কারে দেখাব মনের দুঃখ গো
আমি বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষেরই অনল
জ্বলে গইয়া গইয়াঘর বাঁধলাম প্রাণবন্ধের সনে
কত কথা ছিল মনে গো
ভাঙিল আদরের জোড়া
কোনজন বাদী হইয়া
জ্বলে গইয়া গইয়াকার ফলন্ত গাছ উখারিলাম
কারে পুত্রশোকে গালি দিলাম গো
না জানি কোন অভিশাপে
এমন গেল হইয়া
জ্বলে গইয়া গইয়াকথা ছিল সঙ্গে নিব
সঙ্গে আমায় নাহি নিল গো
রাধারমণ ভবে রইলজিতে মরা হইয়া
জ্বলে গইয়া গইয়া।
জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারিত এই গানটির বিষয়ে যদি একশজনকে জিজ্ঞেস করা হয় গানটি কার, তাহলে প্রায় সবারই উত্তর হবে অ্যান্ড্রু কিশোর। কারণ সুদীর্ঘকালব্যাপী এই গানটি কিংবদন্তি শিল্পী অ্যান্ড্রু কিশোরের গলায় শুনে শুনে সবারই ধারণা হয়ে গেছে, গানটি বোধহয় তারই। কিন্তু আসলে তা নয়। এই গানটির মূল শিল্পী, গীতিকার, সুরকারের নাম হলো রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ। যাকে সবাই রাধারমণ নামেই চেনে।
ভাটি বাংলার অন্যতম একটি জেলা সুনামগঞ্জ। হাওড়-বাওড়, নদ-নদী, পাহাড়-টিলা অধ্যুষিত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি সুনামগঞ্জ। এই সুনামগঞ্জে যুগে যুগে অসংখ্য মরমি কবি, বাউল, সাধক, গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, আধ্যাত্মিক ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। দেওয়ান হাছন রাজা, বাউল সম্রাট শাহ্ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, সৈয়দ শাহনুর, আছিম শাহ, কালা শাহ, আরকুম শাহ, শীতালং শাহ, ছাবাল শাহ, এলাহী বক্স মুন্সী, শাহ আছদ আলী, পীর মজির উদ্দিন, আফজল শাহ, কামালউদ্দীন, একলিমুর রাজা চৌধুরী, গণিউর রাজা চৌধুরী, দীননাথ বাউল, গিয়াসউদ্দীন আহমদ, মকদ্দস আলম উদাসী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
জীবনভর তাদের দীর্ঘ সাধনায় সৃষ্ট জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ঘেঁটুগান, গাজীর গান, মালজোড়া বা কবিগান, কীর্তন, ধামাইল গানগুলো বৃহত্তর সিলেট, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়সহ অনেক অঞ্চলকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি আমাদের বাংলা লোকগানের ভাণ্ডারে যোগ করেছে অসাধারণ মাত্রা। এই সাধকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামের খ্যাতির আড়ালে থাকা বিখ্যাত গীতিকবি ও সাধক রাধারমণ দত্ত।
রাধারমণ দত্তকে অনেক অভিধায় অভিহিত করা যায়। তিনি একাধারে ছিলেন মরমি কবি, বৈষ্ণব সহজিয়া ঘরানার সাধক, ধামাইল গানের জনক কিংবা লোকায়ত বাংলার মহান কণ্ঠস্বর। জীবনের বড় একটা অংশ যিনি কাটিয়ে দিয়েছেন অনন্তের সন্ধানে, তেমনি প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, দেহতত্ত্ব, ভজন, ভক্তি, রাধাকৃষ্ণের আকুলতা নিয়ে বেঁধেছেন গান। নিজে কখনও সেসব গান না লিখলেও তার ভক্তরা শোনার সাথে সাথেই পুঁথিবদ্ধ করে ফেলতেন। এভাবে তিনি সৃষ্টি করে গেছেন তিন সহস্রাধিক গান, যা তাকে একজন কিংবদন্তি অমর গীতিকবি ও সুরসাধকের আসনে আসীন করেছে।
