Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাব্বালাহ: ইহুদি অতীন্দ্রিয়বাদের আদ্যোপান্ত

কাব্বালাহ শব্দটি হিব্রু ‘কাবাল’ থেকে উৎসারিত। যার অর্থ গ্রহণ করা। ত্রয়োদশ শতকের দিকে ইহুদি অতীন্দ্রিয়বাদের প্রধান পরিভাষা ছিলো এই কাব্বালাহ। মূখ্যত তাদের আলোচনা কয়েকটা বিষয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। প্রথমত, পৃথিবীর সৃষ্টি ও ঈশ্বরের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা, পরম সত্যের রূপক উত্থাপন, ধর্মীয় জীবনের অলৌকিকতা অনুসন্ধান এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবন আলোচিত হয়েছে বিশেষভাবে। দ্বিতীয়ত, স্বর্গীয় নামগুলোর মধ্য দিয়ে কীভাবে অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়, পূরণ করা যায় জীবনের প্রধানতম উদ্দেশ্য- বাতলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে তার উপায়। তারপরেও ঢালাওভাবে গোটা ইহুদি অতীন্দ্রিয়বাদকে কাব্বালাহ বলে আখ্যা দেয়া হয়। সে যা-ই হোক, প্রকৃতপক্ষে সকল সংস্কৃতি ও ধর্মের ভেতর যে অতীন্দ্রিয় দিক রয়েছে, কাব্বালাহ তার ইহুদি রূপ। ঈশ্বরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ এবং নৈকট্য লাভের চর্চা, সাধারণ যুক্তিগ্রাহ্য জ্ঞানে যা সম্ভব না।  

কাব্বালাহ: মূলধারাকে বদলে দেয়া এক স্রোতের নাম © kabbalahrock.bandcamp.com

গুপ্ত সংস্কৃতি হলেও কাব্বালাহ আধুনিক যুগ পর্যন্ত বেশ জনপ্রিয় হিসাবে পরিগণিত। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ইহুদি ধর্মকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে কাব্বালাহ। ফেলে যাচ্ছে এখন অব্দি। এমনকি অইহুদিদের উপরও এর প্রভাব ছিলো উল্লেখযোগ্য।

বাইবেলিয় উৎস

হিব্রু বাইবেলে স্পষ্ট করে অতীন্দ্রিয়বাদকে উল্লেখ করা হয়নি। তথাপি অলৌকিক ঘটনার প্রাচুর্য বিদ্যমান। মোজেসের (হযরত মুসা (আ)) হাতের লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, ইয়াকুবের (আ) দৃষ্টিশক্তি প্রাপ্তিসহ পুরো বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীর ঐতিহ্য অতীন্দ্রিয়বাদকে প্রভাবিত করেছে। সবচেয়ে প্রভাবশালী বলে প্রতীয়মান হয়েছে এজেকিয়েলের ঈশ্বরের সিংহাসন-রথ দর্শন।

এজিকিয়েলের দর্শন কাব্বালাহর অন্যতম অনুপ্রেরণা, © wikiart.org

বিষয়টা পরাবাস্তব এবং ঈশ্বরের মানবীকরণের মতো বিপজ্জনক দিকে নিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তথাপি প্রথমদিকের দুটি ঐতিহ্যের জন্মলাভে এর ভূমিকা ছিল। প্রথমটি ‘মাসেহ হা-মেরকাবাহ’ বা রথের কাজ এবং দ্বিতীয়টি ‘মাসেহ বেরেশিত’ বা সৃষ্টির শুরুর কাজ।

