শিরিন নেশাত নিউ ইয়র্কে বসবাসরত একজন ইরানি ভিজুয়্যাল আর্টিস্ট। তিনি মূলত চলচ্চিত্র, ভিডিও এবং ফটোগ্রাফির জন্য বেশি পরিচিত। তার শিল্পকর্ম ইসলামী ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যকার পার্থক্য, নারীবাদ, পুরুষতান্ত্রিকতা, প্রাচীনত্ব ও আধুনিকত্ব, সামাজিক ব্যবস্থা, জনজীবন, ব্যক্তিগত জীবন এই বিষয়গুলোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। কাজের জন্য তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। সৃজনশীল বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিল্পীদের নিয়ে কাজ করা ম্যাগাজিনে আর্থার সি. দান্তোকে দেয়া সাক্ষাৎকারটির সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত অংশ নিয়ে আজকের এই লেখাটি।
আর্থার সি. দান্তো: বিগত তিনটি বছরে আপনি মোট ৪টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন যা আপনার জন্য বেশ ফলদায়ক ছিলো। চলচ্চিত্রে আসার আগে আপনি কী করতেন?
শিরিন নেশাত: আমি ১৯৮৩ সালে স্নাতক পাশ করেছি ইউসি-বার্কলে থেকে। এর ঠিক পরপরই পাড়ি জমাই নিউ ইয়র্কে আর চট করেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে, শিল্পকর্মের সাথে জড়িত কোনো কাজ আমি পেশা হিসেবে বেছে নিবো না! আমার ভেতর একটা অনুভূতি কাজ করতো যে, আমি যা করছিলাম তা যথেষ্ট ছিলো না এবং নিউ ইয়র্কের শিল্প চর্চার অবস্থা নিয়েও ভীত ছিলাম। তাই আমি অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করতাম আর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে অনেক কোর্সও করেছি। শীঘ্রই আমার পরিচয় হয়ে যায় আমার প্রেমিকের সাথে, যিনি ম্যানহাটেনে ষ্টোরফ্রন্ট ফর আর্ট এন্ড আর্কিটেকচার পরিচালনা করতেন, পরবর্তীতে আমি তার সাথে বাগদান সম্পন্ন করি। পরবর্তী দশ বছর আমি ষ্টোরফ্রন্টে তার সাথে মন প্রাণ দিয়ে কাজে নিয়োজিত ছিলাম এবং সেটাই ছিলো আমার জন্য সত্যিকারের শিক্ষা।
ষ্টোরফ্রন্ট হলো একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন যা শিল্পী, স্থাপত্যশিল্পী, সাংস্কৃতিক সমালোচক, লেখক ও দার্শনিকদের নিয়ে নানান রকরমের অনুষ্ঠানের কাজ করতো। এসব দেখে আমার ভেতরও শিল্পী সত্তা জেগে উঠতে থাকলো এবং আমি ঠিক করে ফেলি যে, আমি শিল্পকর্ম নিয়ে কাজ করবো। সেই দশ বছরে আমি বাস্তবিকভাবে কোনো শিল্পকর্মের কাজ করিনি এবং আমি যা করেছি তা নিয়ে আমি খুব অসন্তুষ্ট ছিলাম। অবশেষে ভেঙে পড়ছিলাম। সেটা ১৯৯৩ সালের কথা, যখন আমি পুনরায় আদতেই সত্যিকার অর্থে শিল্পকর্মের কাজ করা শুরু করলাম।
আর্থার সি. দান্তো: সেগুলো কী ফটোগ্রাফি ছিলো?