রাধারমণ দত্তের জন্ম ১৮৩৩ সালে, জগন্নাথপুরের খ্যাতিমান ও প্রভাবশালী এক পরিবারে। তার পূর্বপুরুষদের নামে যেখানে তিনটি এলাকার নাম আছে। এলাকাগুলো হলো জগন্নাথপুর, প্রভাকরপুর ও কেশবপুর। কেশবপুরেই তৎকালীন খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও কবি রাধামাধব দত্ত পুরকায়স্থের ঘরে জন্ম নেন রাধারমণ দত্ত। তার মায়ের নাম সুবর্ণা দেবী। বৈষ্ণব-সহজিয়া দর্শনে দীক্ষিত তার বাবা ছিলেন বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার বড়মাপের পণ্ডিত। তার বাবার লেখা সহজিয়া গানগুলোও ছিলো চমৎকার। তিনি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার কবি ও অনুবাদকও ছিলেন। মহাকবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের স্বচ্ছন্দ টীকাভাষ্য রচনা করেন তিনি। বাংলা ভাষায় ‘কৃষ্ণলীলার গীতিকাব্য’, ‘পদ্মপুরাণ’, ‘সূর্যব্রত পাঁচালী’, ‘গোবিন্দ ভোগের গান’ প্রভৃতি বই তার লেখা।
তাছাড়াও সংস্কৃত ভাষায় তিনি কয়েকটি বই লিখেছিলেন, যার মধ্যে ‘ভারত সাবিত্রী’ ও ‘ভ্রমরগীতিকা’ উল্লেখযোগ্য। পিতার সংগীত ও সাহিত্য সাধনা শিশু রাধারমণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। রাধারমণ দত্তরা ছিলেন তিন ভাই। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। রাধারমণ মাত্র ১০ বছর বয়সে পিতৃহারা হন। সেই থেকে মা সুবর্ণা দেবীর আদর-যত্নে বেড়ে ওঠেন তিনি।
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার আদপাশা গ্রামের নন্দকুমার সেন অধিকারীর কন্যা গুণময়ী দেবীকে। রাধারমণ-গুণময়ী দেবীর চার পুত্রসন্তান ছিলেন। নাম ছিল রাজবিহারী দত্ত, নদীয়াবিহারী দত্ত, রসিকবিহারী দত্ত ও বিপিনবিহারী দত্ত। কিন্তু স্ত্রী ও তিন পুত্র অকালেই মারা যান, শুধু বেঁচে থাকেন বিপিনবিহারী দত্ত। মামার বাড়ি মৌলভীবাজারের ভুজবলে গিয়ে সেখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যান বিপিনবিহারী। তিনিও অবশ্য রাধারমণের জীবদ্দশায়ই মারা যান। স্ত্রী ও তিন পুত্রসন্তানের প্রয়াণের পরে সংসারে জনশূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার যন্ত্রণা তাকে সংসারজীবনের প্রতি উদাসীন করে তোলে।
একপর্যায়ে তিনি মৌলভীবাজার জেলার ঢেউপাশা গ্রামে সাধক রঘুনাথ ভট্টাচার্য্য বা স্বামী রঘুনাথ মহাশয়ের আশ্রমে চলে যান, গ্রহণ করেন তার শিষ্যত্ব। রঘুনাথ গোস্বামীর কাছ থেকেই বৈষ্ণব সহজিয়া মতবাদের দীক্ষা গ্রহণ করতে থাকেন। সাধন-ভজনের মাধ্যমে শুরু হয় তার বৈরাগ্য জীবন। জীবনের প্রতি অনন্ত জিজ্ঞাসা তাকে গৃহত্যাগ করতে উদ্ধুদ্ধ করে। সেই কৌতূহল থেকেই একসময় বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব ধর্ম বা মতবাদের চর্চা করেছিলেন। কিন্তু সেগুলোতে তিনি খুঁজে পাননি তার চির-আরাধ্য শান্তি। সেজন্যই পিতার ভাবধর্মে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
গুরু রঘুনাথ গোস্বামীর দীক্ষা নিয়ে তিনি জগন্নাথপুরের অন্তর্গত নলুয়ার হাওরের পাশে একটি নির্জন কুটির নির্মাণ করে সেখানেই করতে থাকেন বৈষ্ণব সহজিয়া ধর্মের সাধনা। লোভ, হিংসা, অহঙ্কার, কাম, বাসনা, ক্রোধ, মায়া ত্যাগ করে সহজিয়া মতবাদের একের পর এক স্তর পেরিয়ে লাভ করেন সিদ্ধি। সেখানে বসেই সৃষ্টি করেন অসংখ্য গান। তার ভাবশিষ্যরা সেসব গান শুনে শুনে লিখেও রাখেন। আজকে যে গানগুলো তাকে নিয়ে গেছে অমরত্বের দিকে।
