Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হ্যান্ড অফ ডেজার্ট: মরুভূমির বিশাল শূন্যতার মাঝে অনন্য এক ভাস্কর্য

৪১,০০০ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর চিলিতে অবস্থিত শীতল, শুষ্ক, বৃষ্টিহীন, প্রাণহীন এক মরুভূমি আটাকামা। এর একদিকে রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের অথৈ জলরাশি, অন্যদিকে আন্দিজ পর্বতমালা। কী অদ্ভুত প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য! দিগন্তজুড়ে যেখানে শুধুই শূণ্যতা, মাইলের পর মাইল হেঁটে গেলেও দেখা মেলে না প্রাণের কোনো স্পন্দন। চোখে পড়ে না কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণী। আটাকামা মরুভূমি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এর আয়তন প্রায় ৩,৬৩,০০০ বর্গ কিলোমিটার।

দিগন্তজুড়ে বিস্তৃত আটাকামা মরুভূমি। ছবিসূত্র: amusingplanet.com

এই বিশাল জায়গায় হাজার রকমের প্রাণী আর উদ্ভিদ বৈচিত্র্য থাকার কথা ছিল। কিন্তু যুগের পর যুগ বৃষ্টিহীনতার কারণে এখানকার পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। চিলির এই আটাকামা মরুভূমি পৃথিবীর অন্যতম শুকনো এলাকা হিসেবেই বিশ্বে পরিচিত।

চিলির আটাকামা মরুভূমি। ছবিসূত্র: flickr.com

আটাকামা মরুভূমিতে প্রতি বছর গড়ে ১৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আর কয়েকটি অংশে কার্যত কোনো বৃষ্টিই হয় না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানীর দাবি, একসময় এলাকাটিতে ছিল হ্রদ আর জলাশয়, কিন্তু এখন সেখানে ধু ধু প্রান্তর, পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক মরুভূমি। সম্ভবত সেই পানি পূর্ণ থাকার সময়কাল ছিল নয় হাজার থেকে সতের হাজার বছরের মধ্যবর্তী সময়ে।

মানচিত্রে আটাকামা মরুভূমির অবস্থান। ছবিসূত্র: amusingplanet.com

কিন্তু এর নিচে রয়েছে খনিজ সম্পদের এক বিশাল ভাণ্ডার। বিজ্ঞানীরা এই মরুভূমির প্রকৃত সংজ্ঞা দেয়ার জন্য একে বলে থাকেন Absolute Desert। আবহাওয়াবিদদের মতে, এখানে প্রায় ১৫৭০ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৪০০ বছর কোনো বৃষ্টি হয়নি। তাদের মতে এখানে প্রতি ১০০ বছরে গড়ে ৩ থেকে ৪ বার বৃষ্টি হয়। মরূভূমিতে পর্যটকদের জন্য তেমন কিছু নেই বললেই চলে, কিন্তু একটি অনন্য ভাস্কর্য এই শুষ্কহীন মরুভূমিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। ধূ ধূ মরুভূমিতেও টেনে নিয়ে এসেছে পর্যটকদের।