শিরিন নেশাত: হ্যাঁ, আমি ভেবেছিলাম আমার বিষয়টির জন্য ফটোগ্রাফিই সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম। কারণ এর মাধ্যমেই আমি বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি যেটা ছিলো আমার মুখ্য প্রয়োজন। ১৯৯০ সালের দিকে আমি ইরানে ফিরে যাই। ইসলামিক বিপ্লবের সময় থেকে দশ বছর পর্যন্ত আমি ইরানের বাইরে ছিলাম। যেহেতু আমি এদিক ওদিক বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করেছি, সেহেতু আমার মনে অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। যার জন্য আমি যে কাজটি করছিলাম তা নিয়ে আরও ভালোভাবে অগ্রসর হচ্ছিলাম। শুরু থেকেই আমার উদ্দেশ্য ছিলো ইরানের সমাজ ও বিপ্লবের সাথে জড়িত নারীদের নিয়ে কাজ করা। তাই আমি এমন একটি ফটোগ্রাফির সিরিজ তৈরি করেছিলাম যা সেই বিষয়টি অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করেছিলো।
আর্থার সি. দান্তো: আমি গত সপ্তাহে সুসান সান্তাগের সাথে কথা বলছিলাম। তিনি বলেছিলেন যে, তার দৃষ্টিতে ইরানের চলচ্চিত্র আন্দোলনটি সমসাময়িক সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এটি একটি অসাধারণ দাবি। এই দাবিটির জন্য আপনি নিজেকে কতটুকু দায়ী বা হকদার বলে মনে করেন?
শিরিন নেশাত: আমি তার সাথে একমত। ইরানের চলচ্চিত্রের নতুন ধারা আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমার মতে, এটি বিপ্লবের একটি ইতিবাচক দিক ছিলো। কারণ এর ফলে এমনভাবে পশ্চিমা প্রভাব দূর হয়েছে যা আমাদের ইরানের সংস্কৃতিতে খুব গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করেছিলো। বিপ্লবের আগে, ইরানের চলচ্চিত্রগুলো ছিলো ঠিক পশ্চিমা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মতোই। অর্থাৎ সেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ছিলো অবাস্তবতা, সহিংসতা ও যৌনতায় ভরপুর। বিপ্লবের পর সরকার বিভিন্ন ধরনের আইন জারি করেছেন, সেজন্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নতুনভাবে সবকিছু নিয়ে চিন্তা করতে হয়েছে। যার ফলে চলচ্চিত্র একটি নতুন রূপ ধারণ করে যা সমস্ত সরকারি সমালোচনার মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই চলচ্চিত্রগুলো সফল হওয়ার কারণ হলো এগুলোর মানবিক, সরল ও সর্বজনীন হওয়া। খুব সরল সাবলীলভাবে চলচ্চিত্রগুলোতে ফুটে ওঠে ইরানের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো। এই প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাণের অগ্রদূত আব্বাস কিয়ারোস্তামি। সম্প্রতি তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস নিউ ইয়র্ক’ জুলাই থেকে প্রদর্শিত হচ্ছে।
আর্থার সি. দান্তো: আপনার প্রথম চলচ্চিত্র সম্পর্কে কিছু জানতে চাচ্ছি। যখন আপনি সেগুলো ইরানে প্রদর্শন শুরু করলেন, তখন সেখানে ওই বিষয়গুলো কতটা প্রচলিত ছিলো। একক স্ক্রিনের রৈখিক চলচ্চিত্র নাকি আপনি সরাসরি ডাবল স্ক্রিনে বিন্যাস শুরু করেছিলেন?
শিরিন নেশাত: টারবুল্যেন্ট আমার প্রথম চলচ্চিত্র। এর আগে আমার তৈরি করা কিছু ভিডিও রয়েছে যেগুলোকে আমি ভিন্ন মাত্রার বলে বিবেচনা করি। সেগুলো ছিল ভাস্কর্য সংক্রান্ত, যেগুলোর কোনো নির্দিষ্ট কাহিনী, শুরু বা শেষ ছিলো না।
আর্থার সি. দান্তো: তখন একটি ভিডিও যেরকম হয় বলে মনে করা হতো, বিষয়টা ছিলো অনেকটা সেরকম। দেয়ালে কিছু একটা দেখানো হচ্ছে, যার কোনো কাহিনী নেই। শুধু কতগুলো ছবি দেখানো আর কি। আপনি কি তখন শব্দের প্রয়োগ করতেন?
শিরিন নেশাত: হ্যাঁ, শব্দ সবসময়ই আমার কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো।
আর্থার সি. দান্তো: আর সেটা কি সবসময়ই গানই ছিলো?
