২০১৯ অমর একুশে বইমেলায় যে ব্যাপারটা সবাইকে অবাক করেছে আর আনন্দ দিয়েছে, সেটি ছিল সততা স্টল। যে দোকানে ছিল না কোনো বিক্রেতা, অথচ ছিল ক্রেতাদের ভিড়। ক্রেতা নিজেই বই পছন্দ করে, ব্যাগে ভরে, নিজেই চালান লিখে, টাকা জমা দেবে; এটিই ছিল নিয়ম। এই অসৎ আর অমানবিক যান্ত্রিক দুনিয়াতে এমন একটা মহৎ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। আর এই সাধুবাদটা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের আরেকটা অংশ বিদ্যানন্দ প্রকাশনীর প্রাপ্য।
বিদ্যানন্দ প্রকাশনী থেকেই প্রথমবারের মতো আদিবাসী ম্রো-দের বই বের হয়। যার নাম ছিল- ম্রো রূপকথা। লিখেছেন ইয়াংঙান ম্রো। ম্রোদের প্রথম লেখক এবং প্রথম বই। বইমেলায় সবার কাছে বেশ আলোড়ন তুললেও এই আদিবাসী জনগোষ্ঠী ম্রো’রা সবসময়ই আলোচনার আড়ালেই রয়ে গেছে। বইটি নিয়ে নাহয় আরেকদিন কথা বলা যাবে, আজ বরং ম্রো জাতি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে ম্রো জাতিগোষ্ঠীই সবচাইতে প্রাচীন; এমনটাই ধারণা ইতিহাসবিদদের। শুধুমাত্র বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার সর্বত্রই নয়, বরং পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও ম্রো জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। সাধারণত, ম্রোদের মুরং নামেও ডাকা হয়। মুরং শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ম্রো থেকে, যার অর্থ মানুষ এবং মুরং অর্থ মানব সমাজ। ধারণা করা হয়, ম্রোরা হচ্ছে বার্মার চীন জাতির গোত্রভুক্ত। ম্রোরা ওয়াকিম, খামি (খিমি), কিউই, মায়ি নামেও পরিচিত।
ম্রোদের ভাষায়, সাতটি শক্তিশালী বেড়ার অভ্যন্তরে যে লোক বসবাস করে, তাকে তারা ‘মারু-নায়সারি-অ্যা-আইয়াদি’ নামে অভিহিত করতো। আর যারা বেড়া তৈরি করতো, তাদেরকে, ‘মারু-সাদি’ বা ‘মারু-রওকদি’ বলা হতো। এর মানে দাঁড়ায়, যারা ‘মারু’ বা বেড়া তৈরি করতো এবং এ নিয়েই জীবনযাপন পরিচালনা করতো। মারু শব্দটি ধীরে ধীরে মারু, মারুসা, ম্রো-সা, মায়োসা ইত্যাদিতে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। পরবর্তীতে তা ম্রো-তে এসে থামে।
আবার, রাখাইনের উত্তর প্রদেশে প্রবেশের জন্য ম্রোরা সাধারণত যিটমা বা আসামের কাছের কালাণ্ডার নদীর অববাহিকার রাস্তাটাই ব্যবহার করতো। আর সেজন্যই অন্য আদিবাসীরা এদেরকে ‘নদীর তীর ধরে বয়ে চলা মানুষ’ বা ‘মাইত-মায়্যু’ বলে অভিহিত করতো। প্রাগুক্ত মারু বা মায়্যু এই শব্দগুলো থেকে পরিবর্তিত হয়েই পরবর্তী সময়ে ম্রো শব্দটির প্রচলন হয়েছে; অন্তত ইতিহাস তা-ই বলে। যদিও নানান মত এতে প্রাধান্য পাওয়ারই কথা।
প্রাচীন বিশ্বাসমতে, মুরংরা হচ্ছে আরাকানের প্রাচীন এবং বিখ্যাত আদিবাসী। এমনকি দশম শতাব্দীতে দু’জন মুরং রাজা আরাকান শাসন করেছেন। ৯৫৭ সালে আম্যাথু এবং ৯৬৪ সালে পাই-ফিউ রাজা ছিলেন। আর সে সময়টাতে আরাকানের রাজধানী ছিল ওয়েথেইলি।
