বিজ্ঞাপন মানে শুধুই কি অফার আর পণ্য বিক্রির বিষয়ে কথা বলা? না, বিজ্ঞাপন এর চাইতেও বেশি কিছু। বিজ্ঞাপন তুলে ধরে একটি দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে, আওয়াজ তোলে সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে, কলম আর তুলির মধ্য দিয়ে গর্জে ওঠে অনৈতিকতার বিরুদ্ধে। আর এসব বিজ্ঞাপনের অসাধারণ সৃজনশীলতা গভীরভাবে কোনো কিছু নিয়ে ভাবায়, কখনো হাসায় আর কখনো বা অজানা ও অদেখা অনেক সত্যকে তুলে ধরে আমাদের কাঁদায়। এ ধরনের বিজ্ঞাপনের পেছনে প্রতিষ্ঠানগুলোর কখনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যও থাকে, আবার সমাজ ও পরিবেশের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য থেকেও এ ধরনের কাজ করে থাকে তারা। চলুন তাহলে দেখে নেয়া যাক প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রকাশিত এমন কিছু দারুণ বিজ্ঞাপন।
ইকোভিয়া
ইকোভিয়া এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা মূলত কাজ করে ট্রাভেল ও ট্যুরিজম, ট্রান্সপোর্ট ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে তারা একটি ক্যাম্পেইনে কাজ করে, যার বিষয় ছিলো, জনগণকে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর বিষয়ে সতর্ক করা। গাড়ি চালানোর সময় এ ধরনের কাজ যে বড় রকমের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, সেটাই জানান দেয়া ছিলো তাদের মূল উদ্দেশ্য। ক্যাম্পেইনের নামটি ছিলো- ‘স্টপ দ্য ভায়োলেন্স, ডোন্ট টেক্সট অ্যান্ড ড্রাইভ’। ক্যাম্পেইনের বিজ্ঞাপনগুলো প্রকাশিত হয়েছিলো ব্রাজিলের পত্রিকা ও ম্যাগাজিনগুলোতে। এই বিজ্ঞাপনের ক্রিয়েটিভ এজেন্সি হিসেবে কাজ করেছে -Terremoto Propaganda Curitiba।
ওয়েট ওয়াচারস
এটি জার্মানির স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠান যা সঠিক ওজন নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত কাজ করে থাকে। একটি ক্যাম্পেইনের কিছু বিজ্ঞাপন মাধ্যমে, সার্ভিস সম্পর্কে জানাতে বেশ ভালো একটি উপায়ে উপস্থাপন করেছেন নিজেদেরকে। আর সেই ক্যাম্পেইনটির নাম হলো ‘ডোরস্’। ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত এই প্রিন্ট বিজ্ঞাপনটির ক্রিয়েটিভ এজেন্সি হিসেবে কাজ করেছে- FCB Hamburg। বিজ্ঞাপনটিতে কোনো ধরনের ট্যাগ লাইন বা কথা ব্যবহার করা হয়নি। তবে ছবিতেই বিষয়টি এতো স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, ঠিক কী নিয়ে তারা বলতে চাচ্ছে তা ছবি দেখে মুহূর্তেই বুঝে নেয়া সম্ভব।
চুপা চুপস্
স্পেনের চকলেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটি এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। মূলত বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে প্রতিষ্ঠানটি সুগার-ফ্রি ললিপপ বাজারজাত করে এবং এটি সৃজনশীলভাবে প্রচার করার দায়িত্ব দেয় DDB Advertising Agency-কে। প্যাকেট খোলা একটি ললিপপের পাশ কাটিয়ে লাইন ধরে পিঁপড়া যাচ্ছে, কিন্তু চকলেটে কোনো পিঁপড়া আসছে না। কারণ চকলেটে কোনো চিনি নেই। সুগার-ফ্রি বিষয়টি বোঝানোর জন্য বেশ সৃজনশীল একটি কৌশল ছিলো এই বিজ্ঞাপনটিতে।