শিরিন নেশাত: আসলে, বিভিন্ন সময়ে আমি নিজে নিজেই একেবারে সহজ কিছু সুর করেছিলাম।
আর্থার সি. দান্তো: স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কি গানগুলো লেখা হয়েছিলো?
শিরিন নেশাত: হ্যাঁ, রেকর্ডিং স্টুডিওতে দাঁড়িয়েই তৎক্ষণাৎ করেছিলাম।
আর্থার সি. দান্তো: এমন একটা সময় এসেছিলো যখন টারবুলেন্টে প্রকাশিত বিষয়গুলো উপলব্ধি বা চেতনার জন্ম দিতে থাকে। আপনি কিছুটা পরিবর্তন আনলেন, ভিন্ন আঙ্গিকে পরিচালনা করা শুরু করলেন। আপনি কি নিজেকে সীমার চূড়ান্ত পর্যায়ে একেবারে ভিন্ন কিছু বলে নিজেকে ধরে নিয়েছিলেন? আমার মনে আছে, পুরাতন কিছু বন্দুক হাতে আপনার কতগুলো ছবি দেখেছিলাম। সেই বিষয়ে কিছু বলুন।
শিরিন নেশাত: ১৯৯৩ সালে আমি প্রথম যে ফটোগ্রাফির কাজটি করেছিলাম তাতে বিদেশে পাড়ি জমানো ইরানের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। বিপ্লবের পর থেকে ইরানের পরিবর্তনগুলো বোঝা ও বিশ্লেষণ করার জন্য বিষয়টি ছিলো কিছুটা ফিরে দেখার মতো। এছাড়াও এটি একজন শিল্পীর দীর্ঘ দিন বিরতির পর শিল্পকর্মের মাধ্যমে নিজের দেশের শিকড়ে ফিরে আসার ফল যা ব্যক্তিগত ও শৈল্পিকভাবে আমার জন্য ছিলো- মোড় ঘুরে দাঁড়ানো। আমি সমকালীন ইসলামের মতাদর্শিক ও দার্শনিক ধারণাগুলো গভীরভাবে নিরীক্ষা করেছি। বিশেষ করে বিপ্লবের উৎপত্তি এবং তা আমার দেশ, ইরানকে কীভাবে রূপান্তর করেছে সে বিষয়ে আলোকপাত করেছি। আমি জানতাম যে, বিষয়টি খুব বিস্তৃত ও জটিল ছিলো। তাই আমি আমার বাস্তববাদী ও নির্দিষ্ট কিছু বিষয় নিয়েই কাজ করি। আমি ‘শহীদদের আত্মদান’ বিষয়টিতে অধিক মনোনিবেশ করি যে, বিষয়টি সেই সময়ে ইসলামিক সরকারদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো। মূলত সেটা ছিলো ইরাক বা ইরানের যুদ্ধের সময়। এটি বিশ্বাস, আত্মত্যাগ ও বস্তুগত বিশ্বের বিষয়াদি প্রত্যাখ্যান এবং পরিশেষে মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে উন্নীত করেছিলো। বেশিরভাগ সময় কীভাবে আধ্যাত্মিকতা, রাজনীতি ও সহিংসতা একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত থাকে সেটা নিয়ে আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু কয়েক বছর পর, আমি অনুভব করলাম যে, আমি এই বিষয়টিকে নিঃশেষ করে ফেলেছি এবং আমার এখন অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। আমি আর রাজনীতি নিয়ে সরাসরি কাজ করতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম আরও ভাবাবেগ ও উদ্দীপনাময়, দার্শনিক এবং কাব্যিক কাজ করতে।
আর্থার সি. দান্তো: যখন টারবুল্যেন্টে কাজ করা শুরু করেছিলেন তখন কি ৩টি চলচ্চিত্র একই সূত্রে গাঁথা নাকি একক বিবৃতি হিসেবে থাকবে সেই ধারণা থেকে করেছিলেন? কারণ টারবুল্যেন্ট অন্য আরও দুটি চলচ্চিত্রের নেতৃত্বে কাজ করেছে।