তবে ম্রোদের প্রচলিত মৌখিক ইতিহাস অনুসারে, ‘প্রাচীন বিশ্বের ইতিহাস’ এ ‘খাউমু গল্প’ নামে একটি গল্প আছে। যে গল্পে পুরুষ খওমারুন এবং নারী খওমানরি একটি অন্ধকার গুহায় একসাথে বসবাস করতো; এমনকি এটি পৃথিবীর বুকে চাঁদ আর সূর্যের অস্তিত্ব আসারও আগেকার কথা। আর ম্রো ভাষায় খাউমু মানে অন্ধকারের মানুষ। আর খওমারুন এবং খওমানরির সন্তানের নাম দেয়া হয়েছিল খাওমু ম্রো, যার অর্থ উৎপাদন বা সৃষ্টিও বোঝায়।
১৪৫৮ সালে রাখাইন পণ্ডিত আদ্যুম্যানু রচিত ‘বা সা ফিউ মিন থাম এচিন’ এ ম্রো শব্দটির প্রাচীন অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এছাড়াও, ১৪৪২ সালে রাজা নরপতি কর্তৃক নির্মিত সাগুয়াইন হুটোপাইন ইন লাইন নামক প্রস্তর শিলালিপিতেও এর সন্ধান পাওয়া গেছে। পরবর্তী সময়ে ম্রো শব্দটি রাখাইন পুরাণে রাখাইন মহা ইয়াজউনত্যায়াগি এবং ধান্যবাদী ইয়াজউনতিত এ মারায়ু এবং বেদারের ব্যাখ্যাসহ অন্যান্য প্রমাণের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছিল।
কোলাইডান নদীর তীরে খুমিদের সাথে মুরংদের এক রক্তাক্ত যুদ্ধ হয়েছিল। খুমি আদিবাসী মুরংদের সাথে লড়াই করেছিল এবং তাদেরকে আরাকান থেকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। তাই মুরংরা ১৭ শতাব্দী বা ১৮ শতাব্দীর দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে সরে আসে।
যদিও বেশিরভাগ মুরংদের বিশ্বাস হচ্ছে, এই ঘটনার সময়কাল ছিল ১৪ শতাব্দী। খুমিরা আরাকান থেকে ম্রোদের বিতাড়িত করলে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে চলে আসে এবং মাতামুহুরি নদী ঘেঁষা সাঙ্গু নদীকে কেন্দ্র করে নতুন বসতি স্থাপন করে। চট্টগ্রাম জেলার প্রধানকে বার্মা রাজা এই মর্মে চিঠিও পাঠিয়েছিলেন।
ম্রোদের মধ্যে মঙ্গোলীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান হলেও তারা লম্বা এবং শক্তিশালী, আর কৃষ্ণাভ শ্যামবর্ণ বিশিষ্ট। স্বভাবে তারা শান্তিপ্রিয়। ম্রো পুরুষদের মুখে গোঁফ আর দাঁড়ি খুব কমই দেখা যায়। দেহগত দিক থেকে মালয়েশিয়ার সেমাং জনগোষ্ঠীর মতোই লাগে ম্রোদের।
ম্রো সমাজে কয়েকটি পরিবার নিয়ে একটি গোত্র হয়। বর্তমান সময় পর্যন্ত ম্রোদের অসংখ্য গোত্রের নাম শোনা যায়। এর মধ্যে ঙারুয়া, নাইচাহ, তাম-তু-চাহ, ইয়ম্রে, ঙারিংচাহ্ণ তাং, কানবক, প্রেনজু, দেং এবং খউ উল্লেখযোগ্য। তবে একই দল বা গোত্রের অধীনে থাকা নারী-পুরুষের বিয়ে নিষিদ্ধ।
সাধারণত, ম্রোরা দিনে দু’বার ভাত খায় আর সবধরনের মাংস খাওয়ার প্রচলনই ম্রোদের মধ্যে আছে। তবে তরকারিতে মশলা কম ব্যবহারের প্রবণতাও ম্রোদের মধ্যে লক্ষণীয়। শুকনো বা শুঁটকি মাছ তাদের অন্যতম পছন্দনীয় খাবার। মদ্যপান ম্রোদের মধ্যে জনপ্রিয় এবং ম্রো সমাজে কোনো ধরনের খাবারের ক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞা নেই। ভাত এবং ঘরে তৈরী মদ হচ্ছে তাদের প্রধান খাবার ও পানীয়।
ম্রোদের সুপ্রিয় আর ঐতিহ্যবাহী খাবার হচ্ছে নাপ্পি। সামুদ্রিক মাছ, ব্যাঙ, হরিণ, বুনো শূকরের মাংসের গুঁড়োর সাথে মাছের তেলের সাথে ময়দার মিশ্রণে বানান এক ধরনের খাদ্যবিশেষ। যদিও ত্রিপুরারা এই খাবারকে সিদেলও নামে অভিহিত করে থাকে। বলতে গেলে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের মধ্যে এ খাবার বিভিন্ন নামে পরিচিত হলেও সবার কাছেই তা জনপ্রিয়।
