রমজান মাস মানেই ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পুরো একটি মাসের উদযাপন। বিভিন্ন মুসলিম দেশে রমজানের এই মাস পালন করা হয় নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী কায়দায়। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক কোন দেশে রমজানের ঐতিহ্য কেমন।
পুরান ঢাকার ইফতার বাজার, হামদ-নাত, বাংলাদেশ
বড় বাপের পোলায় খায়, টানা পরাটা, শাহী হালিম, শাহী জিলাপি, নূরানি লাচ্ছি, ঘুগনি, ছোলা সহ মুখরোচক সব খাবারের পসরা বসে বহু বছরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা পুরান ঢাকায়। পুরো ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এখানে ভিড় জমায় ইফতার কেনার জন্য। রমজান শুরুর কয়েক দিন আগে থেকেই বিভিন্ন শপিং সেন্টার আর খাবারের দোকানগুলোতে চলে সাজ সাজ রব। রমজান মাস জুড়ে ইফতারের আগে আগে সব জায়গায় শোনা যায় হামদ-নাত।
পাকিস্তানি ইফতার রেসিপি, পাকিস্তান
পাকিস্তানে রমজান মাস উদযাপন মানেই বাহারি ইফতারের সমাহার। যুগ যুগ ধরে এই দেশের মুসলিমরা ইফতারে আয়োজনে করে আসছে নানা ধরনের স্পেশাল আইটেম। ঘরে তো বটেই, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ইফতারের অনুষ্ঠান করাটাও তাদের রীতির মধ্যে পড়ে। তাদের ঐতিহ্যবাহী ইফতারের মেন্যুতে থাকে- চানা চাট, দই বালাই, কাল্লি (নুডলস্ স্যুপ), নামাক পাড়া (অনেকটা নিমকির মতন), পাপড়, ভেজিটেবল পাকোড়া, শামি কাবাব ও ফ্রুট সালাদ। এছাড়াও আরও রকমারি আইটেমের দেখা মিলে তাদের ইফতারের টেবিলে।
রমজানের ‘লণ্ঠন’ বা ‘ফানুস’, মিশর
রমজানে বিভিন্ন দেশে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও মসজিদগুলোতে আলোকসজ্জা দেখা যায়। কিন্তু মিশর এদিক দিয়ে কিছুটা ভিন্ন। এখানকার বাড়ি-ঘর, ভবন ও দোকানগুলোর প্রবেশের মুখে ঝুলিয়ে রাখা হয় রঙিন সব ফানুস। নানান রঙ ও বৈচিত্র্যে বানানো এই ফানুসগুলো এক বিশেষ ধরনের লণ্ঠন। রমজান মাসে চারিদিকে ঝোলানো এই ফানুসগুলোর আলোকসজ্জায় পুরো মিশর এক অপূর্ব রূপ ধারণ করে। তাই বলেই হয়তবা মিশরের রমজান মাস ‘ফানুস রমজান’ নামেও পরিচিত।
মিশরের এই ফানুস ঝোলানোর ঐতিহ্য প্রায় কয়েক’শ বছর পুরানো। ৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মিশরীয়রা খলিফা আল-মুয়িজ লি-দ্বীন-কে অভিবাদন জানানোর জন্য এরকম আলোকসজ্জার আয়োজন করেছিলো। এই আলোকসজ্জা খলিফার এতটাই পছন্দ হয় যে তিনি এর কারিগরদের নির্দেশ দেন বাণিজ্যিকভাবে এগুলো তৈরি করে সারা মিশরে এর প্রসার ঘটাতে। আর মিশরের বাসিন্দাদের নির্দেশ দেন যেন তারা সবাই নিজেদের বাড়ি-ঘরের সামনে এই ফানুস ঝুলায়। এরপর থেকেই মূলত এই ফানুস ঝুলানোর সংস্কৃতি শুরু হয়।
তোপধ্বনি, ড্রাম, কানদিল, ইফতারিয়া; তুরস্ক
