“আমি শুনেছি তোমরা নাকি এখনো স্বপ্ন দেখো, গান গাও প্রাণ ভরে…
মানুষের বাঁচা-মরা এখনো ভাবিয়ে তোলে, তোমাদের ভালোবাসা এখনও গোলাপে ফোটে
আস্থা হারানো এই মন নিয়ে আমি আজ তোমাদের কাছে এসে দু’হাত পেতেছি…”
এক ভরাট গলায় এমনই আক্ষেপ জাহির করছেন কোনো এক গায়িকা। তপ্ত দুপুর অথবা মন খারাপ করা বৃষ্টি-বিকেলে আপনার ঘর ভরে ওঠা এই দরাজ গলার আক্ষেপ হয়তো জাগিয়ে তুলছে আপনার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা আজীবন আক্ষেপ-আফসোসকেও! ঠিক যেন যাত্রাদলের সেই বিবেকের মতো করেই! কখনও কখনও আপনিও হয়তো একটু করে গলা মেলাবেন তার সুরে, হয়তোবা তার কথার প্রকাশে! বিশ্বাস করুন, কোনো অনুনাদ সৃষ্টি হবে না, খুব স্বতন্ত্র করেই গানটি নিজের মতো বেজে যাবে আপনার ঘরের জানালা-দেয়াল ছুঁয়ে!
মৌসুমী ভৌমিক, শুধু সুরে নয় তার চেয়ে বেশি তার গানের কথায় প্রবেশ করেন শ্রোতার মর্মে। তার বিষাদলাগা কণ্ঠে কী যেন এক আকুতি আছে সমুদ্রস্নানে যাবার-
“আবার যেদিন তুমি সমুদ্র-স্নানে যাবে আমাকেও সাথে নিও, নেবে তো আমায়? বলো, নেবে তো আমায়?”
ওপার বাংলার জীবনমুখী বাংলা গানের যে ধারাটুকু আছে, তাতে মৌসুমী ভৌমিক একটি খুব পরিচিত নাম। বংশসম্পর্কে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তার। তার বাবা ও মায়ের পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশের পাবনা আর বরিশালে। কিন্তু দেশভাগের আগেই তাদের পরিবার চাকরিসূত্রে ভারতে স্থিত হন। তাই এই দেশের সঙ্গে তার কোনো স্মৃতি জড়িত নেই, তিনি পুরোপুরিই ভারতীয় নাগরিক ও শিল্পী। কিন্তু তার গান উভয় বাংলার শ্রোতৃবর্গকেই বারংবার করেছে ধন্য। ১৯৬৪ সালে মৌসুমী ভৌমিক জন্মগ্রহণ করেন ভারতের জলপাইগুড়িতে। তিনি বেড়ে উঠেছেন মেঘালয়ের শিলং-এ।
লোকগান ও মৌসুমী
মৌসুমী ভৌমিক ও তার বন্ধু সাউন্ডিস্ট সুকান্ত মজুমদারের প্রয়াসে ২০১১ সালে শুরু করা ‘দ্য ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ রেকর্ডস’ ওয়েবসাইটের ঠিকানাটিতে সংরক্ষিত হচ্ছে দুই বাংলার লোকগানের উপাদানসমূহ। তারা দু’জন মিলে পথ হাঁটছেন আবহমান লোকসঙ্গীতের হাত ধরে সেই ২০০৩ সাল থেকে, আর ওয়েবসাইটের শুরুতে লেখা আছে অনুসন্ধানযাত্রার এই নির্যাসটুকু-
“সহস্র যোজনের পথে আমার ভয় হতেছে একা যেতে। গুরু তুমি আমার সঙ্গে থেকে সুপথ চিনাইয়া লইয়ো”
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মৌসুমী ও সুকান্ত এই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে তাদের গবেষণার বড় দুটি তথ্য আকর হলো ফরিদপুর ও সিলেট। তাদের পথপরিক্রমায় রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও সংলগ্ন আসামের কিছু অঞ্চল ও বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো। এসব অঞ্চলে এই দুই কথাশিল্পীকে প্রায়ই পাওয়া যায় চায়ের দোকান কিংবা গ্রামের কীর্তনের আসরে, সাথে তাদের রেকর্ডিং যন্ত্র! শেকড়ের গানগুলো খুঁজতে যাওয়া কিংবা খুঁজে পাওয়া, গান আর গল্পের মিশেলে তার যাত্রার শুভান্বেষণ নিয়ে মৌসুমী লিখেছেন-