মূলত পাহাড়ের একদম চূড়াতে বাসা বানায় ম্রোরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়িগুলো বেশ বড় আকৃতির হয়ে থাকে। পাহাড়ের উপর মাচাং (মূলভিত্তি) বানিয়ে তার ওপর বাসা বানায় তারা। অন্যান্য যেকোনো পাহারী জনগোষ্ঠীর চাইতে ম্রোদের বাসা একটু বেশিই বড় আকৃতির হয়ে থাকে। তাদের প্রধান পেশা হচ্ছে জুম চাষ এবং জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করা।
ম্রো পুরুষদের চাইতে ম্রো নারীরা বেশি কর্মঠ আর পরিশ্রমী হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে অনেকেই শিকারের উপর নির্ভরশীল হলেও বেশিরভাগেরাই এখনো জুমচাষ, যৌথ খামার ব্যবস্থা এবং বাগানের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। পরিবারের অর্থনৈতিক সূচকে নারীরাই সবচাইতে বেশি সক্রিয় থাকে। তারা নিজেরাই নিজেদের কাপড় বোনে এবং বাড়িঘরের সমস্ত কাজ নিজেরাই করে থাকে।
ম্রোরা ধর্মপ্রাণবাদী। আবার সমাজ জড়বাদীও বলা যায়। প্রকৃতির অন্তরালে থাকা শক্তিকেই পূজা করে থাকে তাকে। তবে ম্রোদের প্রধান দেবতা ‘তুরাই’। তাদের ধর্মমতে, তুরাই হচ্ছেন এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। এছাড়াও, ম্রোদের ‘সাংতুং’ অর্থাৎ পাহাড়ের দেবতা এবং ‘ওরেং’ নামক নদীর বা পানির দেবতা আছে।
যেকোনো কিছু শুরুর আগে ম্রোরা তুরাইয়ের নামে শপথবাক্য পাঠ করে নিজেকে পরিতুষ্ট করে। দেবতা সাংতুংকে পবিত্রতার প্রতীক মানা হয় এবং জুমচাষে ভালো ফসল প্রাপ্তির লক্ষ্যে এই পাহাড় দেবতার নিকটই প্রার্থনা করে থাকে তারা। গ্রামবাসীর মঙ্গল কামনা এবং মহামারীসহ সকল অশুভ শক্তি থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ম্রোরা দলগতভাবে দেবতা ওরেংয়ের পূজা করে থাকে।
ম্রোরা পরজন্মে বিশ্বাসী নয়। আর তাই বর্তমানই তাদের কাছে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। তাদের কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই। অবশ্য, ম্রো পুরাণে ধর্মগ্রন্থ না থাকার একটি গল্প প্রচলিত আছে, যেটির সাথে এখনকার সময়ের একটা উৎসবও জড়িয়ে আছে। গল্পটা অনেকটা এমন:
একদা সৃষ্টিকর্তা তুরাই সকল সৃষ্টিকে ডাকলেন ধর্মীয় রীতিনীতি সম্বলিত ধর্মগ্রন্থ গ্রহণ করার জন্য। সকল গোত্র বা জাতি উপস্থিত হলেও ম্রোরা সেখানে গেল না। সৃষ্টিকর্তা তুরাই ম্রোদের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন, কিন্তু তাও তারা এলো না। তাই সৃষ্টিকর্তা তুরাই একটা ষাঁড়ের কাছে ধর্মগ্রন্থ দিয়ে ম্রোদের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। কলাপাতায় লেখা ধর্মগ্রন্থটি এনে ম্রোদের প্রধানের হাতে তুলে দেয়াই ষাঁড়টার কাজ। কিন্তু পথিমধ্যে প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতর হয়ে ষাঁড়টি সেই কলাপাতা তথা ধর্মগ্রন্থটি চিবিয়ে খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে।
