উপরের ছবিটি দেখুন। কেউ যদি আপনাকে এখন বলে এই ছবিটি হাতে আঁকা, বিশ্বাস করবেন? সত্যিই তাই। নাথান ওয়ালশ নামের একজন হাইপাররিয়েলিস্ট শিল্পী হাতেই এঁকেছেন এই ছবিটা। আর অত্যন্ত সুক্ষ হাতের কাজ দিয়ে ছবি আঁকা কিংবা ভাস্কর্য নির্মাণের শিল্পের এই ঘরানাটির নাম হাইপাররিয়েলিজম।
আধুনিক সময়ের ছবি আঁকা কিংবা ভাস্কর্য নির্মাণের একটি বিস্ময়কর ধরণ হল হাইপাররিয়েলিজম যেখানে অনেক বেশি রেজ্যুল্যুশনের কোনো ছবির আদলে ছবি আঁকা কিংবা ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। হাইপাররিয়েলিজম এর বাংলা হতে পারে অধিবাস্তবতা। হঠাৎ একটা এমন ধরনের ছবি দেখে আপনি বলে উঠতে পারেন ক্যামেরার কাজটা তো দারুণ হয়েছে! কিছুক্ষণ পর আবিস্কার করলেন, ছবিটা কারো হাতে আঁকা! ক্যামেরার কাজের মতই নিখুঁত ভাবে সত্যিকারের বাস্তব দুনিয়াকে আঁকা কিংবা গড়ার কাজটাই করেন হাইপাররিয়েলিজম মানে অধিবাস্তবতার প্রয়োগে দক্ষ শিল্পীরা।
হাইপাররিয়েলিজমকে বলা হয় ফটোরিয়েলিজম এর আধুনিকতম রূপ। ১৯৭০ এর দশকের শুরু থেকে হাইপাররিয়েলিজম শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের স্বাধীনচেতা শিল্প চর্চার আন্দোলনগুলোতে।
এই ধারার শিল্পচিন্তার শুরুটা হয় ফটোরিয়েলিজম দিয়েই। যদিও এই ‘ফটোরিয়েলিজম’ নামটা এসেছে ১৯৬৯ এর দিকে তবে তার অনেক আগেই এই ঘরানার শিল্পীরা তাদের কাজের মাধ্যমে একে প্রতিষ্ঠা করে চলেছিলেন। আবার ফটোরিয়েলিজমের ধারণাটি অনুপ্রাণিত হয়েছিল পপ আর্টের ধারণা থেকে।
১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটেনে এবং শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পপ আর্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠে শিল্প আন্দোলনের প্রকাশভঙ্গী হিসেবে। এডুয়ার্ডো পাউলোজি, রিচার্ড হ্যামিল্টন, রবার্ট রোশেনবার্গ আর জ্যাসপার জোনস এর মত শিল্পীরা গড়ে তোলেন এই আন্দোলন। চারুকলার চিরায়ত যে ধারা সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতেই পপ আর্টের জন্ম। সাধারণত বাস্তব পৃথিবীতে যেমন থাকবার কথা আশেপাশের যে কোনো কিছুর, সেগুলোর সাজানো পরিবেশটাকে বদলে দিয়ে কিংবা সম্পর্কহীন কয়েকটা বিষয়কে একসাথে একই ছবিতে রাখার কাজটা করা হত পপ আর্টের ক্ষেত্রে। যেমন ধরা যাক, আকাশের অনেক উঁচুতে একটা যাত্রীবাহী প্লেনে পাইলটের আসনে বসে আছে এক সিংহ, সামনের কন্ট্রোলিং প্যানেলে রাখা আছে একগাদা কমিকস বই আর পেছনে যাত্রীদের আসনে রাখা আছে অনেকগুলো কোকাকোলার বোতল, এমন অদ্ভুত সব বিষয় একসাথে এঁকে ওটাই হয়ে গেল একটা ছবি। বিশেষত বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকা হত পপ আর্টের ধারায়।
তো পপ আর্টের চিন্তাধারা থেকে অনুপ্রাণিত হল ফটোরিয়েলিজম ধারাটি। পপ আর্ট শিল্পীরা আন্দোলনটাকে চালিত করেন অনেকখানি অন্য দুটি ধারার প্রতি বিরোধিতার মনোভাব নিয়ে। এগুলো হল অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম বা বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদ আর মিনিমালিস্ট চিত্রকলার ধারা- দুটোরই চল শুরু হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। এই দুই ঘরানা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অন্য একদিন হবে আশা করি।
যাই হোক, ফটোরিয়েলিস্ট শিল্পীরা শুরু করলেন ক্যামেরায় তোলা ছবি থেকে সুক্ষ সব ডিটেইল নিয়ে সে অনুসারে ছবি আঁকা। ১৯৬০ সালের দিকে এই ধারাটা তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠল, বিশেষত তরুণদের মাঝে। আর অবধারিতভাবে শুরু হল এর ব্যাপক সমালোচনা, ছবি আঁকার কাজে ক্যামেরার সাহায্য কেন নেবেন শিল্পীরা- এ নিয়ে।