ডব্লিউ ডব্লিউ এফ
১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বেসরকারি সংস্থাটি পরিবেশ রক্ষা ও প্রকৃতি সংরক্ষণের সচেতনতামূলক কাজ করে থাকে। একটি ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তারা জনগণকে এই বিষয়ে সচেতন করতে চান যে, বাস্তুসংস্থানের প্রতিটি পর্যায়ের প্রাণী মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে কাজ করে যাচ্ছে। আর এদের মধ্যে যেকোনো একটির অনুপস্থিতি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। এই বিজ্ঞাপনটিতে হাঙর মাছের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি দিয়ে খুব সৃজনশীলভাবে বিষয়টি ফুটিয়ে তুলেছে DDB, Turkey নামের বিজ্ঞাপন সংস্থাটি।
কিং খালিদ ফাউন্ডেশন
বেসরকারি এই সংস্থাটি কাজ করে মানবাধিকার নিয়ে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ‘সাম থিংস ক্যান্ট বি কভারড। ফাইটিং উইমেন্স অ্যাবইউস টুগেদার’, নামে একটি ক্যাম্পেইনের কাজ করে তারা। ক্যাম্পেইনের বিজ্ঞাপনগুলোর প্রতিটি ছবিরই রয়েছে ধারালো ও তীক্ষ্ণ ভাবার্থ। এগুলো দেখা মাত্রই মানুষকে ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করে। মজার বিষয় হলো, এটিই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সৌদি আরবের প্রথম বিজ্ঞাপন। এই কাজের ক্রিয়েটিভ এজেন্সি হিসেবে কাজ করে অগল্ভি, সৌদি আরব।
সেভ দ্য চিলড্রেন
আন্তর্জাতিক বেসরকারি এই সংস্থাটি কাজ করে শিশুদের অধিকার ও শিশু সম্পর্কিত সার্বিক বিষয় নিয়ে। ‘ব্রেক দ্য সার্কেল’ নামের ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তারা একটি বিষয় তুলে ধরে। বিষয়টি হলো যে, ৭০ শতাংশ নির্যাতিত বাচ্চারা বেড়ে ওঠে নির্যাতনকারী হয়ে। এই ক্যাম্পেইনে তিনটি আলাদা প্রিন্ট বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে প্রচার করা হয়। তিনটি বিজ্ঞাপনের নাম ছিলো- কিচেন সার্কেল, বেডরুম সার্কেল ও লিভিং রুম সার্কেল। বিজ্ঞাপনটির ক্রিয়েটিভ এজেন্সি হিসেবে কাজ করেছে- Y&R, Mexico।
ম্যাকডোনাল্ডস্
বিশ্ববিখ্যাত এই রেস্টুরেন্টটির নাম কে না জানে! ম্যাকডোনাল্ডস্-এর বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনই বুদ্ধিদীপ্ত ও দেখার মতো হয়। সেগুলোর মধ্যে একটি হলো তাদের ‘লার্জ কফি’-এর বিজ্ঞাপনটি। ১.৫ ইউরোতে এখানে কফি পাওয়া যায়- এই বিষয়টি প্রচারের জন্যই মূলত এই বিজ্ঞাপনটি করা। এই বিজ্ঞাপনের ছবিই যেন কথা বলে! ছবিতে কফি ভর্তি কাপটি এমনভাবে দেখানো হয়েছে যে, দেখে মনে হবে যেন একটি ইনফিনিটি পুল। অর্থাৎ নামমাত্র খরচে আপনি পেতে পারেন অনেক বেশি পরিমাণে কফি। এই বিজ্ঞাপনের ক্রিয়েটিভ এজেন্সি ছিলো- DDB, Finland।
