“কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালি বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই…”
প্রবোধ চন্দ্র দে, আমাদের কাছে পরিচিত ‘মান্না দে’, তার গায়কিতে মুগ্ধ হয়ে না জানি কত মানুষ কখনো না কখনো হারিয়েছে এই কফি হাউজের গানটিতে, বারবার মনে করেছে হারিয়ে যাওয়া কোনো আড্ডা বা আড্ডাবাজ বন্ধুদের। কফি হাউজের আড্ডাটির মতো, মান্না দে’ও হারিয়ে গেছেন, তিনিও আজ আর নেই সুন্দর ভুবনে। যতদিন ছিলেন, ততদিনই যেন সুরমূর্ছনায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন একাধারে বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটিসহ অজস্র ভাষার সঙ্গীতপ্রেমীদের।
তবে বাংলা গানে তার যত ভক্ত, তত বোধহয় আর কোনো ভাষায় নেই। ওপার বাংলার আরেক বিখ্যাত শিল্পী অঞ্জন দত্ত তো তার গানে বলেই দিয়েছেন ভক্তদের মনের কথা, “আর বিরহের কথা এলে, বুকের জ্বালা ভুলে, আজো মাঝে মাঝে গাই মান্না দে’র গান”।
ঠিক তাই! মান্না দে’র গান মানেই প্রেম, তা সে সফল কিংবা ব্যর্থ যাই হোক না কেন। কোনো ব্যর্থ প্রেমিক যেমন গেয়ে উঠতে পারেন, “ও কেন এতো সুন্দরী হলো?”, তেমনি বিচ্ছেদও ব্যক্ত করা যায় এভাবে, “এই কূলে আমি আর ঐ কূলে তুমি, মাঝখানে নদী সব বয়ে চলে যায়…”। তাই আধুনিক বাংলা গানের জগতে সর্বস্তরের শ্রোতাদের কাছে মান্না দে’র গান এক বিশেষ আবেদনের জায়গায় অবস্থান করে।
সঙ্গীতের জগতে অবাধ বিচরণ করা মান্না দে জন্মেছিলেন ১৯১৯ সালের ১লা মে, কলকাতায়। তার পিতা পূর্ণ চন্দ্র দে ও মাতা মহামায়া দে।
গানে যার প্রেম বইত, তার জীবনেও প্রেমের স্থান ছিলো বিশেষ
প্রথম দেখাতেই নাকি মান্না দে প্রেমে পড়েন সুলোচনা কুমারনের, অতঃপর বিয়ে, দাম্পত্যজীবনে তারা দু’টি কন্যাসন্তান জন্ম দেন- সুরমা ও সুমিতা। ২০০৯ সালে প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মান্না দে বলেন,
“আমার জীবনের সক্কলের চাইতে বড় পাওয়া আমার স্ত্রী। ওকে দেখে প্রথম দর্শনেই প্রেম বলতে যা বোঝায়, তাই হয়েছিলো আমার। এরপর আমরা একে অপরকে জানলাম, বিয়ে করলাম। এই ৫৫ বছরের বিবাহিত জীবনে সবসময়ই ওকে আমার সঙ্গী হিসেবে যেমন সেরা মনে হয়েছে, তেমনি বন্ধু হিসেবেও সেরা, যেকোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করার জন্য সেরা। ও সুধু আমার স্ত্রীই নয়; আমার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। আমার সবচেয়ে বড় সমালোচকও”।
২০১২ সালে সুলোচনা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এবং এরপর এক স্মৃতিচারণে মান্না দে বলেন যে, তার শেষ ইচ্ছা হচ্ছে তার মৃতা স্ত্রীর জন্য একটি প্রেমের গান রেকর্ড করা এবং তিনি সেটি করেও গিয়েছেন।
নিয়মে ভরা ছিলো তার জীবন
নিয়ম মেনে চলতেন সবসময়ই তিনি, নিজের চারপাশে নিয়মের দেয়াল করে রেখেছিলেন, তার মতে তার এই নিয়ম মেনে চলাই তার চিরসবুজতার রহস্য।
