ইদানিং ঘোস্ট রাইটিং নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল জেগে উঠেছে। পর্দার অন্তরালে থাকা এই ভূত লেখকদের কাজ কীভাবে হয়, তাদের প্রতিভার মূল্যায়ন ঠিকমতো হয় কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন সবার।
ধরুন, কেউ একজন নিজের জীবনী লিখতে চান, কিন্তু হাতে সময় নেই কিংবা লেখালেখিটা তার আসে না। অথচ তার জীবনকাহিনী শোনার জন্য আগ্রহে ফেটে পড়ছেন সবাই। সেক্ষেত্রে সমাধান করে দিতে পারে ঘোস্ট রাইটাররাই। তারা সেই ব্যক্তির আগের ডায়েরি, সাক্ষাৎকার কিংবা অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারেন আস্ত একটা বই।
উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে বিষয়টা কিছুটা অন্যরকম। জনপ্রিয় লেখকদের বইয়ের কাটতি থাকে প্রচুর। পাঠকদের চাহিদা মেটানোর জন্য লেখকের অনুমতি নিয়ে তাই ঘোস্টরাইটারদের ভাড়া করা হয়। মূল লেখকের অনুকরণে বই লিখে দ্রুতগতিতে প্রকাশ করার জন্য এই বুদ্ধি।
বলতে গেলে প্রায় সব বিখ্যাত ব্যক্তির আত্মজীবনীই লেখার পেছনে ছিলেন ঘোস্ট রাইটারেরা। হোন তিনি জন এফ কেনেডি, হিলারি ক্লিনটন, বারাক ওবামা, ল্যান্স আর্মস্ট্রং কিংবা শেন ওয়ার্ন। ঘোস্ট রাইটার দিয়ে লেখানো বিখ্যাত উপন্যাসের কথা বলতে গেলে চলে আসে আলেক্সান্দার দ্যুমার ‘দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ কিংবা ‘কাউন্ট অফ মন্টেক্রিস্টো’র কথা। এছাড়াও বহু বইয়ের সিরিজ শুরু করার পর ব্যাপক কাটতি ও চাহিদা পাওয়ার কারণে সেসব সিরিজ লেখানো হয়েছে তাদের দিয়ে। ‘ন্যান্সি ড্রিউ’ সিরিজ, ‘দ্য হার্ডি বয়েজ’ সিরিজ, আয়ান ফ্লেমিংয়ের ‘জেমস বন্ড’ সিরিজ, টম ক্ল্যান্সির ‘জ্যাক রায়ান’ সিরিজের প্রাথমিক বইগুলোর আদলে লিখে গেছেন ঘোস্টরাইটারেরা। সিরিজের বই লেখার ক্ষেত্রে চরিত্রগুলো আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত থাকে৷ তাই কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায়।
শুধু আত্মজীবনী বা উপন্যাস না, নন ফিকশন বইও লেখানো হয় ঘোস্টরাইটারদের দিয়ে। স্টিভেন আর কোভির ‘সেভেন ইফেক্টিভ হ্যাবিটস অভ হাইলি সাক্সেসফুল পিপল’ বইটি লেখায় সাহায্য করেছেন কেন শেলটন। এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ দেয়া যাবে।
প্রশ্ন হলো ঘোস্ট রাইটারেরা লিখলে তাদের নামটা দিলে সমস্যা কোথায়? একান্ত সাক্ষাৎকার জাতীয় বই লিখলে লেখকের নামটা দিতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বিখ্যাত কারো আত্মজীবনী লেখার সময়ে তাদের নামটাই একটা ব্র্যান্ড হিসেবে কাজ করে, ফলে সহজেই বইগুলো চলে আসে বেস্টসেলারের কাতারে। আর তাতে আখেরে ঘোস্ট রাইটারের লাভই হয়। কারণ, নিজের নাম দিয়ে অল্প কপি বিক্রির চাইতে বেস্টসেলার বইয়ের লভ্যাংশ পাওয়াটাই বেশি লাভজনক।
সে প্রসঙ্গেই আসে ঘোস্ট রাইটারদের আয়ের ব্যাপারটি। তারা চুক্তি অনুযায়ী এককালীন টাকা পেতে পারেন কিংবা রয়্যালটির ভাগ পেতে পারেন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বইয়ের যত মুদ্রণ হবে, ততই টাকা জমতে থাকবে তার ব্যাঙ্কে। কিন্তু তিনি কখনোই লেখার স্বত্ব পাবেন না। কেননা, এই বইটি লেখার পরিকল্পনা করেছেন মূল লেখক, বাড়ির আর্কিটেক্টের মতো। আর ফিকশন বইয়ের ক্ষেত্রে তিনি এডিটিংয়ের সময়ে কিছু বাড়তি মালমশলাও যোগ করে দেন। ফলে, বইয়ে মূল লেখকের লেখার ‘ফ্লেভার’ ভালোভাবেই চলে আসে। ধরেই রাখা হয় যে, ঘোস্ট রাইটারেরা মূল বিষয়বস্তুকে শতভাগ তুলে আনার ক্ষমতা রাখেন না।
