নব্বইয়ের দশকে রক অ্যান্ড রোল জগতটা পুরোটাই বদলে যায় একজন পাগলাটে প্রতিভাবানের আগমনে। হঠাৎ আবির্ভাব ঘটে এক তারকার, যার আলোতে ম্লান হয়ে যায় চারপাশের সব। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে যায় সে, গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে পুরো গ্রাঞ্জ-রক ধারাটাই বদলে দেয় একদম। অল্প কিছুদিনের মাথায় ঘরের কোনায় একাকী বাজানো গিটারটা মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে লাখো-কোটি ভক্তকে। রাতারাতি তারকা, সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা কীভাবে হতে হয়, তিনি দেখিয়েছিলেন গোটা বিশ্বকে। সারাজীবন যে ব্যক্তিটি কষ্ট পেতেন নিজেকে অপাঙক্তেয় ভেবে, তিনি কি ভেবেছিলেন কখনো যে তিনি পুরো পৃথিবীর ভালবাসায় সিক্ত হবেন একদিন, মানুষ তাঁকে ভালোবেসে যাবে মৃত্যুর পরেও, যুগের পর যুগ? কথা হচ্ছিল নব্বইয়ের দশকের সবথেকে খ্যাতিমান এবং গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গীত শিল্পী কার্ট ডোনাল্ড কোবেইন সম্বন্ধে।
এক কাঠুরে বাবা ও ওয়েট্রেস মায়ের ঘর আলো করে ১৯৬৭ এর ২০ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনের এবার্ডিনে জন্ম নেয় এক নক্ষত্র। বাবা-মা, দাদা-দাদীর ভালোবাসা তাঁকে আগলে রেখেছিল আর দশটা সাধারণ বাচ্চার মতোই। সবাই তাঁকে মাথায় তুলে রাখত, আর সে-ও সকলের নয়নের মণি হয়ে মাতিয়ে রাখত সারা বাড়ি। কিন্তু তাঁর জীবনে প্রথম বিপত্তি আসা শুরু করে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের মাধ্যমে। ন’বছর বয়সী অপরিপক্ব কোবেইন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না তাদের সুখের সংসারের ভাঙ্গনটা।
তার ছোট্ট হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সে তখন ধীরে ধীরে সব বিষয়ে বিদ্রোহ করতে লাগল, গোটা পৃথিবীর সাথে যেন তাঁর শত্রু। তাঁর মা তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে দিয়ে আসলেন বাবার কাছে। কিন্তু বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর সেখানেও তাঁর ঠাঁই বেশি দিন হয়নি। কিছুদিন দাদা-দাদী, কিছুদিন অন্য আত্মীয়-স্বজন। এমন করেই চলতে থাকে তাঁর দিন। সবার কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে শেষমেশ ১৫ বছর বয়সে মায়ের কাছে এসেই আবার থিতু হয় সে। মা আর বোনের সাথে মানাতে পারত না তখনও। তাই বিষাদ আর গ্লানিতে জর্জরিত হয়ে খুব অল্প বয়সেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে সে। আর অপেক্ষা করতে থাকে নিজের মতো করে পৃথিবীতে বিচরণ করার।
সবাই চায় আকর্ষণ করতে, সবাই-ই চায় পরিগৃহীত হতে।
– কার্ট কোবেইন
