মঙ্গোলিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত আলটাই অঞ্চলটি পৃথিবীর অন্যতম দূরবর্তী এলাকা। যদিও কয়েকটি প্রাচীন সড়ক পুরো এলাকাটিকে সংযুক্ত করে রেখেছে। আধুনিক সভ্যতার কোনো আলো এখনো সেখানে পৌঁছায়নি। শীতকালে এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চোখে পড়ে বরফে ঢাকা পাহাড়ের শীর্ষ, আবার গরমের দিনে দেখা যায় ধূসর বালুকাময় ভূ-পরিমণ্ডল।
ভৌগলিকভাবে এলাকাটি যথাক্রমে মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তান, চীন ও রাশিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা। তবে কোনো সীমান্ত দেয়াল নেই। ফলে অনেক সময় বোঝাও যায় না যে, কোন জায়গাটি কোন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত। তবে আমাদের আজকের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক জায়গাটি মঙ্গোলিয়ার অন্যতম প্রদেশ বাইয়ান আলিগির অন্তর্ভুক্ত।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩,০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত আলটাইয়ের এই নিষ্ফলা ভূমিতে একটি বিশেষ আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে। বহুকাল আগে কাজাখস্তান থেকে তারা এখানে এসে বসবাস শুরু করেন, তাই তাদের নাম কাজাখ। এদের মাথায় থাকে শিয়ালের চামড়া ও পশমের সমন্বয়ে তৈরি একধরনের বিশেষ টুপি আর দেহে থাকে ভেড়ার চামড়া ও পশমের সমন্বয়ে তৈরি বিশেষ পোষাক। শুধু যে এই বৈচিত্র্যময় পোশাক তাদের বিশেষত্ব তা নয়, অনেক প্রাচীন ঐতিহ্যও তারা এখনো ধরে রেখেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ঐতিহ্য হলো শিকারি ঈগল পোষা।
ঈগল পোষার ঐতিহ্য কমপক্ষে ৬,০০০ বছর আগের। জানা যায়, জগদ্বিখ্যাত মঙ্গোলিয়ান নেতা চেঙ্গিস খান ও কুবলাই খানও শিকারি ঈগল পুষতেন। তাদের প্রত্যেকের এক হাজারের বেশি শিকারি ঈগল ছিল। সেসব ঈগল দ্বারা তারা বহুবিধ অভিযান পরিচালনা করতেন। যুদ্ধে ও আভিজাত্যে ব্যবহৃত সেসব শিকারি ঈগলের স্মৃতিকথা ইতালির বিশিষ্ট পর্যটক মার্কো পোলো তার নথিতে উল্লেখ করে গেছেন।
এখনো সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন মঙ্গোলিয়ার কাজাখ আদিবাসীরা। নিষ্ফলা ভূমিতে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে এই শিকারি ঈগল তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিকারি ঈগল পোষাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় বারকুতসি। কিন্তু বর্তমানে সেই ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়তে শুরু করেছে। এখন মাত্র ২৫০ জনের মতো মানুষ এই ঐতিহাসিক কর্মের সাথে যুক্ত আছে। এদের মধ্যে অন্যতম বিকবোলাত।
কাজাখ আদিবাসীরা মঙ্গোলিয়ার বাইয়ান আলিগি প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। ১৮ শতকের মাঝামাঝিতে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের পুলিশ সদস্যরা প্রথমবারের মতো এদের সন্ধান পায়। শিকারি ঈগল পোষা এই আদিবাসীরা তখনও নিজেদেরকে আধুনিক বিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রাখেন। সেখানে তারা শীতকালের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও বরফের মধ্যে লড়াই করে টিকে থাকে। বসবাসের জন্য তার ছোট ছোট কুঁড়েঘর নির্মাণ করেন। এই কুঁড়েঘরগুলোকে তারা ‘গেরস’ বলেন। পেশা হিসেবে তারা বেছে নিয়েছেন শিকারি ঈগল দিয়ে বন্যপ্রাণী শিকার করা। শীতকালে তারা ঘোড়ার পিঠে চড়ে প্রশিক্ষিত ঈগল দ্বারা শিকার করে বেড়ান।
এসব শিকারি ঈগল ও তাদের মুনিবদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ঈগল স্বভাবগতভাবে অত্যন্ত স্বাধীনচেতা পাখি। ফলে তাকে পোষ মানানো খুবই কঠিন কাজ। ঈগলকে বশে আনার জন্য ছোটকাল থেকে তাকে নিবিড় প্রশিক্ষণ দিতে হয়। অন্যতম শিকারি বিকবোলাত বিষয়টি নিয়ে বলেন,