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই নভেম্বর, ৮২ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন রাধারমণ দত্ত। তাকে হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী দাহ না করে সহজিয়া মতাদর্শে সমাধিস্থ করা হয়। জগন্নাথপুরের কেশবপুরে তার নামে একটি সমাধিমন্দির আছে। রাধারমণ দত্তের স্মৃতি রক্ষায় ইতোমধ্যে সরকারও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাধারমণ কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ৬০ শতক জায়গা ঠিক করা হয়েছে। তার পৈতৃক ভিটায় রাধারমণ দত্ত কমপ্লেক্স তৈরি করার কথা গণমাধ্যমেও এসেছে।
রাধারমণ তার অনেক গানে ‘ভাইবে রাধারমণ বলে’ কথাটির উল্লেখ করেছেন। ‘ভাইবে’ মানে হলো ভাবিয়া বা ভেবে। রাধারমণের গান যেমন অনেক, তেমন তার গানের বিষয়ও প্রচুর। তিনি অসংখ্য ভক্তিমূলক গানও রচনা করেছেন। তিনি ধামাইল গান ছাড়াও কীর্তন, গৌরপদ, গোষ্ঠ, অভিসার, মালসী, প্রার্থনা প্রভৃতি গান রচনা করে গেছেন। তবে তার সৃষ্ট গানের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বিরহ আর ধামাইল গানগুলোই পেয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা।
কারে দেখাব মনের দুঃখ’, ‘কলঙ্কিনী রাধা’, ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’, ‘আমারে আসিবার কথা কইয়া’, ‘আমার বন্ধু দয়াময়’, ‘আমি রব না রব না গৃহে’, ‘পালিতে পালিছিলাম পাখি দুধ-কলা দিয়া’, ‘শ্যাম কালিয়া প্রাণ বন্ধুরে’, ‘মনে নাই গো আমারে বন্ধুয়ার মনে নাই’, ‘বংশী বাজায় কে গো সখী’, ‘আমার গলার হার’, ‘বিনোদিনী গো তোর’, ‘দেহতরী ছাইড়া দিলাম’, ‘কার লাগিয়া গাঁথো রে সখী’ প্রভৃতি গান ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট, আসাম, শিলিগুড়ি অঞ্চলে ধামাইল গানগুলো আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
বিশেষ করে সিলেটের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝেও হিন্দু-মুসলমান সকল বিয়েতেই ধামাইল গানের তালে তালে বিশেষ একধরনের নৃত্যের প্রচলন আছে অনেক আগে থেকেই। এই ধামাইল গান ও নৃত্য আঞ্চলিকতা ছাড়িয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেও এখন সমাদৃত। যদিও বিয়েশাদিতে এখন আর আগের মতো ধামাইল দেখা যায় না খুব একটা।
ধামাইল গানের সঙ্গে ‘ভাইবে রাধারমণ বলে’ ধ্বনিটি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে, যা রাধারমণের গানের স্বকীয়তাকে বহন করে। যদিও ধামাইল নৃত্যে রাধারমণ ছাড়াও মহেন্দ্র গোসাই, দীন শরৎ প্রমুখের গানও গীত হয়, কিন্তু ৯৫ ভাগ ধামাইল গানই রাধারমণের। ফলে অনায়াসেই ধামাইল গানের জনক হিসেবে তাকেই অভিহিত করা হয়ে থাকে। তার রচিত ধামাইল গানে যেমন রয়েছে বিষয়ের বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে সুর, ছন্দ, বর্ণনারও মাধুর্য। তবে ধামাইল গানের একটি নিজস্ব গায়নরীতি আছে। এ রীতি শ্রীহট্ট ও তার আশপাশের অঞ্চলের আঞ্চলিক জীবনধারা থেকে নেয়া হয়েছে।
সাধারণত শিল্পীরা তালে তালে করতালির মাধ্যমে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে এই গান পরিবেশন করে থাকেন। তাদের মুখে মুখে থাকে গানের কলি আর ছন্দে ছন্দে ফেলেন পা। হাতের মধ্যেও থাকে তাল, গতি ও মুদ্রা। ঢোল, করতাল প্রভৃতি এসব গানের বাদ্যযন্ত্র। অবশ্য বাদ্যযন্ত্র ছাড়া হাততালি দিয়েও এ গান গাওয়া যায়। বাজনার তালে তালে, সুরের তালে তালে ধামাইল গানের গতি বাড়তে থাকে। প্রথমে করা হয় বন্দনা তথা স্রষ্টার গুণগান। এটি তাল ছাড়া শুধু সুরে গাওয়া হয়।
ধামাইল গানের গতি যেভাবে এগিয়ে যায় তা হলো ক- বন্দনা, খ- আহ্বান বা আসরস্তুতি, গ- উদয়, ঘ- বাঁশি, ঙ- জলভরা, চ- শ্যামরূপ, ছ- গৌররূপ, জ- আক্ষেপ, ঝ- বিচ্ছেদ, ঞ- কুঞ্জ, ট- মানভঞ্জন, ঠ- মিলন, ড- সাক্ষাৎ এবং ঢ- বিদায়। অদ্ভুত সুন্দর এক ব্যঞ্জনায় ধামাইল গান আর নৃত্য দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধতার আবেশে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
রাধারমণ যেহেতু গানের কোনো লিখিত সংগ্রহ রেখে যাননি, সেহেতু তার গান সংগ্রহ করে সেগুলো বই আকারে নিয়ে আসা অনেক পরিশ্রম ও দুঃসাধ্যের কাজ। তারপরও জগন্নাথপুরের গ্রামে গ্রামে গিয়ে অনেক লোক গবেষক ও সংগ্রাহক অসংখ্য গান সংগ্রহ করে সেগুলো ছাপার অক্ষরে নিয়ে এসেছেন। আবার অনেক গান সংগ্রহ করা যায়নি। কারণ রাধারমণের শিষ্যদের অনেকেই মারা গেছেন, অনেকেই জগন্নাথপুর এলাকা ছেড়ে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে গেছেন, অনেকেই পার্শ্ববর্তী দেশে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। ফলে অনেক গানই হয়তো হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে।
তবু যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের অসংখ্য গান উপহার দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন সাহিত্যরত্ন, যিনি ৪৭টি রাধারমণ গীতি সংগ্রহ করেছিলেন। তিনিই প্রথম রাধারমণের গান সংগ্রহ করে সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়া যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য (৫৭টি রাধারমণ গীতি), হোসেন আলী (০৬টি রাধারমণ গীতি), সৈয়দ মুরতজা আলী (০৫টি রাধারমণ গীতি), মুহাম্মদ নুরুল হক (১১টি রাধারমণ গীতি), আবদুল গাফফার চৌধুরী (৫৯টি রাধারমণ গীতি), অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন (৫৫টি রাধারমণ গীতি), সুধীরচন্দ্র পাল (১২টি রাধারমণ গীতি), গুরুসদয় দত্ত ও ড. নির্মলেন্দু ভৌমিক (৬৩টি রাধারমণ গীতি), মুহম্মদ আবদুল হাই (১০৬টি রাধারমণ গীতি), চৌধুরী গোলাম আকবর (৩৩২টি রাধারমণ গীতি), যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য ও বিজনকৃষ্ণ চৌধুরী (৮৯৬টি রাধারমণ গীতি), জোতিরিন্দ্রনাথ চৌধুরী (১১টি রাধারমণ গীতি), ড. তপন বাগচী (১০১৯টি রাধারমণ গীতি), নন্দলাল শর্মা (১১৭৭টি রাধারমণ গীতি), অমলেন্দু কুমার দাশ (১৩৯টি রাধারমণ গীতি), মুহম্মদ আসাদ্দর আলী (১১টি রাধারমণ গীতি), আবদুস সামাদ (৩৭টি রাধারমণ গীতি) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য সংগ্রাহক হিসেবে পরিগণিত হন।