যৌবনে শারীরিক কসরৎ করতেন, খেলাধুলায়ও ছিলেন পটু, তার এই নিয়মের অনেকটাই সেখান থেকে পাওয়া। ছোটবেলায় বাবা পূর্ণ চন্দ্র দে শিখিয়েছিলেন, সবকিছু সময়মতো করতে হবে, সে কথাই মনে রেখে জীবনযাপন করেছেন মান্না দে। তাই তো ৯০ বছর বয়সেও গান করতে পেরেছেন, দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করতে পেরেছেন। প্রতিদিন পাক্কা দু’ঘন্টা রেওয়াজ করেছেন দীর্ঘ ৬০ বছর, তার মতে সঙ্গীতে তার শিক্ষাজীবন কখনো শেষই হয়নি। সব গায়ক, সব সুর থেকে শিখেছেন তিনি, কখনো ভাবেননি তার শিক্ষা শেষ হয়ে গেছে! নিজেকে মুহূর্তে মুহূর্তে আরেকটু সমৃদ্ধ করতে ভালবাসতেন, চাইতেন তার গায়কিকে আরো মোহনীয় করে তুলতে। গানই ছিলো তার জীবন।
তার জীবনে সঙ্গীতের হাতেখড়ি করান যিনি
মান্না দে সবসময়ই তার গানের প্রথম গুরু মেনেছেন তার কাকাকে। তার মতে, কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে তাকে কখনো দু’টো মেডেল আর একটা কাপ পাওয়ার জন্য গান শেখাতেন না। সঙ্গীতের প্রথম পাঠ নিজে নিজেই নিয়েছিলেন মান্না দে, একে শ্রুতিশিক্ষাও বলা চলে।
কাকার সুবাদে ভারতের বিখ্যাত গাইয়েরা ভিড় করতেন বাড়িতে, তাই গানের সা-রে-গা-মা নিজে নিজেই শেখেন তিনি। কাকা কৃষ্ণচন্দ্রের ছাত্র হয়েছিলেন সেই একেবারে গ্র্যাজুয়েট হবার পর। পড়াশুনা শেষে গায়ক হওয়াই যেন স্থির করলেন তিনি, আদর্শ হিসেবে হয়তো সেই কাকাকেই দেখতে পেয়েছিলেন! ধাপে ধাপে এগোন তিনি, কাকার কাছে শেখার পর কাকার ওস্তাদ দবীর খাঁ’র ছাত্রত্ব গ্রহণ করলেন। এরপর ১৯৪২ সালে বোম্বে গিয়ে ফিল্মের গান গাওয়াতে যোগ দিলেন।
প্রথম দিকে শচীন দেব বর্মণ এর অধীনে কাজ করেন মান্না দে। এছাড়াও বহু স্বনামধন্য গীতিকারের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। ১৯৪৩ সালে ‘তামান্না’র মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটে তার। সর্বক্ষেত্রেই কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন তার সর্বতো অভিভাবক। ‘সুরাইয়া’ নামে একটি হিন্দি ফিল্মে কৃষ্ণচন্দ্রের সুরে গানও গেয়েছিলেন তিনি।
কাকার প্রতি প্রচন্ড কৃতজ্ঞ ছিলেন তিনি, মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি ছয়টি গান রেকর্ড করেন এবং এর মধ্যে দু’টো ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘তোমরা যা বলো তা বলো’ ও ‘আনন্দ তুমি স্বামী’। এই দু’টো গান তিনি উৎসর্গ করে যান কাকা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধারূপে।
কোনো একটি নির্দিষ্ট গানের ক্ষেত্রে নিজেকে আটকে রাখতে চাননি মান্না দে। নিজেকে সর্বভারতীয় করতে চেয়েছেন এই শিল্পী। কিন্তু এ নিয়ে তার কিছু আক্ষেপও ছিলো। তার সমসাময়িক শিল্পীদের মতো তিনি সর্বভারতীয় পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠেননি, তার গন্ডিটি সবসময় ‘বাংলা’ই ছিলো, এবং এ থেকে বেরোতে চেয়েও তার আশানুরূপ ফল পাননি। এজন্যই হয়তো বাংলা গানের মতো এতো জনপ্রিয়তা অন্যান্য ভাষার গানে তিনি পাননি। তিনি সবসময় বিশ্বাস করতেন, ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ এবং এ অনুযায়ীই নিজেকে তৈরি করে গিয়েছেন তিনি, তাই আজ পর্যন্ত তিনি ও তার গান খুব ভালোভাবেই টিকে আছে এবং মোহিত করছে শ্রোতাসমাজকে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে মান্না দে কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করতেন