পোষ মানানোর জন্য ঈগল ছানা সবচেয়ে উত্তম। বড় হয়ে গেলে তাদের পোষ মানানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। ছোট থেকেই প্রশিক্ষণ দিয়ে এদেরকে দক্ষ শিকারি হিসেবে গড়ে তোলা হয়। তবে মুনিবের প্রতি যথার্থ আস্থা তৈরিতে এদের বহু সময় লাগে। প্রশিক্ষণের অন্যতম দিক হলো একবার পোষ মেনে গেলে এরা আর গৃহপালিত ভেড়া ও মানব শিশুদের উপর আক্রমণ করে না। তবে বাস্তবতা হলো শিকারি হিসেবে বয়স্ক ঈগল উত্তম। বেশি বয়সের প্রশিক্ষিত ঈগল এত দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে যে, তখন তারা শিয়াল ও নেকড়ের মতো দ্রুতগামী প্রাণীও শিকার করে ফেলতে পারে।
শিকারের জন্য পুরুষ ঈগলের চেয়ে নারী ঈগল অধিক কার্যকরী। নারী ঈগল শুধু আগ্রাসী তা নয়, তারা মুনিবের নির্দেশনা অনুসরণ করতে এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ব্যাপারে পুরুষ ঈগলের চেয়ে তিনগুণ অধিক পারদর্শী।
একটি ঈগলকে যদি একবার প্রশিক্ষিত করে তোলা যায়, তাহলে সে বহু বছর যাবত শিকারে সহায়তা করে যেতে পারে। শিকারিরা তাদেরকে সাথে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে শিকার করতে বের হন। এসময় শিকারি ঈগলকে মালিকের ডান কাঁধে বসিয়ে রাখা হয়। অভিজ্ঞ ঈগল ও ঝানু মুনিব একসাথে অভিযানে বের হলে তা হয় বেশ রোমাঞ্চকর। যখনই ঈগল কোনো শিকারের সন্ধান পায় কিংবা তার নাকে শিকারের ঘ্রাণ আসে, তখনই সে মালিকের ঘাড়ে নখ দিয়ে চেপে ধরে; অর্থাৎ মুনিবকে সে শিকারের সন্ধান দেয়। মুনিব সাথে সাথে সেই দিকে ছুটে যান।
কিছু কিছু কাজাখ শিকারি এখনো শিকারের জন্য মান্ধাতার আমলের রাশিয়ান বন্দুক ব্যবহার করেন, যা দ্বারা তারা মূলত খরগোশ জাতীয় ছোটখাট প্রাণীদের শিকার করতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ শিকারী আরও বড় বড় শিকারের সন্ধান করে থাকেন। বিশেষত যাদের বুদ্ধিমান ও প্রশিক্ষিত শিকারি ঈগল আছে, তারা ছোটখাট শিকারের দিকে তেমন একটা নজর দেন না।
বলে রাখা ভালো, অভিজ্ঞ ঈগলরা শিকারের ব্যাপারে তাদের মনিবদের থেকে কমপক্ষে আটগুণ বেশি বিচক্ষণ। এসব শিকারি ঈগলের মাধ্যমে মনিবরা প্রধানত করসিক শিয়াল ও মারমোন্টস (একধরনের বৃহৎ ইঁদুর) জাতীয় প্রাণী শিকার করেন। এসব প্রাণীদের দেহ পশম দ্বারা আবৃত থাকে, যা কাজাখদের জীবনযাপনের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। ফলে তারা একইসাথে পশম ও গোশত সংগ্রহ করতে পারেন। অর্থাৎ পোশাক ও খাবারের ব্যবস্থা একবারেই হয়ে যায়। তবে শক্তিশালী ঈগলরা কখনো কখনো পেঁচা ও বরুফে চিতাবাঘকেও শিকার করে ফেলে।
শিকারের জন্য শীতকাল সবচেয়ে ভালো সময়। কেননা এ সময় শিকারি ঈগলরা সবচেয়ে বেশি হিংস্র ও ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু বছরের অন্যান্য সময়েও এসব ঈগল ছোটখাট শিকার নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অত্র অঞ্চলের প্রাদেশিক রাজধানী অলিগিতে একটি বৃহৎ ‘ঈগল শিকারি উৎসব‘ অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে নগদ অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়। এ সময় পুরুষরা নিজেদের দক্ষতা প্রমাণের জন্য বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকেন, যেমন- কোকবার। এই খেলায় দুজন করে পুরুষ অংশগ্রহণ করেন। তারা ঘোড়ার পিঠে চড়ে ভেড়া বা শিয়ালের চামড়া টানার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন (দেখুন নিচের প্রথম ভিডিওতে)। আরেকটি খেলার নাম টেনজ আলু। এই খেলায় অংশ নেয়া প্রতিযোগীদের ঘোড়ার পিঠে থাকা অবস্থাতেই মাটিতে রাখা টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। সেক্ষেত্রে তারা তাদের ঘোড়া থামাতে পারবেন না কিংবা নিজেরা ঘোড়া থেকে নামতেও পারবেন না (দেখুন নিচের দ্বিতীয় ভিডিওতে)।