এই মুসলিম দেশটিতে রমজান মাস মানেই রাজকীয় আয়োজন। পবিত্র এই মাসে প্রতিদিন তিনবার (সেহরি খাওয়ার জন্য, রোজা রাখার জন্য ও সেহরির শেষ সময় জানানোর জন্য) তোপধ্বনি দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই তোপধ্বনি দেয়া হয় রমজানকে স্বাগতম জানানোর জন্য। এই তোপধ্বনি দেয়ার সময়েই সেখানকার মসজিদের মিনারগুলোতে জ্বালানো হয় কানদিল নামের বাতি। আর এই বাতিগুলো জ্বলতে থাকে সূর্যোদয় পর্যন্ত। তুরস্কে কানদিল জ্বালানোর এই ঐতিহ্য শত বছর পুরনো।
সেহরির সময় রোজাদারদের জাগানোর জন্য আরো একটি পদ্ধতি তাদের আছে, সেটি হলো ড্রাম বাজানো! শুধু যে ড্রাম বাজানো হয় তা-ই নয়, এর সাথে খোলা গলায় গানও গাওয়া হয়। সুন্নতি কায়দায় খুরমা খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙার পর শুরু হয় ‘ইফতারিয়া’। ইফতারের এই অংশে থাকে বিশেষ কিছু আইটেম। যেমন- ‘বারেক’ নামের এক ধরনের পেস্ট্রি খাওয়া হয় যা বানানো হয় জলপাই ও পনির দিয়ে। এছাড়াও থাকে পেসতারমা (গরুর মাংস দিয়ে বানানো), সুজুক (এক ধরনের সস) ও পিদে (তুর্কি রুটি)। রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন বিলবোর্ড টাঙানো হয় রমজানের অভিনন্দন জানিয়ে, আনন্দ প্রকাশ করে ও হাদিস লিখে।
কামান দাগিয়ে রমজান পালন, মক্কা
তুরস্কের মতো মক্কা নগরীতেও রমজান মাসে তোপধ্বনি দেয়া হয়, কিন্তু এখানে দেয়া হয় দু’বার। প্রথমবার সেহরির শেষ সময় জানাতে এবং দ্বিতীয়বার ইফতারের সময় জানাতে। মূলত ৮৫৯ হিজরিতে মিশরের সুলতান মাগরিবের ওয়াক্ত জানানোর জন্য পরীক্ষামূলকভাবে কামান চালান। এই কামান চালনাকেই এখানকার মানুষ ধরে নিয়েছে যে এটাই ছিলো সুলতানের ইফতারের সময় জানানোর একটি পদ্ধতি। তখন থেকেই মক্কায় এটি একটি রেওয়াজ হিসেবে চলে আসছে।
‘রাইভারু’, মালদ্বীপ
নয়নাভিরাম এই দেশটিতে রোজার মাস কাটানো হয় বেশ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে ইফতারের সময়ে সেখানকার কবিরা ‘রাইভারু’ নামে রমজান সম্পর্কিত এক ধরনের কবিতা আবৃত্তি করে থাকেন। এই কবিতাগুলো তিন বা তার বেশি লাইনের হয় যেগুলো একটু ভিন্ন ধাঁচের সুরে আবৃত্তি করা হয়ে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই মালদ্বীপে এই ‘রাইভারু’ আবৃত্তির সংস্কৃতি চলে আসছে। তারা ইফতারেও ভিন্ন রকমের আইটেম করে থাকে। যেমন- ‘কুলহি বোয়াকিবা’ (মাছ দিয়ে তৈরি এক ধরনের কেক), ‘ফোনিবোয়াকিবা’ (ময়দা দিয়ে বানানো কেক) ও ‘গুলহা’ (মাছের কোফতা)।
সামাজিকতা বৃদ্ধির রেওয়াজ, কোমোরোস
উত্তর আফ্রিকার দেশ কোমোরোসে রমজান মাস মানেই সমাজে সবার মধ্যে একাত্ম হওয়ার রেওয়াজ। ইফতারের ঠিক পরপরই এখানকার লোকজন জমায়েত হয় ‘বানগাওয়ি’ নামের জায়গায় যায় যেখানে জনসমাগম বেশি। সেখান থেকে সবাই মিলে মসজিদে যায় যেখানে তারা একসাথে কফি ও খেজুর খায়। নামাজ শেষে আবার সবাই যে যার বাড়িতে চলে আসে। বাসায় ফিরে তারা বিভিন্ন স্পেশাল আইটেম, যেমন-ভাজা কলা, মাছ ও মাংস দিয়ে বানানো আইটেম ও প্যানকেক খায়।
‘সিগার’ ও রাতের বাজার, আলজেরিয়া