“নদী যেমন দেশের সীমানা বোঝে না, কেবল নাম পাল্টে পাল্টে চলে, কিছুটা তেমনই মানুষের গান আর গল্প, তারও এক নিজস্ব অবাধ স্রোত থাকে। তবে মানুষ কিন্তু ঠিক নদীর মতো নয়… মানুষের চলা ভিন্ন, সে ‘দুখভয়সংকটে’ স্থানান্তরিত হয়, উৎপাটিত হয়, আবার স্বপ্নে সে নির্বাসন খোঁজে। …আবার এই মানুষ শব্দ বহনকারী, তার শরীরে আর স্মৃতিতে অজস্র স্বর আর সুরের দাগ। সে যখন চলে, তার সঙ্গে সঙ্গে তার গান আর গল্পও চলে।“
লোকসঙ্গীতকে দেওয়া মৌসুমী ভৌমিকের আরেকটি উপহার হলো কলকাতার বাউল ফকির উৎসব কমিটির বার্ষিক পত্রিকা আরশিনগর, বাউল ফকির তত্ত্বতালাশ-এ ২০১২ সালে ছাপা হওয়া ‘সময় আর শব্দের রেখায় ম্যাপ-নির্মাণ’ নামক তার একটি লেখা।
মৌসুমীর ‘পারাপার’
২০০২ সালে মৌসুমী ভৌমিক কলকাতা ও লণ্ডনের বেশ কিছু সদস্য নিয়ে ‘পারাপার’ নামে একটি গানের দল গঠন করেন। আক্ষরিক অর্থে ‘পারাপার’ নামকরণের উদ্দেশ্য ছিল সঙ্গীতের পারাপার করার একটি ক্ষেত্র তৈরি করা এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মধ্যে একটি মেলবন্ধন গড়ে তোলা। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে এই দল ব্যবহার করে গিটার (অলিভার উঈকস), চেলো (রস অ্যাকশন), ডাবল বেস (বেন হিলিয়ার্ড), দোতারা (সাত্যকি ব্যানার্জী) ও ড্রামস (ডেরেক স্ক্রাল)। মূলত ইউরোপীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রচলিত চেলো ও ডাবল বেস যখন বাংলা গানে চলে আসে তখন বলা যায়, পারাপার তার উদ্দেশ্য সাধনে কিংবা নামকরণের সার্থকতায় পিছিয়ে পড়েনি! পারাপারের গানগুলোয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের চাইতে মৌসুমীর কথার গঠনে লেপ্টে দেওয়া তার লঘু সুরই যেন আসল, তাই বাদ্যযন্ত্র আছে কি নেই তা এতো প্রভাব ফেলে না!
নিজের গানকে জীবনমুখী গান কিংবা কবিতা বলায় আপত্তি তার
লিরিক বা কথাপ্রবল গানগুলো প্রায়ই পেয়ে যায় কবিতার আখ্যা। খুব সম্প্রতি বব ডিলানের গানের জন্য তিনি যখন সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পেলেন এ নিয়ে বহু তর্কের তুমুল ঝড় বয়ে গেছে। এরই মধ্যে একটা দল ছিল যারা বব ডিলানের গানগুলোকে কবিতা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন এবং নোবেল পুরষ্কার দেবার পক্ষে সমর্থন জানাচ্ছিলেন। এরপর যদিবা ধরতে যাই মাইকেল মধুসূদনের কবিতা আসার আগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কথা, তখন তো পদ্য লেখাই হতো সুর করে গাইবার জন্য। গান ও কবিতায় কোনো ফারাক ছিল না একটা সময়। আর এসকল কারণেই জীবনমুখী ঘরানার গানগুলো কবিতার পরিচয়ে পরিচিত হওয়া খুব একটা অদ্ভুত কিছু না!