যদিও এই উৎসবের সামগ্রিক পরিবেশ ও অধিকাংশ প্রতিযোগিতা পুরুষদের কেন্দ্র করে সাজানো হয়ে থাকে, তবুও কিছু খেলায় নারীরা তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেন, যেমন- কায়জ কুউ, যেখানে একজন নারী ও একজন পুরুষ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। যদি প্রতিযোগিতায় পুরুষ আগে নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করতে পারেন, তবে তিনি নারীর গালে একটি চুমু খাবেন, আর যদি নারী তার আগে নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করতে পারেন, তাহলে তিনি পুরুষের গায়ে চাবুক দ্বারা আঘাত করার সুযোগ পাবেন, যা উন্মুক্ত মাঠের দর্শকদের মধ্যে তুমুল আনন্দের সৃষ্টি করে।
কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো, শীঘ্রই এই ঐতিহ্যগুলো বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এই নিষ্ফলা আবাসভূমিও দ্রুত দখলদারদের হাতে চলে যাচ্ছে। তাছাড়া শিকার করার মতো বন্যপ্রাণীও দিন দিন কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি পর্যটকদের অতিরিক্ত আসা-যাওয়া বন্যপ্রাণীদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। এদিকে শিকার ব্যবস্থাপনা দিন দিন খারাপের দিকে যেতে থাকায় কাজাখ আদিবাসী পরিবারগুলো তাদের সন্তানদেরকে অধিকাংশ সময় জীবিকার সন্ধানে শহরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। যেমনটি বলছিলেন বিকবোলাত,
শিকার করে যে অর্থ উপার্জিত হয় তা দ্বারা এখন আর জীবনযাপন করা সম্ভব হয় না, ফলে পরিবারগুলো তাদের মতো করে বিকল্প পথ খুঁজে নিচ্ছে।
তবুও এখন পর্যন্ত শিকারিরা তাদের গায়ের পোশাক, মাথার টুপি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাপড়, যা শীতকালীন উৎসবের জন্য প্রয়োজন, তা তারা বন্যপ্রাণীর পশম ও চামড়া দিয়ে তৈরি করে নিতে পারছেন। শিকারি ঈগলগুলোকেও তাদের মনিবরা যথাযথ সম্মানে লালন-পালন করছেন। প্রথানুসারে, সবসময় তারা তাদের পোষা ঈগলগুলোকে ১০ বছর পর পুরোপুরি মুক্ত করে দেন। তখন এসব ঈগল আবার বনে ফিরে যায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বারকুতসি বা বাচ্চা ঈগলকে প্রশিক্ষিত করে তোলার এই প্রক্রিয়াটি কাজাখ যুবকদের জন্য একটি ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। কেননা তারা এই শিক্ষা তাদের বাবার মাধ্যমে পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ তারা মনে করেন, পুত্রের মাঝে পিতার যোগ্যতা-অযোগ্যতা ফুটে ওঠে। এ বিষয়ে বিকবোলাত বলেন,
তার ১২তম পূর্বপুরুষের কাছ থেকে এই শিকারি ঈগল পোষার ঐতিহ্য চলে আসছে, যা তাদের পরিবারের জন্য একটি অপরিসীম গর্বের ব্যাপার।
বাস্তবতা ভিন্ন হলেও কাজাখ আদিবাসীরা তাদের এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে চান। সেজন্যই বিকবোলাত নিজেদের মধ্যে প্রচলিত একটি প্রবাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেন, যা তাদের এই নিষ্ফলা আলটাই ভূমিতে বন্যপ্রাণীদের সাথে বসবাস করতে উৎসাহ প্রদান করে থাকে। প্রবাদটি হলো,
দ্রুতগামী ঘোড়া আর হিংস্র ঈগল কাজাখ আদিবাসীর শক্তির মূল উৎস।
কিন্তু ক্রমাগত এই ঐতিহ্য চর্চা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে ৬,০০০ বছরের এই ঐতিহ্য বিলুপ্তির হুমকির মুখে পড়ছে। পূর্বেই বলা হয়েছে, বর্তমানে মাত্র ২৫০ জন ঈগল শিকারি আলটাই অঞ্চলে টিকে আছেন। বাকিরা ক্রমাগত অন্য পেশায় বা অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন। বিকবোলাতের কাঁধে থাকা ঈগলটি মায়া ভরা চোখে বারবার তার মুনিবের চোখের দিকে তাকাচ্ছিল, সেও কি বিকবোলাতের মতো ঈগল-মনিব ঐতিহাসিক বন্ধন হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে?