বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ মানেই আনন্দের ও উৎসবের এক বিশাল মেলা। একদিকে বড়দিনের আনন্দ, অন্যদিকে নতুন বছরকে বরণ করার খুশি। বাসা-বাড়ি নতুন করে সাজানো, একটু আরাম-আয়েশ আর পরিবার-পরিজন এবং বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে করতেই চোখের পলকে কেটে যায় গোটা সপ্তাহ। আর চলে আসে নতুন বছরে একগাদা কাজের ধকল। সংস্কৃতি ও উৎসব পালনের কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও আনন্দ ও আরাম-আয়েশের ব্যাপারটায় কিন্তু কেউ কোনো কার্পণ্য করে না।
যেমন- জাপানের কথাই একটু বলা যাক। আপনি যদি জাপানী কার্টুন কিংবা সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন, তাহলে আপনি একটি জিনিস অবশ্যই খেয়াল করেছেন। জাপানী নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার জন্য এক বিশাল সাইজের ঘণ্টা বাজায়। আপনি কি জানেন এই ঘণ্টা বাজানোকে কী বলা হয়? কেন বা কতবার বাজানো হয় এই ঘণ্টা সেটা কি জানেন? চলুন আজকে তাহলে জাপানীদের এই ব্যতিক্রমী উৎসব সম্পর্কে জানা যাক।
জোয়া নো কেন
প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বরের রাতে জাপানের রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর থাকে এক অনন্য সাজে সজ্জিত। জাপানীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘কিমোনো’ ও ‘হাকামা’ পরে নতুন বছর আগমনী অনুষ্ঠান উদযাপনে নেমে পড়ে।
বিভিন্ন মন্দিরে তাদের ঐতিহ্যবাহী ঘণ্টা ‘বোনশো’ বাজানো হয়। একে ‘সুরিগ্যান’ও বলা হয়। জাপানে অনেক সময় একে ‘ওয়াকেন’ও বলে। এই বোনশো মূলত ব্রোঞ্জের তৈরি বিশাল আকৃতির ঘণ্টা, যা মন্দিরের কাছেই বিশেষভাবে তৈরি একটি টাওয়ার ‘শোরো’তে রাখা হয়। আর এই ঘণ্টা বাজানোর জন্য সাধারণত ব্যবহার করা হয় কড়িকাঠের তৈরি একটি বড়সড় দণ্ড। পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করে নিতে এই বোনশো বা সুরিগ্যান নামক ঘণ্টা মোট ১০৮ বার বাজানো হয়। এর মধ্যে ১০৭ বার ৩১ ডিসেম্বরের রাতে এবং একবার ঠিক রাত ১২টা বাজার পর বাজানো হয়। জাপানে এই ঐতিহ্যকে ‘জোয়া নো কেন‘ বলা হয়। এখানে ‘জোয়া’ মানে নতুন বছর।
জাপানীরা গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করার আগে নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী ‘টেনডো’ বর্ষপঞ্জি অনুসারে নতুন বছর পালন করত। গ্রেগরিয়ান তথা বর্তমান বর্ষপঞ্জি গ্রহণের ফলে অনেক ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে গেলেও জোয়া নো কেনের মতো কিছু প্রথা রয়েই গেছে। প্রায় রাত ১১টা থেকে জাপানের প্রায় সকল মন্দিরেই এই কার্যক্রম শুরু করা হয়, যা রাত ১২টা অবধি চলতে থাকে। শীতের আকাশে ‘বোনশো’র প্রতিটি শব্দ প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করে। প্রকৃতিও যেন নতুন এই বর্ষকে বরণ করে নেওয়ার স্বীকৃতি দিয়ে দিল। জাপানের যেকোনো ছোট-বড় মন্দিরেই এই উৎসবের উচ্ছ্বাস ও জাঁকজমক ভাব লক্ষ্য করতে পারবেন। বিশেষ করে জাপানের রাজধানী টোকিওতে এ সময় একটি রমরমা পরিবেশ বিরাজ করে।
এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, কেন ১০৮ বার এই বোনশো বাজানো হয়? কেন এর বেশি বা কম নয়? কিংবা কারা এই ঘণ্টা বাজানোর উপযোগী?
