গ্রিক পুরাণে টাইটান নামে একধরনের প্রবল প্রতাপশালী চরিত্রের উপস্থিতি দেখা যায়। প্রতিপত্তির দিক থেকে তারা অসীম ক্ষমতাধর হলেও কিছু সীমাবদ্ধতা তাদের ছিলো। তারা নিজের সন্তানদের কাছে প্রতিপত্তি হারানোর ভয় পেতেন। এই কারণে ক্রোনোস নামে একজন টাইটান জন্মের পরপরই তার প্রত্যেক সন্তানকে খেয়ে ফেলতেন। রোমান ভাষায় ক্রোনোস স্যাটার্ন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গ্রিক পুরাণে উল্লেখ করা ক্রোনোসই দেবতাদের সম্রাট জিউসের পিতা।
দৃশ্য হিসেবে এটি নিঃসন্দেহে বেশ ভয়ঙ্কর। একইসাথে পৌরাণিক কল্পনার আলো-আঁধারির মিশ্রণের অনুভূতি দেয়ার মতো। একজন কালজয়ী শিল্পী অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেবার মতো দৃশ্যকেও অমর করে রাখতে পারেন তার রং তুলির মাধ্যমে। ১৮১৯ থেকে ১৮২৩ সালের মধ্যে অন্য কিছু ছবির সাথে এই ছবিটিও এঁকেছিলেন এক অমর স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী। তার নাম ফ্রান্সিসকো গয়া (১৭৭৬-১৮২৮)।
পশ্চিমা শিল্পকলার ইতিহাসে রোমান্টিক আন্দোলন বেশ উজ্জ্বল এক সময়কাল। চিত্রশিল্পের প্রথাগত ও অনড় ব্যাকরণ থেকে বেরিয়ে এসে এ আন্দোলনের শিল্পীরা প্রকৃতির অপার বিস্ময়, নিবিড় আধ্যাত্মিকতা, মনের গাঢ় অন্ধকার অনুভূতি ও জীবনের অব্যক্ত রহস্য সার্থকভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। স্প্যানিশ শিল্পী ফ্রান্সিসকো গয়া এমনই একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ছবিতে প্রথমবারের মতো সার্থকভাবে মানব সমাজের ব্যতিক্রমী উদাহরণ হিসেবে জেলখানা, পাগলাগারদ, বৃদ্ধদের জীবনের চিত্র ও যুদ্ধের অকথ্য ভয়াবহতা তুলে ধরার কৃতিত্বও তার প্রাপ্য। যুগের যন্ত্রণা ও সময়ের ভীতিকর পরিস্থিতি ও মানসিকতা এত জীবন্ত করে তুলে ধরা শিল্পী ইতিহাসে খুব কমই আছেন।
১৮১৯ সালের দিকে ফ্রান্সিসকো গয়া ৭৩ বছর বয়সে মাদ্রিদের এক আবাসিক এলাকায় এসে বসবাস করতে থাকেন। তখনও তিনি স্পেনের রাজদরবারের প্রধান শিল্পী ছিলেন। ফ্রাংকো-স্প্যানিশ যুদ্ধ ও আরো নানা বিষয়ে মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে তার দিন কাটছিলো। এছাড়া শারীরিক অসুস্থতাও তার পিছু ছাড়ছিলো না। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড মাথাব্যথায় রীতিমতো অজ্ঞান হয়ে যেতেন। তার বধিরতা রোগ অনেক চিকিৎসার পরও থেকে গিয়েছিলো। মাদ্রিদ এলাকায় তার বাড়িটি ‘হাউজ অব দ্য ডেফ’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলো।
চিকিৎসক ও ব্যক্তিগত বন্ধু ড. আরিয়েতার চিকিৎসায় একসময় কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তার বাড়ির দেয়ালে কিছু ছবি আঁকার সীদ্ধান্ত নেন। তার উদ্দেশ্য ছিলো শারীরিক অসুস্থতা ও মানসিক অবসাদের সময়কার কিছু অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি শৈল্পিকভাবে তুলে ধরা। সমকালীন অনুরাগী ও শিল্পীরা তার এসব ছবি না দেখুক- এমনই হয়তো তিনি চেয়েছিলেন। কিছুটা অসুস্থ শরীর নিয়েই তিনি দেয়ালে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। ১৪টি বড় ছবির স্কেচ তিনি করেছিলেন। এর মধ্যে কোনো কোনো ছবি আকারে ৬ বর্গ ফুট পর্যন্ত আছে! জেলখানা ও পাগলাগারদ নিয়ে আঁকা ছবির চেয়েও এ ছবিগুলো অনেক বেশি জীবন্ত। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন, অবচেতন ভয়, বিভীষিকার আলোড়ন ও জটিল মানবিক বিপর্যয় বেশ ভীতিকর সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
এসব ছবির মধ্যে ‘স্যাটার্ন ডিভোরিং হিজ সান’ সহজেই চোখে পড়ার মতো ব্যতিক্রম। এর পৌরাণিক আবহ ও দৃশ্যের ভীতিকর উপস্থাপন অন্য ছবিগুলোর চেয়ে আলাদাভাবে রক্তে ভয়ের স্রোত বইয়ে দেয়।
ছবিটি নোঝার জন্য পৌরাণিক উৎস জেনে নিলে বেশ সুবিধা হয়। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী- অমিত শক্তির অধিকারী টাইটান ক্রোনোস ও তার পত্নী রেয়া (Rhea) সন্তানের জন্য উৎসুক। কোনো একসময় ইউরেনাস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ক্রোনোসের সন্তান তার নিজের ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ কথা শোনার পর প্রবল প্রতাপশালী টাইটান চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পৌরাণিক জগতে দেবতা বা অন্য কোন চরিত্র সাধারণত নিজের শ্রেষ্ঠত্বের বিরুদ্ধে অন্য কাউকে প্রশ্রয় দেন না- তা সে যতই আপন বা প্রিয় হোক না কেন। এখানে ক্রোনোস তা-ই করলেন। তার সন্তান হেরা, হেস্টিয়া, ডিমিটার, হেডিস ও পোসাইডনকে একে একে খেয়ে ফেললেন। ষষ্ঠ সন্তান ছিলেন জিউস। তিনি অসীম বীরত্বের সাথে ক্রোনোসকে পরাজিত করেন এবং বাকি সন্তানদের জীবিত ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করেন।
ছবিটি বাস্তবিক অর্থে বেশ ভয়ঙ্কর। প্রতাপশালী টাইটান হিসেবে ক্রোনোস বা স্যাটার্ন বেশ দানবীয় আকারে উপস্থাপিত হয়েছে। সে তুলনায় তার হাতে থাকা সন্তানের দেহ আকৃতিতে মুঠোয় ধরার মতো। তার দেহ রক্তাক্ত ও ছিন্নভিন্ন। ভালোভাবে দেখলে স্যাটার্নের চোখে মুখে আক্রোশ, আকাঙ্ক্ষা ও আশঙ্কার মিশ্র অনুভূতি নজরে পড়ার কথা। এই পৌরাণিক চরিত্র তার গৌরবের স্থান কিছুতেই ছাড়বে না- এই অনড় অবস্থান যেমন আছে, আবার নিজের সন্তানকে বিপদ হিসেবে দেখতে পাওয়ার চিন্তাও তার মুখভঙ্গিতে আশঙ্কার রেখা লুকিয়ে রাখতে পারে না। আবার পথের বাঁধা দূর করে চিরদিনের জন্য অমর হবার অসীম আকাঙ্ক্ষাও কিছুটা নজরে পড়তে পারে।
কৌতূহল জাগানোর মতো ঘটনা হচ্ছে- স্যাটার্ন কর্তৃক নিজের সন্তানকে মারার পর খেয়ে ফেলার দৃশ্য শিল্পকলায় নতুন নয়। ১৬৩৬ সালে ফ্লেমিশ শিল্পী পিটার পল রুবেনস একই শিরোনামে একটি ছবি এঁকেছিলেন। তিনি দক্ষিণ নেদারল্যান্ডসের চিত্রকলার সোনালী যুগের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী। তার ছবিতেও সে যুগের চিহ্ন সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে। তবে তার ছবিতে পৌরাণিক আবহ যতটা ধরা পড়ে- ঘটনার তীব্র নিষ্ঠুরতা ও তার মনোভাব সেভাবে ফুটে ওঠে না। রুবেনসের ছবিতে উপাখ্যান আছে- তবে দুঃস্বপ্ন নেই।