অন্য যেকোনো সময় থেকে রমজান মাসটা একবারেই ভিন্ন ঢঙে কাটান উত্তর আফ্রিকার সমৃদ্ধশালী এই দেশটির নাগরিকেরা। সারা রমজান মাসের প্রতিটি রাত সেখানকার বাজারগুলো যেন মুখর হয়ে থাকে মানুষজনের আনাগোনায়। রাস্তাঘাটগুলোও থাকে লোকে লোকারণ্য। মানুষ বাজার থেকে বাজারে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করে। এছাড়াও নানা ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই আয়োজন ও বাজারে কেনাকাটা চলে সেহরি পর্যন্ত। রাতের এই আয়োজনের জন্যই তাদের সকালের কাজ রমজান মাসে শুরু হয় নিয়মিত সময় থেকে এক ঘণ্টা পর। তারাবিহ্র নামাজের পর তারা কাঁচা কাঠবাদাম দিয়ে বানানো এক রকম শরবত খায়। আর এই শরবতের নামই হলো ‘সিগার’।
‘দ্য রিং গেম’ , ইরাক
এক বিশেষ ধরনের খেলাই ভিন্নতা এনেছে ইরাকের রমজান পালনে। বিখ্যাত এই রীতিটি ইরাকের বহু পুরাতন ঐতিহ্য। ‘দ্য রিং গেম’ নামের এই খেলায় দুটি দল থাকে। আর দুটি দলের প্রত্যেকটিতে ১০-২০ জন করে মানুষ থাকে। একই দলের একজন অন্যজনকে রিংটি দেয় এবং অপরপক্ষকে বলতে হয় যে ঠিক কার হাতে রিংটি রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে অঙ্ক অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। এসব অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য মূলত যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য ত্রান তহবিল সংগ্রহ করা।
বাড়ি-ঘরে রঙের ছটা ও ‘এফতোর’, মরক্কো
সারা বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে রমজানের ২-৩ দিন পূর্বে প্রস্তুতি নেয়া শুরু হলেও এই দেশে রমজানের প্রস্তুতি শুরু হয় ২-৩ সপ্তাহ আগে থেকে। মরক্কোর লোকেরা তাদের বাড়ি-ঘর রঙ করে, বাড়ির চারদিক পরিস্কার করে ও রান্নাঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র একদম নতুনের মতো চকচকে করে ফেলে। আত্মীয় আর বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে চলে একে অপরের বাসায় দাওয়াত দেওয়া-নেওয়ার পালা। এ সময়ে এখানকার রাস্তাগুলো পরিণত হয় খাবারের বাজারে। মরক্কোয় ইফতারকে বলা হয় ‘এফতোর’। তাদের ‘এফতোর’-এ থাকে নানান ঐতিহ্যবাহী খাবার। যেমন- রিজ্জা, ক্রাচেল, মিস্সামেন, হারিরা, ব্রিওয়াত, স্টিল্লা, হারশা, স্যাল্লো, রিজ্জা, মালবি, বাঘরির, এবং কুসকুস। মরক্কোর অধিবাসীরা একটু বেশি সময় নিয়েই ইফতার করে থাকেন।
‘গারাংগাও’, কাতার
প্রতি বছর ১৪ রমজানের দিন কাতারে পালন করা হয় ‘গারাংগাও’। মূলত শিশুদের রোজা রাখাকে প্রশংসা জানাতে ও উৎসাহী করে তুলতে এই আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই দিনে এখানকার শিশুরা কাতারের ঐতিহ্যবাহী এক ধরনের পোশাক পড়ে এবং মাগরিবের নামাজের পর সুসজ্জিত ব্যাগ নিয়ে ঐতিহ্যবাহী ‘গারাংগাও’ গান গেয়ে গেয়ে আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। সেসময় বাচ্চাদের মিষ্টি ও চকলেট দেওয়া হয়।
পবিত্রতার এই মাসে বিভিন্ন দেশের মানুষেরা সংযম করার সাথে সাথে পালন করে যায় তাদের নিজেদের ঐতিহ্যবাহী এসব রীতিনীতি। তাই রমজান মাস এসব জায়গায় শুধু যে সিয়াম সাধনার মাস তা-ই নয়, বরং ঐতিহ্যগুলোকে চর্চা করার সময়ও বটে!