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

কাব্বালাহর প্রথম লিখিত সূত্র পাওয়া যায় ফ্রান্সের প্রোভ্যান্সে। লেখাগুলো দ্বাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের। একদল হালাখি লেখকের দ্বারা যাত্রা শুরু। আব্রাহাম বেন ডেভিড, জ্যাকব দ্য নাজিরাইটের মতো সুপরিচিত ব্যক্তিরা। পরবর্তীতে যুক্ত হয় মোজেস নাহমানাইডস এবং তার প্রধান ছাত্র শেলোমাহ বেন আব্রাহামের নাম। যদিও কাব্বালাহর অজস্র লেখার ভিড়ে তাদের অংশ ক্ষুদ্রই। ছোট্ট পরিসরে অভিজাতদের মধ্যে গোপনে চর্চা হতো প্রথমদিকে। ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার দিকে গোপনীয়তা দূর হতে থাকে। এই সময়ের পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন ইতশাক সাগি নাহর, আব্রাহাম বেন ডেভিড, আশের বেন ডেভিড প্রমূখ। তাদের লেখার প্রচেষ্টা ও বিষয়বস্তু লক্ষণীয়। ‘সেফের ইয়েতজিরাহ’ নামে সৃষ্টিতত্ত্ব, ‘মাসেহ বেরেশিত’ বা সৃষ্টি নিয়ে বাইবেলের মত এবং টেন কমান্ডমেন্টের ব্যাখ্যা তাদের মধ্যে উল্লেযোগ্য। 

সেফের ইয়েতজিরাহ সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক প্রথমদিকের প্রচেষ্টা © store-us.kabbalah.com

ত্রয়োদশ শতকের মধ্যভাগে স্পেনে কাব্বালিস্টদের মধ্যে চিন্তার বিপ্লব আসে বলতে গেলে। এদের পথিকৃৎ ছিলেন আজরিয়েল এবং ইয়াকুব বেন শেশেত। আস্তে আস্তে কাতালোনিয়া থেকে ক্যাস্টাইলের দিকে প্রভাব ভারী হতে শুরু করে। ক্যাস্টাইলে অজ্ঞাত কাব্বালিস্টদের লেখা পাওয়া যায় ‘ইয়য়ুন’ নামে। এটি আসলে মেরকাভাহ সাহিত্যকে নব্য প্লেটোবাদী অতীন্দ্রিয় ধারণার সাথে সমন্বয় আনার প্রচেষ্টা। অন্য অংশ অশুভের ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় আগ্রহী ছিল। অশুভ জগৎ নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করে গেছেন ইয়াকুব, ইতশাক, মোশেহ, তদ্রোস আবুল আফিয়া প্রমূখেরা। স্পেনীয় এই ঘরনার সবচেয়ে বিশুদ্ধ প্রকাশ ঘটেছে যোহার-তে। এটি মূলত ক্যাস্টালিয়ান কাব্বালিস্টদের লেখার সংকলন, যা ১২৮০ সালের দিকে শুরু হয়েছিলো। ১২৮৫ থেকে ১৩৩৫ সালের মধ্যে যত অনুবাদ, ব্যাখ্যা এবং প্রতিলিপি তৈরি করেছে, তাতে যোহারকে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবেই নেয়া হয়েছে। 

যোহার পরিণত হয়েছিলো প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে © haaretz.com

স্পেনে ইহুদিদের স্বর্ণযুগ ছিল মূলত মুসলিম শাসকদের আমলে। ধীরে ধীরে মুসলমানরা স্পেনের অধিকার হারাতে থাকে। নতুন ক্যালিক শাসক সবার আগে ইহুদিদের উপর খড়গহস্ত হন। হয় ধর্মান্তর, নাহলে দেশত্যাগ।  ১৪৯২ এবং ১৪৯৭ সালে স্পেন এবং পর্তুগাল থেকে সমূলে বের হয়ে যায় ইহুদিরা। ফলে আইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে সরে গিয়ে উত্তর আফ্রিকা, ইতালি ও লেভ্যান্টের দিকে চলে আসে কাব্বালিস্টদের চর্চা। শিকর গজাতে শুরু করে নতুন অঞ্চলে। বিকাশমান কাব্বালাহ সমাজে পনের শতকের স্পেনের কাব্বালাহ চর্চা বিশেষ করে যোহার দারুণ প্রভাবক হিসাবে গৃহীত হয়। ষোল শতকের দিকে এদের প্রথম প্রজন্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইতালিতে ইয়াহুদাহ হায়্যাতের ‘মিনহাত ইয়েহুদাহ’ এবং অটোম্যান সাম্রাজ্যে মেইর ইবন গাব্বাইয়ের ‘আভোদাত হাকো-দেশ’। স্পষ্টভাবে দেখা যায় স্পেনিয় লেখা সংকলনের প্রবণতা। চেষ্টা করা হয়েছে দর্শন, জাদু এবং কাব্বালাহকে মেলানোরও।

