গত বছর কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে টেড টকে বক্তব্য রাখেন শাহরুখ খান। তার সচরাচর বক্তব্যের মতো এটিও ছিলো রসিকতাপূর্ণ এবং একই সাথে গভীর। সেখানে তিনি কথা বলেছেন মানবতা এবং তার ভবিষ্যৎ নিয়ে। কথা বলেছেন খ্যাতি এবং ভালোবাসা নিয়ে। প্রায়ই বলা হয়, শাহরুখের মধ্যে একটা ‘Old soul’ আছে। কারণ তার কথার মধ্যে একধরনের কাব্যিকতা এবং গভীরতা কাজ করে। শাহরুখ টেড টকের শুরুটা করেছেন তার স্বভাবসুলভ রসিকতা দিয়ে।
“ভারতে আমাকে পৃথিবীর সেরা প্রেমিক ভাবা হয়। আপনারা যদি কাউকে না বলেন তাহলে আমি স্বীকার করছি, আমি সেরা প্রেমিক নই। কিন্তু আমি তাদের এই ভুল ধারণা ভাঙাই না।”
একটা রসিকতা দিয়ে শুরু করার পর আবার আরেকটা ঠাট্টা করলেন।
“আমি শুনেছি আপনারা অনেকেই আমার কাজ দেখেননি। এজন্য আপনাদের জন্য আমার খারাপ লাগছে।”
তিনি মানবতাকে তুলনা করেছেন একজন বয়স হতে থাকা চলচ্চিত্র তারকার সাথে। মানবতা যেন অনেকটা শাহরুখের মতো। একজন চলচ্চিত্র তারকার জীবনে যেমন উত্থান-পতন এবং অবশেষে জীবন সম্পর্কে অনুধাবন আছে, শাহরুখের মতে মানবতাও অনেকটা এমন। তার বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের পরিবারের টিকে থাকার জন্য অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। শাহরুখ তার বাবা-মাকে খুব কম বয়সেই হারান। তার বাবা মারা যাওয়ার পর শাহরুখ বাবার মৃতদেহ গাড়ির পেছনে তুলে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন। তার বয়স তখন ১৪ বছর। তার মা তাকে জিজ্ঞেস করলেন “তুমি কখন গাড়ি চালানো শিখেছো?” শাহরুখ চিন্তা করলেন আর বুঝতে পেরে বললেন, “এখন, মা।” এভাবেই নানা ঘাত-প্রতিঘাতে জীবন থেকে শিখছিলেন তিনি। তবু জীবন অনেক সহজ-সরল ছিলো তখন। শাহরুখের ভাষায়,
“আগের প্রজন্মের নানা সংগ্রামের দ্বারা তৈরি নিয়ম-নীতিকে আমরা মেনে নিতাম আমাদের নিরাপত্তার জন্য। আমরা অনুভব করতাম সরকার আমাদের ভালোর জন্য কাজ করছে। বিজ্ঞান ছিলো সহজ-সরল। অ্যাপল তখনও ফলের নাম ছিলো। যা আগে ছিলো ইভের হাতে তারপর চলে আসে নিউটনের কাছে। স্টিভ জবসের হাতে তখনও অ্যাপল আসেনি। . … আপনি সেখানেই যেতেন কাজের জন্য, জীবন আপনাকে যেখানে নিয়ে যেত এবং মানুষেরা বেশিরভাগ সময় আপনাকে উদার মনে গ্রহণ করতো। … সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনি আসলে যেমন ঠিক তেমনটিই ছিলেন। আর যা চিন্তা করতেন তা-ই বলতেন।”
শাহরুখের বয়স যখন বিশের কোঠার শেষের দিকে তখন শিল্পোন্নয়নের যুগ। সাথে সাথে শাহরুখের জীবনও পরিবর্তন হতে থাকে। জীবনযাত্রা আর আগের মতো থাকে না।
“সব কিছু আগের থেকে আলাদা দেখাতে শুরু করে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের সাথে আমি পরিচিত হতে থাকি। … সব নিয়মনীতি আমার কাছে নির্ভরযোগ্যতা হারাতে থাকে। মানবতার এত বৈচিত্র্য ধারণ করা যেন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের চিন্তাভাবনাগুলো স্বাধীনতার সাথে খুব দ্রুত ছড়াতে থাকে। আমি মানুষের আবিষ্কার এবং সাহায্যের অলৌকিক ক্ষমতা উপলব্ধি করেছি। আমার সৃজনশীলতার সাথে যখন এই সহযোগিতা যোগ হলো, তা আমাকে বিরাট তারকাখ্যাতি এনে দেয়।”
ধীরে ধীরে খ্যাতির শিখরে উঠে গেলেন শাহরুখ। সেই সব কিছুই অর্জন করলেন, যা একজন মানুষ চায়। শাহরুখের বয়স তখন ৪০। ইতিমধ্যেই তিনি পঞ্চাশটি চলচিত্রে অভিনয় করে ফেলেছেন। মালয়েশিয়া এবং ফ্রান্স সরকার থেকে সম্মানিত হলেন তিনি। ঠিক এমন সময়ই আসলো ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের জগতে এসে দেখা গেল, মানুষ অনেক স্বাধীনতা পেলেও একই সাথে যেন বন্দী। মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখানোর কিংবা হিংসা ছড়িয়ে দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেল।
“আমি যা কিছু বলি তার একটা মানে দাঁড়িয়ে যায়। আমি ভালো-মন্দ যাই করি না কেন, তা ছিল পৃথিবীর মানুষের মন্তব্যের জন্য উন্মুক্ত। এমনকি আমি যা কিছু বলিনি কিংবা করিনি সেগুলো নিয়েও এমন হতো। চার বছর আগে আমার অসাধারণ স্ত্রী গৌরি এবং আমি আমাদের তৃতীয় সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম। ইন্টারনেটে বলা হলো যে, আমাদের তৃতীয় সন্তান হলো আমাদের পনেরো বছর বয়সী প্রথম সন্তানের অবৈধ সন্তান। … এটি প্রমাণের জন্য একটা ভুয়া ভিডিও ছিল ইন্টারনেটে। আমাদের পুরো পরিবার এক ধরনের ঝামেলার মধ্যে ছিল। … এই নতুন পৃথিবীতে বাস্তব কল্পনায় আর কল্পনা বাস্তবে পরিণত হচ্ছিলো। আমি বুঝতে পারলাম এখন আমার নিজের মতো থাকা কিংবা নিজের মতো কথা বলা যাচ্ছে না।”
শাহরুখ বলছেন, তারপর তিনি ফেসবুকে নিজের ইমেজ তৈরি করতে চেষ্টা করলেন। গভীর ভাব সমৃদ্ধ টুইট করতে থাকলেন। যাতে লোকে মনে করে, তিনি আসলে সেই জিনিসটিই ভাবছেন। আসলে আমরা সবাই এমনটি করে থাকি। শাহরুখের মতে, এখন আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। সময় এসেছে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার। শাহরুখ বলছেন,
“এখনই সময় মানবতার ঘুরে দাঁড়ানোর। কারণ, বর্তমান সময়ের আপনি সাহসী। বর্তমানের আপনি আশাবাদী। বর্তমানের আপনি সৃষ্টিশীল এবং সম্পদশালী। বর্তমানের আপনি সব সংজ্ঞার ঊর্ধ্বে।”
ভারতের খুব সরল-সহজ আধ্যাত্মিকতার দর্শন তুলে ধরেন শাহরুখ।
“আমি পৃথিবীর যে জায়গা থেকে এসেছি, তাতে রয়েছে খুবই গভীর কিন্তু সরল আধ্যাত্মিকতা। চালচুলোহীন মুসলিম মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এই আমি, যে কিনা আকস্মিকভাবে চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেছে, তাকে ভারত কিং অফ রোমান্স, বলিউডের বাদশাহ, দেশের সেরা প্রেমিক বানিয়েছে। … প্রাচীন এই অঞ্চলের মানুষ আমাকে অসীম ভালোবাসায় গ্রহণ করেছে। আমি এই দেশের মানুষ থেকে শিখেছি, ক্ষমতা কিংবা দারিদ্র্য কোনোটিই আপনার জীবনকে অধিক চমৎকৃত কিংবা কম কষ্টযুক্ত করে না। আমি আমার দেশের মানুষ থেকে শিখেছি, একটি জীবন, একজন মানুষ, সংস্কৃতি, ধর্ম কিংবা একটি দেশের মর্যাদা নির্ভর করে তার অনুগ্রহ এবং সহমর্মিতা দেখানোর ক্ষমতার উপর। যে জিনিসটি আপনার ভেতরে অনুপ্রেরণা যোগায়, যা আপনাকে সৃষ্টি এবং তৈরিতে প্রেরণা দেয়, যা আপনাকে ব্যর্থতা থেকে রক্ষা করে, তা হলো মানুষের সবচেয়ে পুরনো ও সবচেয়ে সরল আবেগ। আর তা হলো ভালোবাসা।”