এসবের মাঝে একটা খুব বড় সঙ্গী ছিল ছেলেটার; একটা গিটার। তাঁর গিটারের প্রতি ভালোবাসা আরও প্রগাঢ় হয় যখন তাঁর এক বন্ধু তাঁকে পাঙ্ক-রক গানের একটা তালিকা আর টেপ বানিয়ে দেন। সে যেন তাঁর রাজনৈতিক এবং সামাজিক চিন্তাধারার সাথে তাল মেলাতে পারে অবশেষে। গানের ক্রোধের সাথে নিজের কষ্টগুলো মেলাতে পারে। নিজেকে চিনতে পারার আনন্দে বিমোহিত কোবেইন তাঁর সব উজাড় করে দেন সংগীতে। স্কুলের অত্যাচার, সংসারের সমস্যা- সবকিছু থেকে পরিত্রাণ খুঁজে বেড়ান গানে।
স্কুলের প্রতিও ছিল তাঁর প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা। বন্ধুও ছিল না তাঁর বেশি একটা। কোবেইন ‘সিস্টেম’কে সারা জীবনই তামাশার চোখে দেখেছেন। তা সে স্কুলই হোক কিংবা সরকার। তাঁর জীবনের সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। হাই স্কুলে থাকা অবস্থায়ই একবার রেললাইনের উপর বসে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন, তবে বিফল হন। বাসা থেকে বের হয়ে কিছুদিন ব্রিজের নিচেও বসবাস করেন। সে অভিজ্ঞতা নিয়ে নিরভানার একটা গানও আছে, ‘সামথিং’স ইন দ্য ওয়ে’। হাই স্কুল শেষ হওয়ার কেবল দু’মাস আগে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেন এবং পরিবার থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেন।
আমার বানোয়াট প্রতিচ্ছবির জন্য সর্বজনপ্রিয় হবার চেয়ে প্রকৃত আমিত্বের কারণে ঘৃণিত হতেও রাজি আছি।
– কার্ট কোবেইন
এরপর থেকেই মূলত তাঁর জীবনের মোড় ঘুরতে থাকে। তাঁর তৎকালীন বান্ধবীর সাথে তিনি এবার্ডিন ছেড়ে অরগ্যানে চলে আসেন এবং গান গেয়ে দিন কাটাতে থাকেন। ২০ বছর বয়সে আস্তে আস্তে গঠিত হয় চ্যাড চ্যানিংহ্যাম ও ক্রিস নভসেলিককে সঙ্গে নিয়ে ইতিহাস রচনাকারী ব্যান্ড নিরভানা। কোবেইন ছিলেন অসাধারণ মেধার অধিকারী। বসে বসে গান বাঁধতে পারতেন, গিটারের তারগুলোতে সুরের ঝংকার তুলতে পারতেন, নিজের সবটুকু কষ্ট গানে নিংড়ে দিতে পারতেন। নিরভানা তখন শুরু করে ক্লাবে ও রেঁস্তোরায় গাওয়া। ধীরে ধীরে নাম ছড়িয়ে পড়লে তাঁরা ‘ব্লিচ’ নামে একটা অ্যালবামও বের করে ফেলেন। আর এই ১৯৮৭ সালেই প্রথম হেরোইন নেন কোবেইন। (সূত্র: কোবেইন- মন্টাজ অফ হেক– ডকুমেন্টারি-২০১৫)
নিরভানা শুরুটা কিছু আগে করলেও প্রথম সবার নজর কাড়ে তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘নেভারমাইন্ড’ দিয়ে। ‘স্মেলস লাইক টিন স্পিরিট’ বিলবোর্ড চার্ট কাঁপাতে থাকে সদর্পে। ততদিনে চ্যাড ছেড়ে গিয়েছেন, তাঁর জায়গায় আগমন ঘটেছে ডেভিড গ্রলের (ফু ফাইটার)। আর এরই মাঝে কার্টের জীবনে আসেন কোর্টনি লাভ। প্রেম, খ্যাতি আর মাদককে সঙ্গে নিয়েই পৃথিবী কাঁপান কার্ট কোবেইন। লাখো নারী-পুরুষ তাঁর জাদুর মায়াজালে জড়িয়ে যেতে থাকে।