নির্বাসনের পরে ফিলিস্তিনেও বাড়তে থাকে তারা। ষোল শতকের গোড়ার দিকে জেরুজালেম ছিলো কাব্বালাহ শেখার উর্বর ভূমি। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ইয়াহুদাহ আল বতিনি, ইয়োসেফ ইবনে সাইয়াহ, এবং আব্রাহাম বেন এলিয়েজের। ১৫৪০ এর দশকের শুরুর দিকে গ্যালিলিয়ান গ্রাম সাফাদ হঠাৎ আধিপত্য শুরু করে। অর্ধশতক ধরে সাফাদ ছিলো কাব্বালাহ চর্চায় অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাছাকাছি সময়ে তুরস্কে দুজন প্রধান চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে। ইয়োসেফ কারো এবং শেলোমাহ হা-লেভি আলকাবেতস। তারা অতীন্দ্রিয়বাদী একটা সংঘ চালনা শুরু করলেন, যা মূলত কাব্বালিস্টদের কর্মাদি পালন করতো। ইয়োসেফ কারোর অতীন্দ্রিয় দিনপঞ্জি এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ।

সে যা-ই হোক, ফিলিস্তিনে সবচেয়ে প্রভাবশালী কাব্বালিস্ট ছিলেন মোশেহ কর্ডোভারো (১৫২২-১৫৭০)। ১৫৪৮ সালে তিনি তার গুরুত্বপূর্ণ লেখা ‘পারদেস রিমোনিম’ সামনে আনেন। পূর্বের সকল প্রকার কাব্বালাহ মতবাদকে পরিষ্কার ভাষায় উপস্থাপন করার জন্য তার প্রচেষ্টা গোটা শতককে অনুরিত করেছে। কর্ডোবারোর প্রধান শিষ্য ছিলেন হায়্যিম ভিতাল, এলিয়্যাহু দি ভিদাস এবং এলাযার আযিকরি। কর্ডোবারোর মৃত্যুর পর তার সাবেক শিষ্য আইজ্যাক লুরিয়া হঠাৎ করে সাফাদের কাব্বালাহ সমাজের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন। তার ব্যক্তিত্ব, দরবেশি আচরণ এবং ধর্মের ব্যাখ্যা নতুন সৃষ্টি করে। লুরিয়া সাধারণত মুখে ব্যাখ্যা প্রদান করতেন। তার মতবাদের প্রভাব ছিলো সুদূরপ্রসারী। কর্ডোবারোর শিষ্যরা ব্যাপকভাবে তার ধর্মতত্ত্বকে মেনে নিলো। এই মতবাদ স্বীকৃত হলো সবার সেরা হিসাবে। 

লুরিয়ার ব্যাখ্যা দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে তার পরবর্তী যুগে © kabbalah.com

১৫৭২ সালে মৃত্যুবরণ করলেন লুরিয়া। শিষ্য হায়্যিম ভিতাল তার মতবাদ লেখার জন্য এগিয়ে এলেন। তার বিখ্যাত রচনা ‘এতস হায়্যিম’ বা ট্রিজ অব লাইফ। লুরিয়ার মতবাদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন মত ১৫৯০ এর দিকে ইতালিতে প্রচারিত হয়েছে। প্রচারক ইসরায়েল সারুগ নিজেকে লুরিয়ার শিষ্য বলে দাবি করতেন। মতবাদের সবচেয়ে বড় ব্যাখ্যাকার মেনাহেম আজরাইয়া। অপর শিষ্য আব্রাহাম হেরেরা তার লেখা গ্রন্থ ‘শা’আর হা-শামায়িন’ এবং ‘বেইত এলোহিম’ তে নব্য প্লেটোবাদী দর্শনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। নব্য প্লেটোবাদী এবং পরমাণুবাদী ধারণা একসাথে এসেছে ইয়োসেফ শেলোমাহ ডেলমেডিগো এবং সারুগের অন্যান্য শিষ্যের লেখায়। সপ্তদশ শতকের দিকে ভিতাল এবং সারুগের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। কাব্বালিস্টদের মধ্যে ভিতালের মতবাদ টিকে থাকে শেমুয়েল ভিতাল, মেইর পপার এবং ইয়াকুব সেমাহের সংকলনে। পরের শতকগুলোতে কর্ডোবারিয়ান এবং লুরিয়ানিক মতবাদের মিশেল ঘটে।