ফলে ম্রোদের কাছে কোনো ধর্মগ্রন্থ পৌঁছায়নি। ফলে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে নিজেদের পার্থক্য দেখতে পেতে ম্রোরা একদিন সৃষ্টিকর্তা তুরাইয়ের দরবারে যায় মূল কারণ জানার জন্যে। তখন সৃষ্টিকর্তা তুরাই বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলেন। সাথে এও হুকুম দেন যে, শাস্তিস্বরূপ ষাঁড়টিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে। সেই থেকে ম্রোরা ‘নস্যাৎপা’ (ম্রোদের বিশেষ সামাজিক উৎসব) উৎসব উল্লসিতভাবে একটা ষাঁড়কে ঘিরে ধরে নৃত্য পরিবেশন করে এবং বধ করে।
কান ফুটো করার রীতি আছে ম্রো সমাজে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্যই এ রীতি ম্রো সমাজে প্রচলিত। ম্রোদের ভাষায় এর নাম ‘রইক্ষারাম।’ এর আয়োজন করা হয়ে থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর ভোজের মাধ্যমে। জুমচাষে ফসল তোলার পর অবস্থাপন্ন ম্রো পরিবার এক উৎসবের আয়োজন করে থাকে, যার নাম ছিয়াছত-প্লাই। সাধারণত বছরের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস মিলিয়ে এই আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
মেয়ে ও ছেলেরা ম্রোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এবং পুং বাঁশিও বাজিয়ে থাকে। তিনদিন যাবত এই উৎসবে জুমের নতুন ফসল দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় পিঠা তৈরি করা হয়। বছরে দু’বার ম্রোরা পূজা করে থাকে। পূজাকে ম্রো ভাষায় খাং বলা হয়। ফাল্গুন ও আষাঢ় মাসে তিন দিনব্যাপী কেরাই/কাংনাত পূজা করা হয় এবং মহামারীর মতো কোনো রোগের প্রাদুর্ভাবে বসুমতী পূজাও করা হয়ে থাকে; তবে এর কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই।
অন্যান্য পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও ম্রোদের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারের প্রধান তাই পিতা। কিন্তু তা-ই বলে মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা বা অবস্থান সম্পর্কে ম্রো সমাজ বেশ তৎপর। সেজন্যই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েদের কর্তৃত্ব-পূর্ণ ভূমিকা লক্ষণীয়। পুত্ররাই মূলত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। তবে জ্যেষ্ঠ পুত্রের বদলে কনিষ্ঠ পুত্র পায় সম্পত্তির সিংহভাগ।
ম্রো সমাজের রীতিনীতি অনুযায়ী বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মা থাকেন কনিষ্ঠ পুত্রের সঙ্গেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একক পরিবার দেখা গেলেও ম্রো সমাজে যৌথ পরিবারের চলও আছে। গোত্রদের মধ্যে- ভেঙগুয়া (কলাগাছ), প্রেমসেং (মোরগফুল গাছ), কংলাই (বুনো কলাগাছ), মেইজার (কাঁঠাল গাছ), গনারু গ্নর (আমগাছ) উল্লেখযোগ্য।