ম্যাকক্যন হেলথ্ কেয়ার ওয়ার্ল্ড ওয়াইড, জাপান
স্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রমের সাথে জড়িত এই সংস্থাটি ২০১০ সালে ‘ওয়ার্ল্ড নো টোব্যাকো ডে’-তে দারুণ একটি ক্যাম্পেইনের প্রচারণার কাজ করে। ক্যাম্পেইনের নাম হলো ‘নো দ্য আগলি ট্রুথ’। তামাক সেবন করলে চেহারা ভেতর ও বাইরে থেকে নষ্ট হয়ে যায়- এই তথ্যটি ছবির কারসাজিতে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই বিজ্ঞাপনটিতে। এই ক্যাম্পেইনটির ক্রিয়েটিভ এজেন্সি হিসেবে কাজ করেছে- McCann Erickson, Tokyo।
ম্যাক্সাম টয়লেট্রিজ
চায়নার টুথপেস্ট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটি দাঁতের ক্ষয় এবং সমস্যা প্রতিরোধে সচেতন করে তুলতে ‘সিভিলাইজেশন’ নামে একটি ক্যাম্পেইন প্রচার করে। এই ক্যাম্পেইনে ছিলো দুটি প্রিন্ট বিজ্ঞাপন- সিভিলাইজেশন ইন ইজিপ্ট ও সিভিলাইজেশন ইন রোম। ছবি দুটিতে দাঁতের ক্ষয় বিষয়টি এতো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, মুগ্ধ না হওয়ার কোনো উপায় নেই। ক্যাম্পেইনটি কানস্ ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব ক্রিয়েটিভিটি-তে ‘গোল্ড আউট ডোর’ ও ‘গোল্ড প্রেস লাইওন্স’ পুরস্কার পায়। বিজ্ঞাপনটির ক্রিয়েটিভ এজেন্সি হিসেবে কাজ করে- JWT (J. Walter Thompson)।
নিভিয়া
জার্মানির এই প্রসাধনী ব্র্যান্ডটি পুরুষদের ত্বকের যত্নে ব্যবহৃত ক্রিমের প্রচারণার কাজটি চালায় দারুণ একটি ক্যাম্পেইন দিয়ে। ক্যাম্পেইনের কনসেপ্ট লাইন ছিলো- ‘Because life makes wrinkles’। ক্যাম্পেইনের বিজ্ঞাপনগুলোর ছবিতে একজন পুরুষের বলিরেখাকে কেন্দ্র করে বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জীবনের নানান চিন্তাই যে বলিরেখার মূল কারণ, তা-ই ছিলো এই ছবিগুলোর বার্তা। ক্যাম্পেইনের দুটি প্রিন্ট বিজ্ঞাপনের নাম হলো- ওয়ারি লাইনস্- কিডস্ এবং ওয়ারি লাইনস্- কার। বিজ্ঞাপনটির ক্রিয়েটিভ এজেন্সি হিসেবে কাজ করেছে- Jung Von Matt।
ক্রাইসিস রিলিফ সিঙ্গাপুর
যেকোনো দুর্যোগের সহায়তাকারী এই সংস্থাটি স্বেচ্ছাসেবকের খোঁজে একটি ক্যাম্পেইন প্রচারণা করে। ক্যাম্পেইনের নাম ‘লাইকিং ইজ নট হেল্পিং’। ক্যাম্পেইনের বিজ্ঞাপনগুলোর ছবি ছিলো অনেকটা এরকম যে, দুর্যোগ কবলিত ছবিতে অনেকগুলো আঙুল দেখা যাচ্ছে যা দ্বারা ‘লাইক’ চিহ্নটি বোঝানো হচ্ছে। আর ছবিগুলোর কপিতে লেখা- ‘লাইকিং ইজ নট হেল্পিং। বী এ ভলান্টিয়ার। চেঞ্জ এ লাইফ’। ক্যাম্পেইনটি কানস্ ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব ক্রিয়েটিভিটি-তে ‘গোল্ড প্রেস লায়ন্স’ পুরস্কার পায়। ক্যাম্পেইনটির ক্রিয়েটিভ এজেন্সি হিসেবে কাজ করে Publicis Singapore।
সারা বিশ্বে প্রচারিত এরকম দারুণ সব বিজ্ঞাপনের সংখ্যা কিন্তু কম নয় বটে! পরবর্তীতে আরও কিছু অসাধারণ বিজ্ঞাপন নিয়ে কথা হবে।