ফ্রান্সিসকো গয়ার এই ছবিটি মিশ্র সমালোচনার শিকার হয়েছে। প্রথমেই কোনো প্রশংসা বা উৎকর্ষের মন্তব্য শিল্পীর ভাগ্যে জোটেনি। অনেকেই ফ্রান্সিসকো গয়াকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে মন্তব্য করেছেন। মজার ঘটনা হচ্ছে যে, এখনকার মনোবিজ্ঞানী ও মানসিক রোগের চিকিৎসকদের কাছে ফ্রান্সিসকো গয়ার ছবিগুলো বেশ মূল্যবান। মানবমনের অস্বাভাবিক বিভিন্ন দিক ও তার ফলে জন্ম নেয়া কার্যকলাপ এসব ছবি দ্বারা চমৎকার উপায়ে ফুটিয়ে তুলেছেন বলে বিশ্বাস করা হয়। অনেকে বলে থাকেন, ফ্রান্সিসকো গয়ার বংশের ইতিহাসে এই ছবির বৈশিষ্ট্যের অনেক দিক খুঁজে পাওয়া যাবে। তার পরিবার ফ্রান্সে ইন্দো-ইউরোপীয় আগমনের পূর্বের ‘বাস্কস’ জনগোষ্ঠীর এক বংশধারার সদস্য ছিলেন। এই জনগোষ্ঠীর ভেতরে প্রচলিত গল্প ও উপকথার মধ্যে সহিংসতা ও নৃশংসতার উদাহরণ বেশ ভালোভাবেই পাওয়া যায়। এছাড়া রিচুয়ালের অংশ হিসেবে মানুষ বলি দেওয়া ও ক্যানিবালিজমের দৃষ্টান্তও সুলভ। তাদের উপকথায় প্রকৃতি ও এতে বিদ্যমান বিভিন্ন অশরীরী ও অলৌকিক শক্তি মানুষের মধ্যে অতৃপ্ত একধরনের শক্তির প্রতিফলন তৈরি করে। অমর নাট্যকার শেক্সপিয়রের মতো তিনিও প্রকৃতির এই ব্যাখ্যাহীন নিষ্ঠুর বিস্ময়ে বিশ্বাসী ছিলেন বলে মনে হয়। নিজের সন্তানের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে অমর হতে চাওয়া স্যাটার্নের ছবি দয়াহীন পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কঠোর সংগ্রামকেই কিছুটা রহস্য ও ভয়াবহতার আকারে ফুটিয়ে তুলেছে।
পুরাণের উপাখ্যানের সাথে মানুষের স্বপ্নের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। একটি প্রধান মিল হচ্ছে- ঘটনার ভেতরের কার্য ও কারণের স্বাভাবিক সম্পর্ক থেকে এক আকস্মিক বিচ্যুতি। সে হিসেবে অনেকে বলতেই পারেন, পুরাণ হচ্ছে একধরনের গণস্বপ্ন বা কালেকটিভ ড্রিম। মানুষ চিহ্ন বা প্রতীক দিয়ে সত্য প্রকাশ করতে পছন্দ করে। মানুষের ইতিহাসের চলমান ও অবিনাশী নিষ্ঠুরতা দুঃস্বপ্নের মতো ভয়ানক উপায়ে ফুটিয়ে তোলার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে পুরাণ ও স্বপ্ন। ফ্রান্সিসকো গয়ার ছবি তার নিজেরই দুরন্ত দুঃস্বপ্নের প্রকাশ- এ কথা অনেক বিশেষজ্ঞই বলে থাকেন।
অনেক শিল্প বিশেষজ্ঞ এই ছবির ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দিকটিও তুলে ধরতে চান। তারা বলে থাকেন, উনিশ শতকের স্পেনের গৃহযুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র এই ছবিতে পৌরাণিক অবয়বের আশ্রয় নিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। এই গৃহযুদ্ধে স্পেনের রাজপরিবার ও অভিজাত সমাজ তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে যুদ্ধ ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। স্প্যানিশ তরুণদের রক্তে সমাজের বয়স্ক ও অভিজ্ঞ মানুষজন নিজেদের আত্মরক্ষার উপায় দেখতে পেয়েছিলেন। অনেক তরুণ নিষ্ঠুর ইনকুইজিশনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলো।
শিল্প মানবজীবনের এক অসমাপ্ত দিক প্রকাশ করার সবচেয়ে সার্থক উপায়। এই অসমাপ্ত দিক প্রায়ই আটপৌরে জীবনের চেয়ে অনেক বেশি রোমাঞ্চকর হয়। ফলে ভয়াবহতার অনুভূতি সুন্দর ও কালোত্তীর্ণ উপায়ে অনুরাগীদের চিরকাল বিস্মিত করে থাকে। ফ্রান্সিসকো গয়ার ‘স্যাটার্ন ডিভোরিং হিজ সান’ চিরকাল বিস্ময় জাগানোর মতো এমনই এক ছবি।