উনিশ শতকে ক্যামেরার আবিস্কার চিত্রশিল্পের উপর অনেকখানি প্রভাব ফেলেছিল। ক্যামেরায় তোলা ছবির বাস্তব রূপটার কারণে পোর্ট্রেট আঁকিয়ে শিল্পীদের কদর কমে যাচ্ছিল। আবার উনিশ ও বিশ শতকের অনেক শিল্পী ডিটেইলটা ভালোভাবে বোঝার জন্য ক্যামেরার ছবি দেখে সাহায্য নিলেও সেটা স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করছিলেন।
সারা পৃথিবীতেই শিল্পকলার আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছিল এই সময় ফটোরিয়েলিস্ট শিল্পীরা, কারণ তারা সরাসরি ক্যামেরায় তোলা ছবি থেকে দেখে ছবি আঁকাটাকেই একটি ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
১৯৩০ এর দশকে ব্যাপকভাবে প্রচলিত রিয়েলিজম বা বাস্তবতাবাদী ধারার শিল্পীরা অনেক সমালোচনার মুখে পড়েন ৫০ এর দশকে এসে। ফটোরিয়েলিস্ট শিল্পীরা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হতে থাকেন পপ আর্টের ধারা থেকে এবং সে অনুযায়ী তারাও ঐ অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম বা বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদ বিরোধী মনোভাব পোষণ করতে শুরু করেন।
পপ আর্ট আর ফটোরিয়েলিজম উভয় ঘরানার শিল্পীই ক্যামেরার ছবির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করা শুরু করলেন। বিশ শতকের মাঝের সময়টাতে এসে এর মাত্রাটা এতখানিক বেড়ে গেল, অনেক শিল্পবোদ্ধা আশংকা প্রকাশ করলেন, শিল্পকলায় কল্পনার যে কদর করা হয়েছে যুগ যুগ ধরে সেই কল্পনার মূল্যটাই মনে হয় কমে যেতে শুরু করেছে এভাবে বাস্তবতার হুবুহু অনুকরণ করতে গিয়ে। কারণ সময়ের সাথে সাথে ফটোরিয়েলিস্ট শিল্পীরা চেষ্টা করছিলেন আরও কত সুক্ষভাবে, আরও কত দক্ষতার সাথে একেবারে ক্যামেরার ছবির মতন বাস্তব ছবি আঁকা যায় সেটার।
ফটোরিয়েলিস্ট শিল্পীরা ছবি আঁকার জন্য কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করেন যেখানে তাঁদেরকে প্রয়োগ ঘটাতে হয় সর্বোচ্চ সতর্কতা আর শিল্পজ্ঞানের। সাধারণত শিল্পীরা ফটোগ্রাফিক স্লাইডে রাখা একটি ছবি থেকে তাদের ক্যানভাসে ছবিটিকে ফুটিয়ে তুলেন হাতের দক্ষতায়। আবার কেউ সেই স্লাইডটির প্রতিবিম্ব ক্যানভাসের উপর ফেলে তা থেকে ছবি আঁকেন।
আবার কেউ ব্যবহার করেন ‘গ্রিড টেকনিক’ মানে অনেকগুলো ছক কেটে সে অনুযায়ী প্রতিটি ছকের অংশ এঁকে এঁকে পুরো ছবিটা আঁকার পদ্ধতি। কখনও ঠিক আসল ছবির মাপেই আঁকা হয়, তবে সাধারণত আসলটির চেয়ে একটু বড় মাপের ছবি আঁকেন শিল্পীরা।
তবে এভাবে ছবি আঁকার জন্য কিন্তু শিল্পীর অসম্ভব সুক্ষতার চিন্তা, হাতের দক্ষতা, চারুকলার অনেক জটিল কৌশল যেমন ঠিক কোন কোন জায়গায় আলো পড়ছে আবার কোন কোন জায়গায় ছায়া তার যথাযথ চিত্রায়নের পদ্ধতি জানা এমন অনেকগুলো গুণের সম্মিলন থাকতে হয় অবশ্যই।
একেবারে প্রথম দিকের ফটোরিয়েলিস্ট শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন বেইডার, রিচার্ড ইস্টস, র্যালফ গোইংস, চাক ক্লোজ এবং ব্রিটেনে মাইক গোরম্যান, এরিক স্কট প্রমুখ শিল্পী। এঁরা সাধারণত ল্যান্ডস্কেপ, পোর্ট্রেট এবং মানুষের জীবনযাপন এই তিন ধরনের ছবি নিয়েই কাজ করতেন।
যদিও ফটোরিয়েলিজম শুরুতে কেবল চিত্রকলাতেই অনুসরণ করা হত, ডুয়ান হ্যানসন এবং জন ডিএনড্রিয়া’র মত ভাস্কররাও এর সাথে যুক্ত হয়ে গেলেন। তাঁরা ফটোরিয়েলিস্ট শিল্পীদের মত অবিকল ভাবে মানুষের ভাস্কর্য নির্মাণ করতে লাগলেন যেগুলোতে কৃত্রিম চুল আর পোশাক পরিয়ে দেয়া হত।