একজন ভারতীয় মরমী কবির কবিতা পাঠ করেন শাহরুখ। যার মানে দাঁড়ায়, প্রকৃত জ্ঞানী সে, যে ভালোবাসার মানে বুঝে আর তা পালন করে।
“আগামীর আপনারা হতে হবে এমন, যারা ভালোবাসে। তা না হলে আগামীর আপনারা নিজেদের উন্নয়ন করতে পারবেন না , নিজেদের আত্মমগ্নতাতেই সব হারিয়ে ফেলবেন। আপনি আপনার ক্ষমতা দিয়ে নিজের সাথে অন্যের মাঝে দেয়াল গড়ে তুলতে পারেন। অথবা আপনি আপনার ক্ষমতা দিয়ে নিজেদের মধ্যকার দূরত্বগুলো দূর করতে পারেন। আপনি আপনার বিশ্বাস দিয়ে ভীতি তৈরি করে মানুষকে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করতে পারেন। অথবা আপনার বিশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সাহস যোগাতে পারেন। আপনি শক্তিকে ব্যবহারের মাধ্যমে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারেন। কিংবা আপনি এই শক্তি ব্যবহার করে লাখ লাখ মানুষের কাছে আলো পৌঁছে দিতে পারেন। আপনি সমুদ্র আবর্জনায় পূর্ণ করতে পারেন, সব গাছ কেটে ফেলতে পারেন, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারেন। অথবা তাদের ভালোবাসা দিতে পারেন। গাছ এবং পানি থেকে নতুন প্রাণ পেতে পারেন। আপনি মঙ্গলগ্রহে গিয়ে অস্ত্রসজ্জা সাজাতে পারেন কিংবা সেখানে নতুন প্রজাতির প্রাণ খুঁজে দেখতে পারেন। যাকে আপনি সম্মান করবেন এবং তার থেকে শিখবেন। আপনি আমাদের অর্জন করা সকল টাকা দিয়ে যুদ্ধ বাঁধাতে পারেন। ছোট ছোট শিশুদের হাতে অস্ত্র দিয়ে একে অপরকে হত্যা করতে প্ররোচিত করতে পারেন। অথবা এই টাকা দিয়ে খাবার তৈরি করে তাদের ক্ষুধার্ত পেট ভরাতে পারেন।
আমার দেশ আমাকে শিখিয়েছে, একজন মানুষের ভালোবাসার ক্ষমতা ঈশ্বরের সমান। যা থেকে আলো এসে পড়ে আমাদের এই পৃথিবীতে, সভ্যতার ইতিহাসে যাকে নিয়ে অনেক ভাঙাগড়া হয়েছে। গত কয়েকদিন এখানে টেড টকে অসাধারণ কিছু লোক ব্যক্তিগত অর্জনের কথা বলেছেন, প্রযুক্তির কথা বলেছেন, বিজ্ঞানের কথা বলেছেন, আবিষ্কারের কথা বলেছেন; যা কিনা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য উদযাপনের বিষয়। কিন্তু এই উদযাপনের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতিও একই পরিমাণে মিশে থাকতে হবে। তাই আমি মনে করি ভবিষ্যতের আপনি হবেন অসীম। ভারতে একে চক্র বলে। এটা অনেকটা বৃত্তের মতো। নিজেকে পূর্ণ করার জন্য সেখানেই শেষ হয় যেখানে সে শুরু করেছিল। আপনি স্থান ও কালকে আলাদাভাবে দেখেন কিন্তু দুটিই ভালোভাবে বুঝেন। আপনার অসাধারণ গুরুত্ব কিংবা মহাবিশ্বের প্রেক্ষিতে আপনার গুরুত্বহীনতা দুটোই বুঝেন। আপনি ফিরে যান মানবতার নিষ্পাপ অবস্থায় যে কিনা হৃদয়ের পবিত্রতা থেকে ভালোবাসে, সত্যের চোখ দিয়ে দেখে, মনের স্বচ্ছতা থেকে স্বপ্ন দেখে।
ভবিষ্যতের আপনি অনেকটা বয়স্ক হওয়া চলচ্চিত্র তারকার মতো। যে কিনা বুঝতে পেরেছে, এমন একটি পৃথিবী সম্ভব যেটি কিনা সম্পূর্ণভাবে আচ্ছন্ন হয়ে নিজেকে ভালোবাসতে পারে। আপনাকে এমন একটি পৃথিবী তৈরি করতে হবে যেটি কিনা নিজেই নিজের সেরা প্রেমিক।”
ভালোবাসার এই গান গেয়েই শাহরুখ তার টেড টক শেষ করেন। এই বিশৃঙ্খল পৃথিবীকে আনন্দময় করার হয়তো একটিই উপায় আছে। তা হলো আবার আমাদের নতুন করে ভালোবাসতে শেখা।
ফিচার ইমেজ: Source: Marla Aufmuth / TED