কিন্তু এ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন মৌসুমী, তিনি তার গানকে জীবনমুখী গান কিংবা কবিতা- কোনো শ্রেণীতেই ফেলতে চান না। তিনি চান তার গান যেন শুধুমাত্র ‘মৌসুমী ভৌমিকের গান’ বলেই খ্যাত কিংবা অখ্যাত হোক। চিন্তার এই স্বাতন্ত্র্যবোধ মৌসুমীর গানগুলোকেও তাই যেন করে তোলে স্বতন্ত্র ঘরানার। তবে মৌসুমী নিজের গানকে কবিতা বলতে না চাইলেও তার গান শুনে কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এক কবি- কেতকী কুশারী ডাইসন। কবিতা না হোক, কবিতার প্রেরণা হয়েই রইলো ‘মৌসুমী ভৌমিকের গান’।
মৌসুমী ভৌমিককে উদ্দেশ্য করেই এই কবি তার ‘চিলকন্যা’ কবিতায় বলেছেন-
“আমি কৃতজ্ঞ যে তুমি এই পারেরই দুহিতা/ এই জঙ্গলেরই প্রজাপতি। নয়তো চেনা হতো না”
মৌসুমীর মোটমাট সঙ্গীতজীবন
২০০০ সালে প্রকাশিত তার ‘এখনও গল্প লেখ’ অ্যালবামটি শ্রোতাদের মনে সবচেয়ে বেশি জায়গা করে নিয়েছে। এছাড়াও রয়েছে তার আরও দুটি অ্যালবাম ‘তুমি চিল হও (১৯৯৪)’ ও ‘আমি ঘরবাহির করি (২০০১)’। মৌসুমী ভৌমিক বাংলা প্রামাণ্যচিত্র ও আর্ট ঘরানার সিনেমার জন্যও গান বেঁধেছেন এবং গেয়েছেন। ২০০২ সালে কান পুরষ্কারপ্রাপ্ত তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’র সঙ্গীত প্রযোজনায় ছিলেন মৌসুমী ভৌমিক। ২০০৩ সালে করাচিতে ‘কারা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে’ এই সিনেমাটি ‘শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত’ ক্যাটাগরিতে পুরষ্কারও পায়।
মৌসুমীর গানের মধ্যে কিছু একটা অন্বেষণের একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তার মন যেন ছুটে বেড়াচ্ছে, খুঁজে চলছে, ক্রমেই হয়ে উঠছে উদভ্রান্ত এক পথিক-
“আমি খুঁজছি, আমি খুঁজছি তোমার ঠিকানা,
অলি গলি ঘুরে ক্লান্ত তবু তোমায় পাচ্ছিনা
সারি সারি সব বাড়ি যেন সারবাধা সব সৈন্য,
সব এক রঙ সব এক ধাঁচ
তুমি কোথায় থাকো অনন্য?”
গানে গানেও মৌসুমী যেন তার মনের ভাব ঠিক বলে উঠতে পারেন না, তার কথা হারিয়ে যায় কোনো এক অতলে-
“আমার কিছু কথা ছিল তোমায় বলার, যে-ইনা আমি ঠোঁট নেড়েছি/ সেই কথাটা হারিয়ে গেল, এই সময়ের শব্দতলায়…”
এমনই ব্যক্ত-অব্যক্ত গানের কথা রচনা করেন মৌসুমী ভৌমিক, জীবনকে শব্দে এঁকে সেই ছবিতে নিজেকে খুঁজে বেড়ান অনন্যকে খোঁজার বাহানা করে।