অষ্টাদশ শতকের ধর্মতত্ত্বে পোলিশ হাসিদিজমে কর্ডোবারো মতবাদের কিছুটা পুনর্জাগরণ ঘটে। বিশেষ করে উপাসনা নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি, যেগুলোতে লুরিয়ানিক কাব্বালিস্টরা যথাযথ উত্তর দিতে অসমর্থ ছিল। অষ্টাদশ শতকের প্রধান কাব্বালিস্টদের মধ্যে এলিজাহ বেন শেলোমোন জালমান অন্যতম। তিনি পরিচিত গায়োন অব ভিলনা (১৭২০-১৭৯৭) নামে। লুরিয়ানিক ঐতিহ্যকে সামনে নিতে ইয়াকুব এমদেন (১৬৯৭-১৭৭৬)– এর ভূমিকাও ব্যাপক।

উনিশ শতকের দিকে এই ধারার অন্যতম উত্তরসূরী ইতশাক এইজিক হাভের এবং শেলোমোহ এলায়শার। আধুনিক সময়ে কাব্বালিস্টদের মধ্যে সবচেয়ে আধিপত্য বিস্তারকারী ধারা লুরিয়ানিক ধারা। এটি পাঠ করা হয় মোশেহ হায়্যিম লুয্যাত্তো, এলিয়্যাহু বেন শেলোমোহ জালমান, হাবাদ প্রমূখের প্রদত্ত ব্যাখ্যার আলোকে। তার সাথে আছে জেরুজালেমের বেইত এল একাডেমির সেফারদিক কাব্বালিস্টরা। আব্রাহাম ইতশাক কুক (১৮৬৫-১৯৩৫) একটা অতীন্দ্রিয় ও সর্বেশ্বরবাদী ধারণার অবতারণা করেন আধুনিক অনেক ইহুদিদের ধর্ম নিরপেক্ষতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য। তার মতবাদের প্রভাব ছিলো দারুণ। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার পর এবং বিশেষভাবে ১৯৬৭ এর পর প্রবল হয় তার পুত্র ইয়াহুদাহ কুকের মাধ্যমে। ডেভিড হা কোহেন এই অভিযাত্রায় অন্যতম প্রধান পুরুষ। তিনি তার ‘কুল হা-নেভুয়াহ’-তে অন্যরকম অতীন্দ্রিয়দের উন্মেষ ঘটান, যা ইহুদি ঐতিহ্যের মৌখিক দিককে প্রভাবিত করে। হাসিদিক সার্কেলে আবুল আফিয়ার গূঢ় কাব্বালাহ সাম্প্রতিক সময়ে উদঘাটিত হচ্ছে। 

আধ্যাত্মিকতার স্রোতে নতুন মাত্রা দেন কুক © orot.com

বর্তমানে কাব্বালাহ অন্যতম জনপ্রিয় চর্চা হিসাবে ইহুদি, এমনকি অইহুদিদের মধ্যেও টিকে আছে।