শুষ্ক, বৈচিত্র্যহীন আটাকামা মরুভূমি। ছবিসূত্র: charismaticplanet.com

মরুভূমির বিশাল এই শূন্যতার মাঝে মরুভূমির কোনো এক প্রান্তরে হঠাৎই চোখে পড়তে পারে এক দানবীয় হাতের। অবাক হচ্ছেন? এই হাত এলো কোথা থেকে? সত্যিই এক অপূর্ব ভাস্কর্য সেই দানবীয় হাতখানা, স্প্যানীশ ভাষায় যার নামকরণ করা হয়েছে ‘মানো ডেল ডেসিটারো’, ইংরেজিতে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘হ্যান্ড অব ডেজার্ট’, আর বাংলায় তর্জমা করলে ‘মরুভূমির হাত’। এই সুবিশাল হাতের আঙুলগুলো আকাশ পানে দিক নির্দেশ করছে, যা আপনাকে মনে করিয়ে দিতেই পারে বিশাল দৈত্যাকার গালিভার ট্রাভেলস-এর অবয়ব। আন্তোফোগোস্তা শহর থেকে প্যান-আমেরিকান হাইওয়ের দিকে যাওয়ার পথে যেকোনো ভ্রমণ পিপাসুরই দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এই ভাস্কর্যের কাছ থেকে। মরুর বালি ফুঁড়ে উঠে আসা কাটা হাতের ভাস্কর্য যেন দাঁড়াতে বলছে আগত কোনো পথযাত্রীকে। এ দৈত্যাকার হাত মরুভূমির মাটির নীচ থেকে উঠে আসা এই প্রাচীন সভ্যতার ক্ষয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলোকেই যেন ইঙ্গিত করছে বলে মনে হবে আগত পর্যটকদের।

মরুভূমির ধূ ধূ বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা ‘মানো ডেল ডেসিটারো’, বা ‘হ্যান্ড অব ডেজার্ট’। ছবিসূত্র: amusingplanet.com

আচমকা দেখলে মনে হতে পারে ভুলে আপনি হয়েতো হলিউডের কোনো ফিউচারিস্টিক সিনেমার সেটে ঢুকে পড়েছেন। এই বুঝি সিনেমার লোকজন তেড়ে আসছে আপনাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু যা ভাবছেন, আসলে কিন্তু তা নয় মোটেও। এই হাতটি একান্তভাবেই সত্য।

মরুভূমির ধূ ধূ বালিয়াড়িতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাতের পাঁচটা আঙুল। কবজির নিচটা বালির নিচে আটকে থাকা, তা তেমন একটা চোখে পড়ে না। স্বভাবত এমন প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে আপনার মাঝে, “এই প্রকান্ড হাতটি আসলে কার?” মরুভূমির মাঝে হঠাৎ এতো একটা বড় হাত কোথা থেকেই বা এল? কে-ই বা এটি তৈরি করেছে?

প্রখ্যাত ভাস্করশিল্পী মারিও ইররাজাবালার এক অসাধারণ শিল্পকর্ম ‘হ্যান্ড অফ দ্য ডেজার্ট’। ছবিসূত্র: flickr.com

চিলির প্রখ্যাত ভাস্করশিল্পী মারিও ইররাজাবালার এক অসাধারণ শিল্পকর্ম চিলির এই মানো দেল দেসিয়ার্তো। চিলির এই ভাস্কর যুক্তরাষ্ট্রের নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন ও চিত্রকর্মের উপর পড়াশোনা করেন এবং পরে পশ্চিম জার্মানির প্রখ্যাত ভাস্কর অটো উডলেমারের অধীনে ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশোনা করেন।

চিলির প্রখ্যাত ভাস্করশিল্পী মারিও ইররাজাবালা। ছবিসূত্র: marioirarrazabal.cl

শিল্পী ইররাজাবালার পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের বিশালাকারের হাতের ভাস্কর্য রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি রয়েছে উরুগুয়ে পন্টা দেল এস্টের ব্রাভা সমুদ্রতটে। এই ভাস্কর্যকে ডাকা হয় বিভিন্ন নামে; যেমন: হম্বরে আর্মিয়িংও এ লা ভিডা (ম্যান ইমার্জিং ইনটু লাইফ), মনুমেন্টো লস ডিডোস (ফিঙ্গারদের স্মৃতিস্তম্ভ) বা মনুমেন্টো আল আহোগাদো (মনুমেন্ট টু দ্য ড্রোনড) বা ডুবে যাওয়া স্মৃতিস্তম্ভ। তার আরেকটি হাতের ভাস্কর্য স্পেনের মাদ্রিদের জুয়ান কার্লোস পার্কের মধ্যে অবস্থিত যা তিনি নির্মাণ করেন ১৯৮৭ সালে।

উরুগুয়ে পন্টা দেল এস্টের ব্রাভা সমুদ্রতটে শিল্পী ইররাজাবালার বিশালাকার হাতের আরেকটি ভাস্কর্য । ছবিসূত্র: amusingplanet.com