মান্না দে ভাবতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে, একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই রয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবেদন। কিন্তু কেন? এর কারণ হিসেবে মান্না দে চিহ্নিত করেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার ধরনকে।
তিনি বলেছেন, “এটা কেমন নিয়ম যে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গেলে ওরকম গলা চেপে চেপে গাইতে হবে?” তার মতে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে কথা, যে আবেগ, তা কখনোই একরকম নয়। সবধরনের আবেগ প্রকাশ করতে হলে গাইবার ধরনেও আনতে হয় ভিন্নতা, এবং এভাবেই হয়তো একদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে উঠবে গণমানুষের গান। বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুদিত তার আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’তেও তিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন রবীন্দ্র অনুরাগী, যে মান্না দে’র গান আমরা একা মনে গুনগুন করে গাই, তিনি অবসরে গুনগুন করতেন রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো।
প্রিয় শিল্পীর প্রিয় তালিকায় ছিলেন যে শিল্পী
হিন্দি-বাংলা সব গান মিলিয়ে মান্না দে’র প্রিয় শিল্পীর তালিকা দখল করে নিয়েছিলেন লতা মুঙ্গেশকর ও মোহাম্মদ রফি। মোহাম্মদ রফির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলতেন, “রফির মতো গাইয়ে ভারতবর্ষে আর হয়নি”। আর লতা মুঙ্গেশকরকে মান্না দে গানের একটি সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানই মনে করতেন! মান্না দে’র মতে, “শিখে কেউ লতা মুঙ্গেশকর হতে পারে না”।
কথা নয় শুধু, সুরও নয়, তার গায়কিই যেন গানকে করে তুলতো আরো বেশি প্রত্যাশিত। “যদি হিমালয় আল্পসের সমস্ত বরফ একদিন গলেও যায়, তবুও তুমি আমার”, মান্না দে’র গলায় গানটি জয় করে নিতো হাজার প্রেমিকের নির্ঘুম রাত। প্রেমের মাপকাঠি যেন নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন তিনি, “ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছো যে তুমি ভালোবাসবে/ ক’টা রাত জেগে কাটিয়েছ, স্বপ্নের মিথ্যে আবেগে?”
সঙ্গীতজীবনে সাফল্য এসেছে বহুবার বহুভাবে। পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ, মাইকেল সাহিত্য পুরষ্কার, দাদাসাহেব ফালকে, শ্যামল মিত্র পুরষ্কার, ডি. লিট সম্মাননাসহ আরো বহু পুরষ্কারে তার ঝুলি ভরেছে। তাই প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আক্ষেপের সুযোগ রয়নি মান্না দে’র জীবনে। তিনি তার প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের সাথে সাথে পেয়েছেন পূর্ণ স্বীকৃতিও।
২০১৩ সালের ২৪শে অক্টোবর তার জীবনের জলসাঘরের ইতি টেনে ব্যাঙ্গালোরে মান্না দে মৃত্যুবরণ করেন। তার গানের ভাষায় বলা চলে,