তাঁর গান কথা বলত এক ভিন্ন সমাজের, সমাজের অসংগতির প্রতি বিদ্রোহের। তিনি চাইতেন তরুণরা যেন নিজেদের খোলস থেকে বেড়িয়ে এসে সমাজ বদলায়, শুধু গাঁ বাঁচিয়ে চলা না শেখে। আর সেসব যুবার জন্য তিনি ছিলেন দৃপ্ত-বলীয়ান কণ্ঠ। তাঁকে বলা হতো “এক রাতারাতি সম্মুখে আসা, বিচ্ছিন্ন তরুণদের মুখপাত্র। সম্পূর্ণ এক প্রজন্মের মুখপাত্র। তাঁর প্রজন্মের কাছে তিনি জন লেননের কাছাকাছি এক আদর্শ।” খ্যাতি তাঁর কাছে কোনো মূল্যবান কিছু ছিল না, তিনি সবকিছু বাদ দিয়ে অর্থবহ গান লেখায় মনোযোগী হতে চেয়েছেন সবসময়। সেজন্যেই হয়তবা বিশ্বের এক নম্বর ব্যান্ড তারকা হওয়া সত্ত্বেও সব তুচ্ছ করে, খ্যাতির মায়া ত্যাগ করে, ছেড়েছুড়ে সব চলে গিয়েছিলেন না ফেরার দেশে।
কোর্টনিকে খুব বেশিই ভালবাসতেন কোবেইন, গড়েছিলেন তাঁর সঙ্গে সুখী একটা পরিবার। আর কোর্টনির থেকেও তিনি বেশি ভালোবাসতেন তাঁর মেয়েকে। মেয়ের জন্য অপরিসীম ভালোবাসায় মগ্ন কোবেইন বারবার বলেছেন যে, মেয়ের জন্য তিনি সংগীত ছেড়ে দিতেও বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করবেন না। মেয়ে ফ্র্যান্সিস ছিল তাঁর সব। যে যত্ন, ভালোবাসা তিনি তাঁর বাবা, পরিবার পাননি সেগুলোর সব উজাড় করে দিয়েছিলেন মেয়ের প্রতি। কিন্তু একটা ভুল যার মাশুল তাঁকে দিতে হয়েছে পদে পদে তা হলো হেরোইন। কোর্টনি এবং কোবেইন দুজনেই এতটাই আসক্ত ছিলেন যে গর্ভাবস্থায়ও নিজেকে সংযত রাখতে পারেননি কোর্টনি। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ তোলপাড় হয়, তাদের জীবন নিয়ে হয় অনেক গবেষণা, পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হয়, কোবেইন যা কখনোই চাননি। এমনকি একপর্যায়ে তাঁর মেয়েকে নিয়ে যায় লস অ্যাঞ্জেলস কাউন্টির চাইল্ড সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট। পরে অবশ্য অভিভাবকত্ব ফিরিয়ে দিলেও কোবেইন এই বিষয় নিয়ে বেশ বিচলিতই ছিলেন।
তবে সব ভুলে গিয়ে আবার নিরভানা গানে মনোনিবেশ করে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ, নতুন অ্যালবাম ‘ইন ইউটেরো’- সব মিলিয়ে নিরভানা নিজেদের এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। তাদের গান সবাইকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তির এক ভাষা দেয়, অবিমিশ্র সত্যগুলোকে সবার সামনে উপস্থাপন করার জন্য দুনিয়া তাদের নিখাদ ভালোবাসায় আঁকড়ে ধরে। তাদের গানের এই ধরনই শূন্য থেকে নিমেষে তাদের পৃথিবী সেরা করে তোলে। কিন্তু মাদক একদিকে যেমন কোবেইনকে কুড়ে কুড়ে শেষ করে দিতে থাকে, অন্যদিকে তাঁর নিজস্ব অসুস্থতা তাঁকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।