চিলির আটাকামা মরুভূমিতে অবস্থিত ‘হ্যান্ড অফ ডেজার্ট’ উচ্চতায় ৩৬ ফুট, ১৯৮০ সালের শুরু দিকে এই ভাস্কর্যটি তৈরির কাজ শুরু হয়। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১,১০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ভাস্কর্যটি এক কথায় অপূর্ব। শিল্পীর নিপুণ হাতের পরশ ভাস্কর্যটিকে করে তুলেছে জীবন্ত। একটি স্থানীয় বুস্টার সংস্থা ‘কর্পোরেশন প্রো অ্যান্টোফাগস্টা’ এই ভাস্কর্য তদারকির দায়িত্বে ছিল। ২৮ মার্চ ১৯৯২ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়। দেখতে যতই বিদঘুটে হোক না কেন, কাউকে ভয় দেখানো বা চমক তৈরির অভিপ্রায় শিল্পীর ছিল না। সম্পূর্ণ দার্শনিক ভাবনা থেকে ইররাজাবালা এটি তৈরি করেন।

স্পেনের মাদ্রিদের জুয়ান কার্লোস পার্কে অবস্থিত শিল্পী ইররাজাবালার বিশাল আকার হাতের ভাস্কর্য । ছবিসূত্র: amusingplanet.com

ইররাজাবালা তার অনন্য শিল্পমত্তার এই ভাস্করর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন মানুষের মনের নানা আবেগ, অনুভূতিকে। দৈত্যাকার হাত মনে করিয়ে দেয় এই বিশাল মহাবিশ্বের মাঝে মানুষের নিদারুণ দীনতা ও ক্ষুদ্রতাকে। দিকচিহ্নহীন মরুর বিশাল প্রান্তরে এই হাতটি মানুষকে যেন জানান দেয় তার ক্ষণস্থায়িত্ব, জানিয়ে দেয় প্রকৃতির সামনে তার অসহায় অবস্থান। তার সাথে শিল্পী আরো তুলে ধরতে চেয়েছেন ভয়াবহ মানবাধিকারের বিষয়গুলি যা চিলির জনগণ অতীতের সাথে মোকাবিলা করেছে। এই ভাস্কর্য মানুষকে রুখে দাঁড়াতে বলে প্রবল অন্যায়, একাকীত্ব, নির্যাতনের বিরুদ্ধে

এই ভাস্কর্য দূর থেকে দেখলে মনে হতেই পারে, মরুর বালি দিয়ে হয়তো তৈরি এটি। কিন্তু আসলে এটি এক সুবিশাল লৌহ কাঠামোর ওপরেই নির্মিত। ক্ষণে ক্ষণে মরুভূমির আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে যাতে এই ভাস্কর্যটির কোনো ক্ষতি হতে না পারে, তার ব্যবস্থাও করেছেন ভাস্কর ইররাজাবালা।

স্থাপত্যটি দেখতে আসা পর্যটকদের ভিড়। ছবিসূত্র: flickr.com

এই মুহূর্তে ‘হ্যান্ড অফ দ্য ডেজার্ট’ বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় হিসেবেই পরিগণিত। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল পরিমাণ পর্যটক ভিড় জমান এটি দেখতে। তবে দু:খজনক বিষয় হলো কিছু পর্যটক রয়েছে এই ভাস্কর্যের দেয়ালে তাদের নানা চিত্রকর্ম ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট থাকেন। ফলে ভাস্কর্যটির সৌন্দর্য দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি এই ভাস্কর্যের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠান বছরে দু’বার ভাস্কর্যটি পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ তদারকি করছে।

ভাস্কর্যের দেয়ালে আগত পর্যটকদের নানা চিত্রকর্ম যা স্থাপত্যের সৌন্দ্যর্যকে নষ্ট করছে। ছবিসূত্র: flickr.com

ফিচার ইমেজ: flickr.com

Related Articles