ঘোস্ট রাইটারদের হাতে বেশ কিছু দায়িত্ব থাকে। মূল ধারণাটাকে পাঠকের কাছে কীভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করা, মূল লেখকের সাথে বসে বইয়ের আগাগোড়া একটা খসড়া বানানো, বইয়ের বিষয় নিয়ে ভালোমতো গবেষণা করা এরকম বহু ঝক্কির মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাদেরকে। ঘোস্ট রাইটারদের লেখার স্বাধীনতাও বেশ কম থাকে, মূল লেখকের মনোভাব ঠিকভাবে প্রকাশের জন্য বারবার লেখায় চলতে থাকে সম্পাদনার কাঁচি। উপন্যাসের ক্ষেত্রে মূল লেখকের লেখার ধাঁচ এবং মান বজায় রাখার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করা হয়।
নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট করে নেয়া হয় শুরুতেই। ফলে তারা বইয়ের নাম কিংবা সে বইয়ের সাথে তাদের সম্পৃক্ততার ব্যাপারটি গোপন রাখেন।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঘোস্ট রাইটিং বহুল প্রচলিত একটি পেশা। সাহিত্যের ছাত্ররা অনেকসময়ে ডিগ্রি নিয়ে বেরোবার আগেই এ ধরনের কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ে। শুধু বই না, কবিতা, গান এমনকি ভাষণ লেখারও কাজ করে থাকে তারা। এটা তার বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হলেও লেখার কৃতিত্ব পাওয়া যাবে না, তা মেনে নিয়েই বুদ্ধিশ্রম দিয়ে চলেন তারা। অনেকসময় অবশ্য মূল লেখকের অনুমতি নিয়ে ঘোস্ট রাইটারদের নামও প্রকাশ করা হয়। জেমস প্যাটারসনের ‘দ্য শেফ’ কিংবা ‘দ্য ফার্স্ট লেডি’ এর উজ্জ্বল উদাহরণ। প্যাটারসনের ঘোস্ট রাইটারের দল বেশ চড়া বেতনে কাজ করেন। ২০০০ পরবর্তী টম ক্ল্যান্সির বইগুলোতেও এমনটা দেখা যায়।
প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সাধারণত ঘোস্ট রাইটারের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। একইভাবে বেশিরভাগ ঘোস্ট রাইটারেরই পরে আর মূলধারার লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা হয়ে ওঠে না। কিছু ব্যতিক্রম আছে অবশ্য।
অনেকেই শুনলে অবাক হবেন যে, জনপ্রিয় হরর লেখক এইচ পি লাভক্র্যাফট ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ঘোস্ট রাইটিং করতেন। সাহিত্যিক ডেভিড ভ্যান বুশের হয়ে লেখালেখি করে দিলেও বুশকে খুব উঁচুদরের লেখক অবশ্য মনে করতেন না তিনি। জাদুকর হ্যারি হুডিনির হয়েও লেখালেখি করেছেন তিনি। ২০০৬ সালে ক্যারিয়ারের স্বর্ণযুগ কাটানোর সময়ে মারা যান মিকি স্পিলানে। তার অসম্পূর্ণ উপন্যাস শেষ করতে সাহায্য করেন ম্যাক্স অ্যালান কলিন্স। কলিন্স নিজে ছিলেন একজন রহস্যোপন্যাস লেখক। পরে ডিক ট্রেসি কমিক্সের দায়িত্বও নিয়েছিলেন তিনি। ঘোস্ট রাইটার হলেও তার সম্পৃক্ততা নিয়ে অবশ্য রাখঢাক করা হয়নি। খ্যাতনামা সাহিত্যিক জ্যাক লন্ডনের রাইটার’স ব্লক কাটাতে সাহায্য করেছিলেন সিনক্লেয়ার লুইস। এছাড়া মরিস ম্যাকলফলিনের ‘টেনিস অ্যাজ আই প্লে’ বইটি লেখার সময়ে সাহায্য করেছিলেন তিনি, যেটি যুক্তরাষ্ট্রে টেনিসের জনপ্রিয়তা বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে। পরবর্তী সময়ে সাহিত্যে নোবেল জিতে নেন লুইস।
এদিকে ব্রিটিশ সঙ্গীতজ্ঞ স্যার এলটন জনের সাথে প্রায় পাঁচ দশক কাজ করে যাওয়া বার্নি টপিনও একজন ঘোস্ট রাইটার ছিলেন। সম্প্রতি ‘রকেটম্যান’ চলচ্চিত্রের জন্য এলটনের সাথে যৌথভাবে অস্কারও জিতে নিয়েছেন তিনি। আবার ক্লাসিক সঙ্গীতগুরু মোজার্টও তখনকার সময়ে অভিজাত ব্যক্তিদের হয়ে গান লিখে দিতেন।
ঘোস্ট রাইটারেরা আত্মজীবনী লেখার সময়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য জেনে ফেলেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা দেশের নিরাপত্তা সংস্থার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের জীবনী লেখার সময়ে ঘোস্ট রাইটারদের তাই গুরুতর পর্যায়ের গোপনীয়তার চুক্তি করে নিতে হয়। এধরনের কাহিনী নিয়ে ‘দ্য ঘোস্ট রাইটার’ নামের থ্রিলার মুভিটি বানিয়েছেন রোমান পোলানস্কি।