ম্রো সমাজে নির্দিষ্ট ধর্মযাজকের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। পূজা-পার্বণ থেকে শুরু করে কল্যাণময় পূজা বা বিয়ের আয়োজনও নিজেরাই তথা গোত্রদের মুরুব্বিদের দ্বারাই সম্পাদিত হয়। আধুনিক সমাজব্যবস্থার ভাষায় ‘লাভ ম্যারেজ’ এবং ‘অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ’ ম্রো সমাজেও প্রচলিত।
যখন একজন তরুণ ম্রো পুরুষ তার ১৬তম বছরে পদার্পণ করে, তখন অন্য ম্রো নারীদের আকর্ষণের জন্যে এবং সঠিক সঙ্গী বাছাই করে নেয়ার নিমিত্তে ম্রো রীতিনীতি অনুযায়ী মাথার উপরে চুলের বিনুনি বা খোঁপা পাকিয়ে রাখে। তিনি তার পাগড়ি বা খোঁপাতে ফুলের মাথা গুঁজে রাখেন অলংকরণের জন্যে। সাধারণত, তরুণ ম্রোদের নিজস্ব সঙ্গিনী বাছাই করার অধিকার দেয় ম্রো সমাজ। তবে সঙ্গিনী পছন্দ বা বাছাই হলেও উভয় পক্ষের পিতামাতার অনুমতির প্রয়োজন পড়ে।
বিয়ের আগে অবাধ মেলামেশায় তেমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে দুর্ঘটনাবশত গর্ভবতী হয়ে গেলে অতিসত্ত্বর বিয়ে করানো হয়। ম্রোদের বিয়ে হয় বেশ সংক্ষিপ্ত একটা নিয়মে। বিয়ের দিন একটা ওয়ামা বা মোরগ দা দিয়ে চেপে মারা হয়। মোরগের গলা থেকে বের হওয়া ফিনকি দেয়া রক্ত থেকে পরিবারের একজন বয়স্ক পুরুষ তার মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে খানিকটা রক্ত নিয়ে মেয়ে আর ছেলের মাথা তিলক এঁকে দেয়। এভাবেই মূলত বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে থাকে।
অল্প বয়সে বিবাহিত ম্রো দম্পতিরা মূলত বিয়ের পর কনে বা কনের পরিবারের সাথেই বসবাস করে। বিবাহিত দম্পতিদের বাচ্চাকাচ্চা হলে পরে তাদেরকে আলাদা বাসা বানাতে হয়। আবার, যদি কোনো কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাহলে স্বামী হতে প্রাপ্য সবকিছুই স্ত্রীকে ফেরত দিতে হয় এবং স্ত্রী তার সমস্ত গয়না-পাতি পিত্রালয়ে ফেরত নিয়ে যান। যদিও প্রথম স্ত্রী মারা গেলে স্বামী দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি পায়; কিন্তু নারীদের বেলায় এমনটা সাধারণত ঘটে না। বাল্যবিবাহ কখনো-সখনো দেখা গেলেও বহুবিবাহ বা বহুস্বামী গ্রহণ সমাজে অপ্রচলিত।
ম্রো সম্প্রদায়ের কারোর বাচ্চা হলে নদীর কিনারায় চারটি বাঁশ রাখে তারা। তারপর সেখানে একটি মুরগি জবাই করে সেটার রক্ত বাঁশে রাখা হয়। গ্রামবাসীরা মিলে এক বিশেষ প্রার্থনা করে। তারা বিশ্বাস করে, এতে ঈশ্বর বাচ্চা এবং বাচ্চার কল্যাণে গ্রামবাসীর উপর সন্তুষ্ট হন। এছাড়াও, ম্রোদের প্রচুর পরিমাণে ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান এবং ধর্মানুষ্ঠান আছে।
যেমন ম্রোদের মতে, সূর্য হচ্ছে নারীত্ব দলের সদস্য এবং চাঁদ হচ্ছে পুরুষত্ব। তাই স্থানীয় সংস্কৃতি তাদের মধ্যে ব্যাপক সমৃদ্ধ বলা যায়। আবার, সংস্কৃতি আর ভাষাগত পার্থক্যেও ম্রোদের গোত্রগত পার্থক্য লক্ষণীয়। যেমন- সুঙগমা, আনোঙ, ডোমরঙ, ড়ুম্মা এবং ডোপতেঙ।
ম্রোদের পোশাকেও নারী-পুরুষ ভেদে আছে ভিন্নতা। পুরুষরা নেঙটি পরে। দুই উরুর মাঝখানে আনার একখণ্ড কাপড় কোমরে জড়িয়ে রাখে। আর নারীরা একপ্রস্থ গাঢ় নীল রঙের কাপড় পরে থাকে, যেটি সাধারণত ওয়াঙলাই নামে পরিচিত। মাত্র ছ’ ইঞ্চি প্রস্থের এক কাপড়টির মধ্যভাগে এমব্রয়ডারি বা হাতে বোনা কারুকার্য থাকে। মূলত কোনোক্রমে গোপনাঙ্গ ঢেকে রাখাটাই এই ওয়াঙলাইয়ের মূল উদ্দেশ্য। আর নারীরা মাথার পেছনে বাঁদিকে চুল বাঁধে।