আমরা শুরু করেছিলাম হাইপাররিয়েলিজমের কথা দিয়ে। প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ফটোরিয়েলিজমকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে লাগল এক সময় দেখা গেল শিল্পীরা এমন ভাবে ছবি আঁকছেন যা ক্যানভাসে আঁকা যায় বলে কল্পনাই করা সম্ভব নয়। ক্যামেরার নতুন নতুন ডিজিটাল যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন ফটোরিয়েলিজমের কাজকে নিয়ে গেল অনন্য উচ্চতায়, এর নাম দেয়া হল হাইপাররিয়েলিজম।
২১ শতকের শুরুর দিকে ফটোরিয়েলিজম ঘরানার উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া হাইপাররিয়েলিজম এর ধারণাটি সময়ের সাথে সাথে পাকাপোক্ত হতে লাগল। মার্কিন শিল্পী ডেনিস পিটারসন যিনি ফটোরিয়েলিজমের কাজের জগতে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন, তিনিই প্রথম হাইপাররিয়েলিজম শব্দটি ব্যবহার করেন। কোনো কোনো আলোচনায় এর নাম দেয়া হয় সুপার রিয়েলিজম।
যাই হোক, ফটোরিয়েলিজমের ক্ষেত্রে সাধারণত শিল্পীরা যেটা করতেন, ক্যামেরার ছবির বরাবর চিত্রায়নের চেষ্টা, হাইপাররিয়েলিস্ট চিত্রশিল্পী ও ভাস্করেরা তার থেকে কিছুটা ভিন্নভাবে কাজ করেন। তাঁরা ক্যামেরার ছবিকে ডিটেইল এর একটা উৎস হিসেবে নিয়ে ক্যানভাসের ছবিতে এমন ভাবে আঁকেন যেটা ছাড়িয়ে যায় সত্যিকারের ছবিকেও। ব্যাপারটাকে তুলনা করা যায় অনুবাদের সাথে। যদি বলি ফটোরিয়েলিজমের যুগে শিল্পীরা একটি ভাষা অর্থ্যাৎ ক্যামেরার ছবি থেকে আরেকটি ভাষা অর্থ্যাৎ ক্যানভাসের ছবিতে আক্ষরিক অনুবাদ করতেন, তাহলে বলা যাবে হাইপাররিয়েলিজমের যুগে এস শিল্পীরা করছেন ভাবানুবাদের কাজ। তার মানে, ক্যামেরার ছবিতেও যতটুকু সুক্ষ কাজ আপনার চোখে পড়বে না তার চেয়েও বেশি পড়বে হাতে আঁকা ছবিতে!
ফটোরিয়েলিস্ট শিল্পীরা তাদের কাজটা কিছুটা ‘ছবিসুলভ’ রাখার জন্য প্রায়ই মানবিক আবেগ, রাজনৈতিক চেতনা, আবহ ইত্যাদি সুক্ষ বিষয়গুলো ছবি আঁকার সময় বাদ দিতেন। ছবিটাকে অনেকটা সরল চোখে যা দেখছি তারই বরাবর চিত্রায়ণ হিসেবে রাখতেন তাঁরা।
অন্যদিকে বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জঁ বদ্রিয়াঁর চিন্তাধারা হয়ে দাঁড়ায় হাইপাররিয়েলিজমের একটি অনন্য ভিত্তি। এমন কিছুর অনুভূতি দেয়া যেটার আসলে কখনও অস্তিত্বই ছিল না- এমন দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন বদ্রিয়াঁ। হাইপাররিয়েলিজম ঘরানার শিল্পীরা শুরু করলেন তাঁদের আঁকা ছবির মধ্য দিয়ে এমন অনুভূতি দেয়ার চেষ্টা। বাস্তব পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব, জীবন যাপনের ধরণ, চিন্তা চেতনার প্রকাশ, আবেগ-অনুভূতি এমন সব কিছু মিলিয়ে তাঁদের ছবিগুলো এতটাই বাস্তব, দেখে মনে হবে এই ছবিটা এত জীবন্ত কেন! মানে তাঁরা যেটা করেন সেটা হল ক্যানভাসে আঁকা ছবির মধ্যে দিয়ে বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে কল্পনার ইল্যুশন তৈরি, একটা চোখ ধাঁধানো বাস্তব!
হাইপাররিয়েলিস্ট শিল্পীদের ডেনিস পিটারসন, গটফ্রিড হেলেনউইন, নেস্তর লেইনেস, চাক ক্লোজ, বার্ট মনরয়, রন মুয়েক, পল ক্যাডেন, রবার্তো বার্নারডি, হুয়ান ফ্রান্সিসকো ক্যাসাস, দিয়েগো ফ্যাজিও এমন অনেকের নাম নেয়া যায় যাঁরা ছবি আঁকা আর ভাস্কর্যকে নিয়ে গেছেন মানুষের কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে। চলুন তাহলে দেখি এমন কিছু ছবি যেগুলো দেখে আপনিই ঠিক করবেন এগুলো ক্যামেরার কাজ নাকি হাতের স্পর্শে আঁকা কিংবা গড়ে ওঠা।