সবদিক বিবেচনা করে কোবেইন ছ’মাসের বিরতি নিয়ে আবার পুরোদমে সংগীত চর্চা শুরু করেন। ১৯৯৩ সালের শেষদিকে কোবেইন এক একুয়াস্টিক-আনপ্লাগড রাত্রির আয়োজন করেন এম-টিভিতে। সেখানে তিনি ব্যান্ডের বিখ্যাত গানগুলো তো বটেই, পরিবেশন করেন কিছু অন্য ধরনের, অন্য শিল্পীদের গান। সবাইকে অবাক করিয়ে দিয়ে প্রমাণ করেন তিনি শুধু স্টেজেই অসাধারণ পরিবেশক নন, অনেক বড় মাপের শিল্পী, অমিত প্রতিভাধর তিনি। অবশ্য এমন না যে নিরভানা কোনো সমালোচনার শিকার হয়নি এর স্বর্ণযুগে। তাঁরা গান দিয়ে সমান তালে তাদের বক্তব্য বারংবার সর্বসম্মুখে এনে রেখেছেন। অবশ্য ছোটবেলা থেকেই কোবেইন সমালোচনার প্রতি এক বিরূপ মনোভাব নিয়ে চলতেন।
বিখ্যাত হওয়ার পর যখন তাঁর নিজস্ব জীবনের চুলচেরা বিশ্লেষণ হতে শুরু করল তিনি গণমাধ্যমকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন। তিনি ঘৃণা করতেন তাঁকে তাঁর জীবনের জন্য মূল্যায়ন করা, দূর থেকে বিচার করা, যে জীবন কিনা তাঁকেই ভোগ করতে হচ্ছিল। এগুলোর সাথে এসে মিশ্রিত হয় তাঁর সংসার জীবনের সমস্যা। ধীরে ধীরে তিনি আরও বেশি মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়েন। হয়তো তাঁর আত্মহত্যার পরিকল্পনার কথা কেউ জানত না। কিন্তু এম-টিভির শো-তে আসার আগেই হয়ত তিনি সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেছিলেন। নয়তো কেন তিনি সাজাতে অনুরোধ করবেন গোটা স্টেজটা মৃত্যুর প্রতীক লিলি ফুল দিয়ে, অন্তষ্ট্যিক্রিয়ার মতো করে? তাঁর এই পরিবেশনা নিয়ে বিবিসি বিবৃতি দিয়েছিল,
যেন লেনন গাইছে ইলেকট্রিক গিটার দিয়ে, তবে সম্পূর্ণ বিপরীত আর কী!
তাঁর মৃত্যুর একমাস আগেও, ৪ঠা মার্চ তিনি ৬০টি রহিপনল খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন কোর্টনির উপর অভিমান করে। তবে তখন সবাই সেটা অতিরিক্ত মাদক-সেবনের ঘটনা ভেবে আড়াল করে যায়। কিন্তু একমাস পরেই তিনি শটগান দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
খুব ক্ষুদ্র ক্যারিয়ারে কোবেইনের অর্জন কম না! করেছেন বিশ্ব-ভ্রমণ, পরিবেশন করেছেন ইউরোপ-যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রে, ৭৫ মিলিয়ন অ্যালবাম বিক্রি করার রেকর্ড আছে, পাঁচ-ছ’বছরেই তাঁর ব্যান্ডের আয় ছিল ৫৫০ মিলিয়ন ডলার, পেয়েছেন কোটি ভক্তের ভালবাসা। কোবেইনের অকালমৃত্যুতে যে শোকের চাদরে গোটা বিশ্ব ঢাকা পড়ে, সেটি শব্দে বয়ান করার মতো নয়। সংগীত দুনিয়া এক অবিশ্বাস্য প্রতিভাকে হারায়, একটি গোটা প্রজন্ম হারায় তাদের আদর্শকে, কিছু ভক্ত হারায় প্রাণ, আর আমরা পিছিয়ে যাই এক আলোকবর্ষ। এখনও শ্রদ্ধাভরেই স্মরণ করা হয় বিশ্ব সংগীতের এক বিষাদময় এই অধ্যায়টি। হয়ত এই আশায় যে আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিতে পারব কোনো একভাবে। প্রশ্ন জাগে, কী এমন কষ্ট ছিল মানুষটার মনে যে, শত-কোটি ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে, তাদের ভালবাসাকে তুচ্ছ করে চলে যেতে বাঁধল না তাঁর। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, চিরজীবনই কি এমনই খামখেয়ালি ছিলেন না তিনি!
ফিচার ইমেজ: IBTimes UK