শিল্পী আঁকবে, সেটাই স্বাভাবিক। শিল্পীর মনে বাস করে শিল্পের রঙ আর ভাবনা। সেটা যেমন জেগে থাকলেও, তেমনি কারো কারো বেলায় ঘুমিয়ে পড়লেও। যদি কোনো শিল্পীকে চোখ বন্ধ করে ছবি আঁকতে দেখেন, তাহলে কি অবাক হবেন না? ব্যাপারটি অবাক হওয়ার মতোই।
সাধারণত, মানুষ ছবি আকার সময় চোখের সাহায্য নেয়। আঁকতে গেলে চোখ খোলা রাখার প্রয়োজন পড়ে। তবে চিত্রকর লী হ্যাডউইনের অবস্থা একেবারেই উলটো। এই শিল্পী চমৎকার সব ছবি আঁকেন। চোখ খোলা রেখে নয়, বন্ধ করে। তার বেলায় যেন উল্টোটা সত্য, চোখ খোলা থাকলে তেমন একটা ছবি আঁকতে পারেন না। তার জন্য প্রয়োজন ঘুম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অসংখ্য ছবি এঁকেছেন তিনি এখন পর্যন্ত। সেই ছবিগুলোর প্রদর্শনীও হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ওয়েলস-এর নেওয়া লী ঘুমিয়ে ছবি আঁকার এই প্রক্রিয়া শুরু করেন চার বছর বয়স থেকে। জেগে থাকলে যে তিনি আঁকতে পারেন না তা নয়। তবে তার মতে সেই ছবিগুলো দেখতে বেশ বাজে হয়। ঘুমিয়ে যে ছবিগুলো তিনি আঁকেন সেগুলোর সাথে যেন এই ছবিগুলোর কোনো তুলনাই হয় না! অন্যদের জন্য যেটা অস্বাভাবিক, ৪০ বছর বয়সী শিল্পী লী-র জন্য সেটা খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।
যুক্তরাজ্য এবং দেশের বাইরে বহু চিকিৎসক ইতোমধ্যে লীকে নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছেন। শেষমেশ তারা সবাই বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, ব্যাপারটা একেবারেই ‘অন্যরকম’। লী জানান, চিকিৎসকেরা সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছেন সে জাগ্রত অবস্থায় একইরকম ছবি আঁকতে পারে না- এটা দেখে। ঘুমন্ত অবস্থায় লী শিল্পী থাকলেও, সেই শিল্পী স্বত্ত্বা জাগ্রত অবস্থায় তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে না। তাই একই ব্যক্তি হয়েও একই ছবি আঁকতে পারেন না তিনি।
চার বছর বয়সে ঘুমের মধ্যেই রঙ হাতে দেয়ালে আঁকতে শুরু করেন লী। ধীরে ধীরে দেয়াল থেকে রঙ নেমে এসেছে কাগজে। কিশোর লী একবার সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পান তার পাশে কাগজে মেরিলিন মনরোর ছবি আঁকা। দেখতে চমৎকার সেই ছবিটি দেখেই মুগ্ধ হয়ে যান। বুঝতে পারেন এটি তিনিই এঁকেছেন এবং ঘুমের মধ্যে তার ছবি আঁকার হাত আসলেই ভালো।
চিকিৎসকদের মতে, এটা একরকমের মানসিক জটিলতার ফলাফল। ছোটবেলায় পাওয়া ভীতি থেকে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তবে লীর মতে, মানসিকভাবে এমন কোন ভয় বা কষ্টের মুখোমুখি তিনি হননি কখনো। ছোটবেলায় আরো অনেকের মতো কিছু বন্ধুর সাথে ছাড়াছাড়ি তার হয়েছে বটে তবে সেটা মানসিকভাবে তেমন সমস্যা তৈরি করার মতো নয়।
এডিনবার্গ স্লিপ ক্লিনিকে পরীক্ষা করার পর চিকিৎসকেরা লী এবং তার বাবা-মাকে ছবি আঁকার এই প্রক্রিয়াটি চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। যেহেতু এটি কোনো সমস্যা তৈরি করছিল না, তাই লীও ছবি আঁকা চালিয়ে যান। ফলে এখন তার মোট ছবির সংখ্যা প্রায় ৬০০। লী যে শুধু ছবি এঁকে গিয়েছেন এই সময়ে তা-ই নয়। সেই ছবিগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। সেটার পরিমাণ এতই বেশি ছিল যে, একটা সময় লী নিজের চাকরি ছেড়ে ছবি আঁকাতেই মনোনিবেশ করেন। নানারকম দাতব্য কাজে এবং ছবি বিক্রির কাজে বর্তমানে কাজ করে চলেছেন এই শিল্পী। ২০১৩ সালে নিজের ছবি বিক্রি করে লী কয়েক হাজার পাউন্ড আয় করেন। সেই টাকা পরবর্তীতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের জন্য খরচ করেন।