শিরিন নেশাত: প্রথমত, এই ৩টি চলচ্চিত্র যে একই সূত্রে গাঁথা তা আমি বলবো না। ইরানের সামাজিক কাঠামোর সাথে সম্পৃক্ত পুরুষ ও নারীবাদী বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ শুরু হয়েছিলো টারবুল্যেন্ট থেকে। এই কাজ শেষ করেই আমি ‘রাপচার’ এর কাজে হাত দিই যা টারবুল্যেন্ট থেকে একেবারে ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও একই সমস্যা সৃষ্টি করেছে। আমার চূড়ান্ত কাজটি ছিলো ‘ফারভার’ যা ছিলো এই অধ্যায়টির সমাপ্তি। টারবুল্যেন্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো তা ছিলো ইরানের রাস্তায় আমার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এক অন্ধ যুবতী কিছু টাকার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গাইছিলো এবং তার কণ্ঠ এতটাই মধুর ছিলো যে, আশেপাশে মানুষের ঢল নেমেছিলো তার গান শোনার জন্য। আমি তার গানের প্রেমে পড়ে যাই এবং তার একটি ক্যাসেট কিনে নিয়ে আসি। পরবর্তীতে আমি যখন তার গানগুলো অনুবাদ করি, তখন বুঝতে পারি যে, তার অন্ধত্ব ও দৃশ্যমান শ্রোতা না থাকার বিষয়টি তার গানগুলোকে কতটা প্রভাবিত করেছে।
আর্থার সি. দান্তো: টারবুল্যেন্টের এই বিষয়টি আমাকে তাড়িত করেছে। এক পর্দায় গায়কটি শ্রোতাদের দিকে পিঠ দিয়ে গভীর আসক্তিতে গান গাচ্ছে। যেহেতু ক্যামেরা স্টেজের পেছনে ছিলো, সেহেতু তাকে সামনে থেকে ও শ্রোতাদের তার পেছন থেকে দেখা যায়। অন্য পর্দায় যে গায়িকা ছিলেন, তিনি ফাঁকা একটি অডিটোরিয়ামের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকেন। তিনি খুবই রহস্যময়ী। দর্শকরা শুধুমাত্র তার পেছন দিকটা দেখতে পায়। বস্তুত, বিচার করলে তাকে একজন মৃত মানুষের মতো দেখায়। গায়কটি যতক্ষণ গাইতে থাকে ততক্ষণ গায়িকাটির পেছন দিকই দেখা যায়। বিষয়টি কী হচ্ছে তা ঠিক বোঝা যায় না। শ্রোতারা গায়কের ব্যাপারে বেশ প্রতিক্রিয়াশীল থাকে এবং তার গানের প্রশংসা করে। আমার যতদূর মনে পড়ে, তিনি দর্শকদের দিকে ঘুরে কিছুটা মাথা নোয়ান এবং আবার সামনে ফিরে তাকান। তখন অন্য পর্দায় থাকা গায়িকাটি গাওয়া শুরু করেন। আর তার গান ছিলো একদম ব্যতিক্রমধর্মী, বেশ পরিমিত ও ধারালো। তার গাওয়া গানটি একেবারেই সাধারণ গোছের ছিলো না। গানের সাথে সাথে ধীরে ধীরে গায়িকার চেহারাটি পর্দায় দেখা যায় এবং ক্যামেরাটি ফাঁকা অডিটোরিয়ামে শুধু এদিক সেদিক করতে থাকে। অন্য পর্দা থেকে গায়কটি গায়িকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেটা দেখে বোঝা যায় যে, দর্শকদের মধ্যে গায়কটিও গায়িকাটির একজন ভক্ত ছিলেন। যদিও বিষয়টি স্পষ্ট নয় যে, এটি কীভাবে সম্ভব! সুতরাং, সেটা ছিলো এক ধরনের সংযোজন।
শিরিন নেশাত: দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণাগত দিক থেকে টারবুল্যান্ট ও রাপচার, দুটো চলচ্চিত্র একই ধারণার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। আর বিষয়টি ছিলো বিপরীতধর্মী। পুরুষ গায়কটি সমাজের চিরাচরিত বিধান অনুযায়ী পোশাক পরেছেন এবং ১৩ শতাব্দীতে সুফি কবি রুমির লেখা প্রগাঢ় ভালোবাসার একটি কবিতা আবৃত্তি করেছেন। তার ঠিক উল্টোটা ছিলেন গায়িকাটি, যিনি বেশ বিদ্রোহী ছিলেন। মঞ্চে তার থাকার কথা ছিলো না। আর যেভাবে তিনি গান গাইছিলেন তা ইসলামিক গান (গজল) এর সব নিয়মকানুন ভঙ্গ করে। তার গানটি ছিলো বেশ মুক্ত ধাঁচের, উন্নত, কোনো ভাষার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিলো না এবং তা ছিলো আনুমানিক ও প্রায় প্রাথমিক।
আর্থার সি. দান্তো: আপনি যখন বললেন যে, তার থাকার কথা ছিলো না তখন কী হলো?