তবে উৎসব-পার্বণে বা নৃত্যের সময়ে সকলেই গাল, ঠোঁট ও কপাল লাল রঙে রঞ্জিত করতে পছন্দ করে। মেয়েরা মাথায় ও কানে ফুল পরে এবং গলায় পুঁতির মালা পরতে ভালোবাসে; ম্রো ভাষায় যাকে কেংঙঅর বলে। মেয়েদের কানে রূপার অলংকার (রামচেং) এবং বাহুতে ধাতুনির্মিত বালা পরে।
নাচের সময় পুরুষরা লাল কাপড় এবং মাথায় পালক ও পুঁতি সজ্জিত পাগড়ি পরে থাকে। আর নারীরা ফুল, হাতের কাজের জামা, পুঁতি এবং মুদ্রা দিয়ে নিজেদের সাজায়। উৎসব চলাকালীন বাদ্যযন্ত্রও ম্রোরা নিজেরাই বানিয়ে থাকে। বাঁশ দিয়ে পাইপের মতো বানানো বাদ্যযন্ত্রের নাম প্লং।
ম্রোদের ভাষাটা মূলত তিব্বত-বার্মার মিশ্র একটি ভাষার সংস্করণ। তবে বাংলাদেশী ম্রো এবং মায়ানমারের ম্রোদের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ম্রো ভাষাভাষীরা বান্দরবান জেলার চিম্বুক পাহাড়ের কাছে লামা, রুমা, আলিকদম এবং থানচির বনাঞ্চল জুড়ে বসবাস করে। আর গুটি সংখ্যক ম্রোদের রাঙামাটিতেও দেখা যায়।
ম্রো বর্ণমালা তৈরিতে যে লোকটির অবদান সবচাইতে বেশি, তার নাম মেনলে বা ম্যানলে ম্রো, যিনি ম্রো রূপকথায় বর্ণিত এক মহা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে ম্রো বর্ণমালা উদ্ভবের ঘটনায় বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। প্রায় ৮০ শতাংশ ম্রো নিজেদের হস্তলিপিতে দক্ষ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম তিনটি বছরও এই বিষয়েই দীক্ষা দেয়া হয়।
ম্রো ভাষায় আবার চারটি উপভাষার দেখা মিলে। যথা- আরাং (আহারিং খামি, আরুয়েং, আরুয়াং), জেংগনা (হ্রেরংগনা), জ্যাটা, ভাকুং (ওয়াকুন, ওয়াকুং)। তবে ম্রো (ওয়াকিম) হচ্ছে বহুল প্রচারিত আর সর্বাধিক সমঝদার ভাষা। তবে জানা যায়, ইদানীংকালে লেখার ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দের ব্যবহারের প্রচলন আছে। যদিও তাদের নিজস্ব বর্ণমালা, অক্ষর আর শব্দসহ আস্ত একটা ভাষাই আছে।
তবে ম্রো সমাজেও আধুনিক পালাবদলের ছোঁয়া লেগেছে। আর তাই, সপ্তাহের হাটবারে বাজারে যাবার সময় পুরুষদের লুঙি ও জামা এবং মেয়েদের তোলা জামা পরতে দেখা যায়। নারীদের মতো পুরুষরাও চুল লম্বা রাখে এবং কপালের উপর পেঁচিয়ে পাগড়ি দিয়ে ঢাকা থাকে। শরীরের বিভিন্ন অংশ এবং ঠোঁটে ছেলে-মেয়ে উভয়েই রং লাগিয়ে থাকে। এছাড়াও, কানে দুল সহ আরো বিভিন্ন ধরনের গয়না ব্যবহার করতেও দেখা যায়।
বর্তমানে মতান্তরে প্রায় ২২০০০-২৫০০০ ম্রো পরিবারের বাস পার্বত্য চট্টগ্রামে। ম্রোদের নিয়ে লেখা বইগুলো এখানে পাবেন। আর হ্যাঁ, ম্রোরা বেশ শান্তিপ্রিয় এবং মিশুক স্বভাবের। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে গেলে অবশ্যই নিতে পারেন তাদের আতিথেয়তা। যা আপনাকে মুগ্ধ করবে।
সংস্কৃতির চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/