কাব্বালাহ ধর্মতত্ত্ব

তালমুদ এবং মিদরাশ দুই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ গুণের কথা বলে। প্রথমত ক্ষমা বা মিদ্দাত হা রাহামিম এবং দ্বিতীয়ত কঠোর বিচার বা মিদ্দাত হা দিন। গুণগুলো স্বর্গীয়। পৃথিবীর জন্ম এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। অন্যান্য পুস্তকে দশটি সৃজনশীল শব্দের (মা-আমারুত) কথা বলা হয় এই প্রেক্ষাপটে। সেফের ইতসিরাহতে দশটা সেফাইরত প্রসঙ্গ এসেছে। মেরকাবাহ সাহিত্যে আছে প্লেটোবাদী ধ্যানধারণার চিহ্ন। প্রথমদিকে তেমন কোনো ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কাব্বালিস্টদের থেকে পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগই স্বর্গীয় সত্তাকে দুটি স্তরবিশিষ্ট বলে ধারণা করতো। প্রথমত, পরম দেবতা বা এইন সফ, এবং দ্বিতীয়ত, নিঃসৃত জগৎ যা পরম সত্তা থেকে স্বতস্ফুর্তভাবে নিঃসৃত হচ্ছে। এমন দশটি দশা পরিচিত সেফাইরত নামে। যুহর এবং প্রধান কাব্বালিস্টদের অভিমত অনুসারে, সেফাইরত পরম সত্তার মূলের প্রকাশ। আবার কারো মতে, স্বর্গীয় সক্ষমতা ধারণের জন্য সেফাইরত পাত্রের কাজ করে। 

সেফাইরত ব্যাখ্যা করে সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে, © deliriumsrealm.com

মানুষের অলৌকিকতা

কাব্বালিস্টদের মতে, মানুষ তার সঠিক চর্চার মধ্য দিয়ে পরম সত্তার অন্তঃস্থলকে প্রভাবিত করতে পারে। তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচীন ইহুদি চিন্তায় সত্যিই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমদিককার তালমুদ ও মিদরাশে দেখা যায় ঈশ্বর প্রায়ই মোজেসের কাছে অনুরোধ করেন। লুরিয়ানিক কাব্বালাহতে এই জোরারোপ পরিবর্তিত হয়েছে স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গ নামে। সে যা-ই হোক, জাদু আর কাব্বালিস্টদের অলৌকিকতার ধারণায় বিস্তর ফারাক আছে। মানুষকে শক্তিশালী এবং স্বাধীন সত্তা হিসাবে উপস্থাপনের পরও স্রষ্টা ও মানুষের মধ্যে ব্যবধান থাকে। এখান থেকেই জন্ম নিয়েছে কাব্বালিস্টদের unio mystica বা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে স্বর্গীয় মিলনের ধারণা। 

মানুষকে স্বাধীন ও শক্তিশালী হিসাবে উপস্থাপন করাটা ছিলো যুগান্তকারী, © tumblr.com

অতীন্দ্রিয় পদ্ধতি

ত্রয়োদশ শতকের দিকেই অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কাব্বালিস্টদের বেশ কিছু লেখা পদ্ধতি প্রচারিত হয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল আব্রাহাম আবুল আফিয়া (১২৪০-১২৯১)। স্বর্গীয় নাম স্মরণের মধ্য দিয়ে তিনি চিন্তাকে একত্রিত করার কথা বলেন। পরবর্তীতে তার পদ্ধতি কিছুটা বিবর্তন ঘটিয়ে গ্রহণ করেন আশকেনাজিক হাসিদিক গুরুরা। খুব সম্ভবত আবুল আফিয়া সুফীবাদ এবং ভারতীয় যোগ-এর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তার লেখাগুলো ল্যাটিনে অনুদিত হয়, যা পরবর্তীতে খ্রিষ্টান কাব্বালাহ গঠনেে প্রভাব ফেলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে তার চর্চা বিনা শর্তে গ্রহণ করেন ইতশাক বেন শেমুয়েল এবং ইয়েহুদাহ আলবোতিনি। বিশেষ করে ফিলিস্তিনে আবুল আফিয়ার মতো মুসলিম সুফি ইবনুল আরাবির চিন্তার সাথে মিলিয়ে গ্রহণ করা হয়। ইউরোপ এভাবেই কাব্বালাহর সাথে পরিচিত হয়। 