শিরিন নেশাত: টারবুল্যেন্টে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হয়েছে যে, জনসাধারণের সম্মুখে গান গাওয়া ইরানের নারীদের জন্য নিষিদ্ধ ছিলো এবং সেখানে কোনো নারী সঙ্গীত শিল্পীর গানের রেকর্ডও নেই। এই বিষয়টি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সামাজিক কাঠামোতে নারী পুরুষের বিভিন্ন বিপরীত দিকগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলে। চূড়ান্ত প্রশ্ন ছিল সুফী সংগীতের অন্তর্নিহিত রহস্যের একটি পর্যায়ে পৌঁছানোর ব্যাপারে প্রত্যেকেই কীভাবে এগিয়ে যাবে।
আর্থার সি. দান্তো: কিন্তু গায়িকার গাওয়া গানটি ঐতিহ্যবাহী ছিলো না।
শিরিন নেশাত: না, এটি সুসান দেহিম এর গান। তিনি ইরানের অত্যন্ত প্রতিভাবান, সমসাময়িক একজন সঙ্গীত শিল্পী যিনি নিউ ইয়র্কে বাস করেন। যদিও তার গানগুলো ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক সুরের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। নির্দিষ্ট কোনো ধরনের গানের সাথে এর খুব একটা মিল নেই বললেই চলে।
আর্থার সি. দান্তো: টারবুল্যেন্টে তার গলাই কি আমরা শুনতে পাই এবং তিনি নিজেই কি কাজ করেছেন সেই চরিত্রটিতে?
শিরিন নেশাত: হ্যাঁ, আমরা একসাথে অনেকক্ষণ আলোচনা করেছি গান বাছাই ও সেই চলচ্চিত্রে তার উপস্থিতি নিয়ে। কাজটির ভাবগত প্রকাশও কতটা কঠিন তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।।
আর্থার সি. দান্তো: বিষয়টি আসলেও জটিল।
শিরিন নেশাত: চলচ্চিত্রের একদম শেষ পর্যায়ে গায়কটি স্তব্ধ হয়ে যাবে এমন আবহ তৈরি করেছিলাম এবং গায়িকা হয়ে যাবে মুক্ত! অবশ্যই এই পর্যায়ে আসার জন্য গায়িকাকে তেমন কোনো কষ্টই করতে হয়নি।
আর্থার সি. দান্তো: গায়িকাকে কিন্তু গান নিয়ে কোনো কাঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু মুক্ত হওয়ার প্রভাব এবং গায়কের স্তব্ধ হওয়ার বিষয়টি দৃশ্যমানভাবে চলচ্চিত্রে ফুটে উঠেছে বলে কি আপনি মনে করেন?
শিরিন নেশাত: আমার মনে হয় ফুটে উঠেছে। গায়কের মুখভঙ্গি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে আমরা অনেকক্ষণ কথা বলেছি। তার করুণাময়ী কিন্তু প্রায় ঈর্ষান্বিত স্থির দৃষ্টিটা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ।
আর্থার সি. দান্তো: তিনিও মনে মনে আশা করছিলেন যে, তিনিও যদি ওই গায়িকাটির মতো মুক্ত হতে পারতেন।
শিরিন নেশাত: একদম তা-ই! নারী পুরুষের বৈষম্যের বিষয়টি তার ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সম্ভবত তিনি নিজেও একজন বন্দী।
ফিচার ইমেজ: Widewalls