প্রথমেই ১০৮ বার বাজানোর বিষয়টি একটু খুলে বলি। তবে এর আগে একটু বলে নিই, এই ১০৮ সংখ্যাটি বৌদ্ধধর্মে কীভাবে আসলো। এই সংখ্যাটি মূলত ৬, ৩, ২ ও ৩ কে একত্রে গুণ করে এসেছে। অর্থাৎ ৬×৩×২×৩ = ১০৮। এখানে ‘৬’ দ্বারা মানুষের ছয়টি ইন্দ্রিয় এবং ‘৩’ দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলোর মাধ্যমে ঘটে যাওয়া কোনো কিছু বেদনাদায়ক, সুখকর নাকি নিরপেক্ষ, ‘২’ দ্বারা ঘটনাগুলো বা অভিজ্ঞতাগুলো সাধ নাকি অসাধের এবং ‘৩’ দ্বারা তিন কাল (অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত) বোঝানো হয়।
‘জোয়া নো কেন’-এ এই ১০৮ এর বিষয়টি এবার একটু খুলে বলি। ধারণা করা হয় যে, প্রথম ১০৭টি ধ্বনি সকল অপ্রয়োজনীয় ও অপবিত্র অনুভূতি দূর করে এবং ঘণ্টায় দেওয়া সর্বশেষ আঘাতের মানে হলো পুরনো সকল সমস্যা ও দুঃখ-কষ্ট এখানেই ভুলে যাও এবং নতুন বছরকে আপন করে নাও। অবশ্য এই বোনশো বাজানোর পেছনে অনেকের অনেক ধরনের মতামত ও ধারণা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি ধারণা সবথেকে বেশি প্রচলিত আছে।
১. ‘বোননো’ অপসারণ করা
জাপানে ‘বোননো’ বলতে মানুষের অপ্রয়োজনীয় ও অপবিত্র কিছু অনুভূতি ও কর্মকাণ্ড, যেমন- মিথ্যা বলা, লোভ, প্রতারণা করা, শত্রুতা, রাগ, অহংকার, কামলালসা, জেদ, হতাশা, নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার করা, ধর্মনিন্দা, বিদ্রুপ করা, ঘৃণা করা ইত্যাদি বোঝায়। আর বৌদ্ধধর্ম মতে, একজন মানুষের জীবনে এরকম ১০৮ ধরনের অভিলাষ ও অপবিত্রতা থাকে, যা তাকে যতটা সম্ভব পরাভূত করতে হবে। এগুলোকে একত্রে ‘দ্য ১০৮ ডেফাইলমেন্টস অফ বুদ্ধিসম’ (The 108 Defilements Of Buddhism) বলা হয়।
বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, এসকল অনুভূতি ও কর্মকাণ্ডই সুখী জীবনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে। তাদের মতে, এই প্রথা অনুসরণ করার ফলে এসকল অকাম্য আবেগকে দূর করা সম্ভব। এই বোনশো যারা বাজাবে এবং যারা শুনবে সকলেই পাপমুক্ত হবে এবং তাদের আত্মা নতুন করে বিশোধিত হয়ে যাবে।
২. শিকু হাক্কু
‘শিকু হাক্কু’ তত্ত্বানুসারে প্রত্যেক মানুষের জীবনে ৮টি অবশ্যম্ভাবী বিপত্তি থাকে, যা কোনো মানুষের পক্ষেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। জাপানিজ ভাষায় ‘শি’ মানে চার, ‘কু’ মানে ক্লেশ/ভোগান্তি এবং ‘হাচি’ মানে আট। অর্থাৎ ‘শিকু হাক্কু’ মানে চার ভোগান্তি, আট ভোগান্তি।
‘শিকু’ দ্বারা চারটি প্রধান ভোগান্তি, যেমন- জন্ম, বার্ধক্য, অসুস্থতা, মৃত্যু বোঝানো হয়। আর ‘হাক্কু’ দ্বারা আরও চারটি ভোগান্তি, যেমন- আপনজনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া, কোনো খারাপ মানুষের সাথে দেখা হওয়া, এমন কোনো জিনিসের প্রত্যাশা করা যা কখনও পাওয়া সম্ভব নয়, মন ও দেহ গঠনকারী পাঁচটি মূল উপাদানের যেকোনোটি দ্বারা সৃষ্ট কোনো সমস্যাকে বোঝায়। এই তত্ত্বটি দ্বারা মূলত বোঝায় এই আটটি বিপত্তি দূর করার জন্যই ১০৮ বার বোনশো বাজানো উচিত।
উল্লেখ্য, এখানে মন ও দেহ গঠনকারী পাঁচটি মূল উপাদান বলতে দৈহিক গড়ন, উপলব্ধি, ধারণাশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও চেতনাশক্তিকে বোঝায়।
এবার কারা বাজাতে পারবে তা সম্পর্কে একটু বলি। ‘জোয়া নো কেন’ এর প্রথাটি বহুকাল থেকেই চলে আসছে। জাপানের বিভিন্ন মন্দিরে বিভিন্ন নিয়ম প্রচলিত আছে এ বিষয়ে। তবে বেশিরভাগ মন্দিরে সেখানকার সন্ন্যাসীরাই মূলত বোনশো বাজানোর দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অবশ্য কিছু কিছু মন্দিরে সাধারণ জনগণও এই সুবর্ণ সুযোগ লাভ করতে পারে। এক্ষেত্রে লাইনে দাঁড়ানো কিংবা টিকেট ক্রয় করা প্রথম ১০৮ জন এই সুযোগ লাভ করেন। আর কোনো ব্যক্তিকে একবারের বেশি বাজানোর সুযোগ দেওয়া হয় না।
ছোট ছোট মন্দিরে খুব সহজে বাজানোর সুযোগ পাওয়া গেলেও বড় বড় মন্দিরে এই সুযোগ পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। আবার এই সুযোগ পাওয়ার জন্য বেশ টাকাও গুণতে হয় এসকল বড় বড় মন্দিরে। মন্দির পরিদর্শনে আসা এসকল অভ্যাগতদের জাপানী ভাষায় ‘সানপাইশা’ বলা হয়। আবার অনেক মন্দিরে বোনশো আকারে এত বড় থাকে যে একজনের পক্ষে তা বাজানো সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে প্রায় বারো বা এর অধিক সংখ্যক সদস্য মিলে একটি দল গঠন করে এটি বাজানো হয়। যেমন- তোদাজি ও চিওন-ইন মন্দিরের এই বোনশো আকারে এত বড় থাকে যে তা বাজানোর জন্য প্রায় ১৭ জন সন্ন্যাসীর একটি দল গঠন করে নেওয়া হয়।
আপনি যদি জাপানের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ভালো করে বুঝতে ও দেখতে চান, তাহলে এর সবচাইতে উপযুক্ত পন্থা হলো নতুন বর্ষবরণের এই অনন্য উৎসব ‘জোয়া নো কেন’ এ অংশগ্রহণ করা।
ফিচার ইমেজ: pinterest.com