আবুল আফিয়া অতীন্দ্রিয় চর্চায় পথিকৃৎ © jewishboston.com

কাব্বালাহ ব্যাখ্যার ধরন

পবিত্র গ্রন্থকে ব্যাখ্যা করার জন্য দুই ধরনের পদ্ধতি চালু হয় তাদের মাঝে। রূপক এবং গাণিতিক। অলৌকিকতাবাদী ও অতীন্দ্রিয়বাদী কাব্বালিস্টদের মধ্যে রূপক পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করার অবস্থান ছিলো সবার উপর। ধর্মগ্রন্থ যেখানে গণ্য হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবর্তন এবং ইতিহাসের ঘটনার আলোকে। এভাবে সীমাবদ্ধ বর্ণের সমাহার পরিণত হয়েছে অসীম অর্থের আধার হিসাবে। আশকেনাজিক হাসিদিজমের প্রভাবে ত্রয়োদশ শতকে কাব্বালিস্টরা গাণিতিক ব্যাখ্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে। গিমাতরিয়া বা বর্ণসমূহের গাণিতিক মান বের করা, নোতারিকোন বা বর্ণকে পুরো শব্দের সংক্ষেপ হিসাবে ব্যবহার করা এবং তেমুরাহ বা বর্ণের পারস্পারিক পরিবর্তন। আবুল আফিয়া সাত ধরনের গাণিতিক পদ্ধতির অগ্রগতি সাধন করেন, যা পরবর্তিতে নতুন পথ উন্মোচন করে। 

গাণিতিক ব্যাখ্যার জন্য বর্ণের গাণিতিক মান, © bq.blakearchieve.org

লেখালেখি

ইহুদিদের অন্য অংশের মতো কাব্বালিস্টরাও ধর্মীয় গ্রন্থাদির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছে। সাধারণ সেফরুতের উপর কাব্বালিস্টদের দেড়শোরও বেশি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বিশেষভাবে দশটা স্বর্গীয় সম্ভাব্যতা রূপকসহ আলোচিত হয়েছে। নবীশদের জন্য এগুলো পাঠ্য হিসাবে ব্যবহার করা হতো। ত্রয়োদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে এই ধারা বিকাশ লাভ করে। শুরু থেকেই তাদের ভেতর টেন কমান্ডমেন্ট ব্যাখ্যা এক অন্যমাত্রা নিয়ে এসেছে। সেফের ইতজিরাহ, যোহার এবং নৈতিক অন্যান্য প্রধান গ্রন্থাবলির ব্যাখ্যাও জন্ম লাভ করতে থাকে, যার স্রোত এখন পর্যন্ত বিদ্যমান। 

টেন কমান্ডমেন্ট-এর ব্যাখ্যা নিয়ে ছিল বিস্তর চিন্তা, ©  amazon.in

সবিশেষ

নাহমান ক্রোচমালের মতলতো আধুনিক পন্ডিতের কেউ কেউ দাবি করেন, কাব্বালাহর উপর নস্টিক ধ্যানধারণার প্রভাব ছিল। যদিও শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি তার পেছনে। তবে প্রথমদিককার কাব্বালাহ মুসলিম এবং খ্রিষ্টান নব্য প্লেটোবাদীদের দ্বারা সত্যিই প্রভাবিত। অশুভ সম্পর্কে কাব্বালিস্টদের ধারণা পারসিক বিশেষ করে যুরভানিজমের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে হয়। রেনেসাঁর প্রভাব দার্শনিক ব্যাখ্যায় আসে সপ্তদশ শতকের দিকে। বাইরের বিভিন্ন উৎস থেকে বিভিন্ন চিন্তা গ্রহণ করার ব্যাপারে কাব্বালিস্টরা যথেষ্ট উদার থাকলেও বাইরের উপাদান কখনো মূখ্য হয়ে ওঠেনি। বরং তারা তাকে নিজেদের চিন্তা ও মতাদর্শের আলোকে অভিযোজিত করে নিয়েছে। খাপ খাইয়ে নিয়েছে পুরাতনের সাথে নতুনের সংযোজনে।    

This article is about kabbalah, the mystical tradition in judaism; its introduction, evolution and practice in a nutshell.

References:

1) Encyclopedia of Religion, Mircea Eliade, Macmillan Publishing, New York, 1987 Vol-12, Pages: 117-24

2) Kabbalah - Ancient History

3) kabbalah.com

4) Kabbala - Britannica

5) Kabbalah: An Overview - Jewish Virtual Library

Featured Image: kisspng.com

Related Articles