থাকেন যিনি নিজের হাত কিংবা লাঠি দিয়ে গর্তে থাকা চাল কিংবা ধানকে বারবার নেড়ে দেন। নিচে পড়ে যাওয়া ধান এতে করে উপরে উঠে আসে এবং ভানতে সুবিধা হয়।
লম্বা হাতলের মাথায় নারিকেলের খোল বেঁধেও বারবার নেড়ে দেওয়া হয় ধান চালকে। কিছুক্ষণ পর পর খোঁড়ল থেকে চাল কিংবা ধান সংগ্রহ করে কুলায় ঝেড়ে কিংবা চালুনি দিয়ে চেলে অবশিষ্টাংশ আবার খোঁড়লের ঢেলে দেওয়া হয় আবার চালু করা হয় ঢেঁকি। এভাবেই চার থেকে পাঁচজনের একটি দল ঢেঁকিতে কাজ করে। চার-পাঁচজন পালা করে কাজ করে, ফলে একজন ধান ভেনে ক্লান্ত হয়ে পড়লে আরেকজন ঢেঁকিতে গিয়ে পাড় দেওয়া শুরু করে।
ঢেঁকিতে গান গাওয়া কিংবা শ্লোক বলা
একসময় ঘরে নতুন ধান তোলার পর বাড়িতে বাড়িতে ধান ভানার ধুম পড়ে যেত। সন্ধ্যা, ভোররাত, দুপুরে নারীরা ঢেঁকিতে পালা করে ধান ভানতেন। বিত্তশালী গৃহস্থের বাড়িতে ধান ভানতে আসতেন প্রান্তিক খেটে খাওয়া নারীরা। পারিশ্রমিক হিসেবে টাকা পয়সা কিংবা ধান দেওয়া হতো তাদের।
ঘন্টার পর ঘন্টা ঢেঁকিতে কাজ করার অমানুষিক পরিশ্রম দূর করতে ঢেঁকিতে কাজ করতে সবাই মিলে গান ধরতেন কিংবা মুখে মুখে প্রচলিত শ্লোক, খনার বচন বলতেন, নারীদের পারিবারিক আর সামাজিক আলাপের কেন্দ্রও ছিল এই ঢেঁকিঘর। তাই ঢেঁকি হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে মুখে মুখে প্রচারিত ঐতিহ্যবাহী গান আর শ্লোকও হারিয়ে যাচ্ছে।
ঢেঁকির হারিয়ে যাওয়া এবং মেশিনে ধান ভাঙ্গার শুরু
গ্রামগঞ্জে বিদ্যুতায়ন হয়েছে, ধান ভানার মেশিন এসেছে। মেশিন সহজলভ্য হয়ে আসার পর থেকে ঢেঁকির ব্যবহার কমতে শুরু করেছে, অনেক গ্রামেই ঢেঁকি এখন সুদূর অতীতের ঘটনা। ঢেঁকিছাটা বাদামী চাল দেখা যায় না, বিয়ে পালা পার্বনে ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার জন্য গ্রামের মহিলাদের ডাক পড়ে না। ঢেঁকি থেকে গান ভেসে আসে না।
অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে ঢেঁকিঘরের অস্তিত্বও নেই। গ্রামেগঞ্জে বিদ্যুৎচালিত ধান ভানার মেশিন চলে আসায় সারা বাংলাদেশেই এখন ঢেঁকি হয়তো হাতে গোনা যাবে। নতুন প্রজন্মের কাছে হয়তো রহস্য হয়েই থেকে যাবে কীভাবে পা দিয়ে ঢেঁকি চালিয়ে ধান থেকে চাল আর চাল থেকে চালের গুড়া তৈরি করা হতো। ঢেঁকিছাটা চাল নেই, মেশিনে ভাঙ্গা চালের গুড়ায় পিঠা আর মিষ্টিতেও নেই সেই স্বাদ, নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই ঢেঁকি সুদূর অতীতের কোনো এক যন্ত্র, প্রবীণদের চোখে গ্রামগুলোতে ঢেঁকি হারিয়ে যাওয়ার হতাশা।