বাংলাদেশে খুব সম্ভবত সেবা প্রকাশনীই প্রথম অফিশিয়ালি ঘোস্ট রাইটারদের দিয়ে বই লেখানো শুরু করে। রকিব হাসান যখন তিন গোয়েন্দা প্রজেক্ট থেকে সরে যান, তখন কিছুদিন তার নামে আবার কিছুদিন শামসুদ্দীন নওয়াবের নামে বিভিন্ন ঘোস্ট রাইটার গল্প লিখে গেছেন। তারও বহু আগে মাসুদ রানা সিরিজ শুরু করেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। মৌলিক উপন্যাস ‘ধ্বংসপাহাড়’ দিয়ে শুরু করে সিরিজের প্রথম ১১টি বই লিখেছিলেন তিনিই। পরবর্তী বইগুলোর ক্ষেত্রে ঘোস্ট রাইটার হিসেবে কাজ করেছেন শেখ আব্দুল হাকিম, কাজী মায়মুর হোসেন, কাজী শাহনূর হোসেন, ইফতেখার আমিন সহ বিভিন্ন লেখক। এছাড়াও কুয়াশা, ওয়েস্টার্ন সিরিজগুলো দিয়ে বাংলাদেশে একচ্ছত্রভাবে পেপারব্যাক বইয়ের ব্যবসা করেছে সেবা।
২০১৯ সালের ২৯ জুলাই শেখ আব্দুল হাকিম নিজের লেখা বইগুলোর লেখক হিসেবে মালিকানাস্বত্ব দাবি করে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ দাখিল করেন।
সে মামলারই সূত্র ধরে কিছুদিন আগে মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি বইয়ের লেখক হিসেবে শেখ আব্দুল হাকিমকে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিটি বইয়ের জন্য আলাদাভাবে আবেদন করলেই এখন বইগুলোর কপিরাইট হয়ে যাবে তার। সেবা প্রকাশনী কিংবা মাসুদ রানা ছাড়াও অন্যান্য অনুবাদ কিংবা মৌলিক উপন্যাস লিখেছেন এই গুণী লেখক। বর্তমানে প্রথমা প্রকাশনীর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তিনি। তবে কপিরাইটের কথা উঠলে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়।
সেবার বহুল জনপ্রিয় তিন গোয়েন্দা বা মাসুদ রানা সিরিজের অধিকাংশ কাহিনীই বিদেশী কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে লেখা। মজার ব্যাপার, উপরে ঘোস্ট রাইটিংয়ের উদাহরণ হিসেবে দেয়া ‘দ্য হার্ডি বয়েজ’, ‘জেমস বন্ড’ কিংবা ‘জ্যাক রায়ান’ সিরিজের বইগুলো থেকে কাহিনী ধার করা হয়েছে এখানে। মৌলিক কাহিনী লেখার কৃতিত্ব না থাকলেও সাবলীল অনুবাদক হিসেবে পাঠকদের মন জয় করে নিয়েছেন, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর সেক্ষেত্রে সেবার কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেনেরও অবদান কম নয়, কেননা লেখার মধ্যে সামান্য কিছু মাল-মশলা যোগ করার কারণেই সাধারণ লেখনী অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে।
শেখ আব্দুল হাকিমের বক্তব্য অনুযায়ী, মাসুদ রানা সিরিজের রিপ্রিন্টের লভ্যাংশ থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এদিকে সেবা থেকে যুক্তি দেখানো হয়, আবদুল হাকিম সেবা প্রকাশনীতে চাকরি করতেন। চাকরিসূত্রে বই লিখে তিনি স্বত্ব পেতে পারেন না। তার সাথে শুরুতে যেভাবে চুক্তি করা হয়েছিল, তার কোনো বরখেলাপ করা হয়নি। কিন্তু কপিরাইট বোর্ডের রায় বলছে, শেখ আবদুল হাকিম যে সেবা প্রকাশনীতে চাকরি করতেন, এর সপক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে পারেননি কাজী আনোয়ার হোসেন। তাই চাকরিজীবী হলেও পাণ্ডুলিপি প্রণেতা হিসেবে রচনার মূল মালিক হিসেবে এখন থেকে বইগুলোর মালিক হয়ে যাচ্ছেন আব্দুল হাকিম।
বিষয়টির সমাধান কীভাবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে। যুগের পর যুগ ধরে দেশে-বিদেশে চলে আসা এ প্রথা চলবে ভবিষ্যতেও। খ্যাতি না পেলেও অন্তত ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হবেন না ঘোস্ট রাইটারেরা, এটাই সবার প্রত্যাশা।