সাধারণ মানুষের কাছে লী আর তার ছবিগুলো জনপ্রিয়তা পেলেও শিল্পী সমাজে তিনি এখনো বাইরের সদস্য। প্রথমে এ নিয়ে অপরাধবোধে ভুগলেও এখন সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তার মতে, অনেকে অনেকদিন পড়াশোনা করে, অনেক জেনে তারপর শিল্পী হওয়ার সামর্থ্য অর্জন করে। অন্যদিকে, লী তেমন কেউই নয়। সে পড়াশোনা করেনি, সে জানে না কে তার ছবি কিনছে বা তার ছবি আসলেই ভালো কিনা।
তিনি নিজেকে কখনোই শিল্পী ভাবেনি। তবে শীল্পের যে অংশটুকু নিজের মধ্যে রয়েছে সেটাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। নিজের আঁকা ছবিগুলোকে আরো গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করছেন লী। কিছুদিন আগে চীন থেকে ট্যুর শেষ করে যুক্তরাজ্যে ফিরেছেন। এর আগে টেলিভিশনে তাকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘স্লিপওয়াকার সিক্রেটস অব দ্য নাইট’ প্রচারিত হয়েছে। এবার তার ছবির প্রদর্শনী ‘হিপনোস’ নিয়ে আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কথা চলছে।
ঘুমন্ত অবস্থায় কথা বলা বা চলাচল করা এখন পর্যন্ত অনেকবার অনেকের সাথে ঘটতে দেখা গেছে। তাই এটা আমাদের জন্য সাধারণ একটি ঘটনা। ঘুমের মধ্যে ছবি আঁকাটা সেই তুলনায় একেবারেই নতুন আর অন্যরকম। তাই ব্যাপারটি নিয়ে হৈ চৈ বেশি হচ্ছে। তবে কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির পেনি লুইস ব্যাপারটিকে স্বাভাবিক বলে বর্ণনা করেন। তিনি জানান যে, ঘুমন্ত অবস্থায় অনেকের মস্তিষ্কে স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে না। সেজন্য এমন অনেক কিছু ঘটে যেগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হয় না। ঘুমন্ত অবস্থায় ছবি আঁকাটাও অনেকটা তেমনই একটি ব্যাপার।
ঘুমন্ত অবস্থায় মস্তিষ্কের যৌক্তিক অংশটি ঘুমিয়ে থাকলেও লিম্বিক সিস্টেম, যে অংশটি মানুষের আবেগীয় ব্যাপারগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে সেটি জেগে থাকে। আর এজন্য ঘুমন্ত অবস্থায়ও লী ছবি আঁকতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেওয়া লীর আঁকা ছবিগুলোর বেশিরভাগই বিমূর্ত। কারো ছবি যে তিনি আঁকেননি তা নয়। তবে সেটা একেবারেই আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। এমনকি লী চাইলেও সেখানে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেন না। এমন অনেক ছবি আছে যেগুলো লী কয়েক রাত ধরে বানিয়েছেন। তার এই ছবি আঁকার এক রকমের প্যাটার্ন আছে। তাই জাগ্রত অবস্থায় চিন্তা না করলেও ঘুমন্ত অবস্থায় ঠিক যে জায়গা থেকে আঁকা শেষ করেছিলেন সেখান থেকেই শুরু করতে পারেন। ছবি আঁকার বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে কোনো ধারণা না থাকলেও একটা সময় এর পেছনে থাকা রহস্য খুঁজে পেয়েছেন লী।
তার মতে, নিজের আশেপাশে থাকা জিনিসগুলোকে দেখেই ঘুমন্ত অবস্থায় ছবি আঁকেন। এমন অনেকবার হয়েছে, তিনি খেয়াল করেননি কোনোকিছু, অথচ তার অবচেতন মন সেটাকে আকড়ে ধরেছে এবং ঘুমন্ত অবস্থায় এঁকে ফেলেছে। এ ব্যাপারে বলতে গিয়ে তিনি জানান, একবার তিনি ২৩ শব্দটি ব্যবহার করে একটি ছবি আঁকেন। সে সময় চিকিৎসকের সাথে নিয়মিত দেখা করছিলেন তিনি। ছবিটি দেখে চিকিৎসক জানান যে তিনি ২৩ সংখ্যা খোদাই করা একটি লকেট পরে আছেন গায়ে। আর সেটাই হয়তো লী কখনো দেখেছেন। সেটা তার অবচেতন মনে রয়ে গেছে।
নিজের এই দিকটিকে লী উপভোগ করেন। সম্প্রতি পুরো বিষয়টিকে নিয়ে তিনি কাজও করছেন। চারপাশের নেতিবাচক অনেক মনোভাব থাকা স্বত্বেও তাই সামনে এগিয়ে চলেছেন এই ঘুমের শিল্পী। চিকিৎসকদের মতে একরকমের বিস্ময় লী।