তাদের বাইরে আরও অনেক গুণীজন রাধারমণের গান সংগ্রহ করে সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তারা হলেন পারুল রানী দে, নরেশচন্দ্র পাল, যামিনী কান্ত শর্মা, সতীশ চন্দ্র রায়, অমিতবিজয় চৌধুরী, তারেক আহমেদ চৌধুরী, মোহাম্মদ সুবাসউদ্দীন, মোহাম্মদ আলী খান, সুমন কুমার দাশ, রামকৃষ্ণ সরকার, অমলেন্দু কুমার দাশ, নন্দলাল শর্মা, মোহাম্মদ সুবাসউদ্দীন, বিশ্বজিৎ রায়, ড. মোহাম্মদ আলী খান, সৈয়দা আঁখি হক, নৃপেন্দ্রলাল দাশ, তারেক আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ।
রাধারমণের গান নানাভাবে প্রচার হচ্ছে এখন। যদিও সেসব গানের শিল্পীরা পর্যন্ত জানেন না গানের স্রষ্টার নাম। অনেক রিয়েলিটি শো থেকে শুরু করে টিভি, রেডিও এমনকি বাণিজ্যিক গানের অ্যালবামেও রাধারমণের গানের কথা ও সুর হিসেবে ‘সংগ্রহ’ লেখা হচ্ছে। যা শুধু দুঃখজনকই নয়, এই মহান সাধক ও সুরস্রষ্টার সাধনার প্রতি অবজ্ঞাও। দেশে অবহেলা হন যিনি তিনিই বিদেশে হন সমাদৃত। ভারতের কলকাতার বিখ্যাত ব্যান্ড ‘দোহার’ রাধারমণের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার গানগুলো তুলে ধরছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্নভাবে। এমনকি তাজিকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী নইজা কারুমাতুল্ল ‘ভ্রমর কইও গিয়া’ গানটি মূল সুরে তাদের ভাষায় গেয়ে বিশ্বকে চমকে দিলেও রাধারমণ ভক্ত বা দেশের অনেকেই তা জানেন না এখনও। তাজিক ভাষায় গানটির প্রথম দুটি চরণ এভাবেই গাওয়া হয় –
“খুজই, খুজই, খুজ, বারান্দাই, সিকাআস্তাবলে
রুই দোস্তয়া কিপরে ফিতা দুমুত মারমুদা…”
সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে আমরা অনেকেই তাজিক শিল্পীর এই পরিবেশনা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু এই গানটিও যে রাধারমণের, তা-ও খুব কম লোকই জানেন!
সুনামগঞ্জের আরেক মরমি কবি দেওয়ান হাসন রাজা ও রাধারমণ ছিলেন সমসাময়িক। তাদের মধ্যে চমৎকার সম্পর্কও ছিলো। তারা একে অপরকে চিঠিও লিখতেন। একবার হাসন রাজা রাধারমণের কুশল জানতে গানের চরণ বাঁধেন: ‘রাধারমণ তুমি কেমন, হাছন রাজা দেখতে চায়’। উত্তরে রাধারমণ লিখেন: ‘কুশল তুমি আছো কেমন- জানতে চায় রাধারমণ’। হাসন রাজা আর রাধারমণের মধ্যে মিল আছে আরও। দুজনেই প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, দেহতত্ত্ব আর সেই অনন্ত সত্ত্বাকে তালাশ করেছেন গানে, সাধনায়।
রাধারমণ দত্তের নির্দিষ্ট জন্মতারিখ জানা না গেলেও মৃত্যুতারিখ ১০ই নভেম্বর হিসেবে তার জন্মভূমিতে উদযাপন হয়ে থাকে। এমন একজন গুণী সাধকের প্রয়াণ দিবস জাতীয়ভাবে কতটা উদযাপন হয়? ক’জন জানে তার অমর কীর্তিগুলোর কথা? এই প্রশ্নগুলো বিদগ্ধজনদের করা উচিত। রাধারমণের অহিংসা, নিরহঙ্কার, নির্লোভ দর্শন এই সমাজ, রাষ্ট্রে চর্চা করলে, তার সৃষ্ট গানগুলোকে বৈশ্বিক আঙিনায় ছড়িয়ে দিলেই কেবল তার প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা জানানো হবে।