বাংলায় জাদু শব্দটি শুনলে মনে হয় কেউ রহস্যময় কেউ কাউকে মোহগ্রস্ত করেছে, কিংবা সম্মোহন বিষয়টা মাথায় আসে। আর ইংরেজিতে Magic অথবা Magic show শুনলেই চোখের পর্দায় ভেসে উঠে কালো পোশাক পরিহিত কোন ম্যাজিশিয়ান কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে কোন মানবীকে কেটে ফেলছে কিংবা একটি জলজ্যান্ত মানুষকে হাওয়া করে দিচ্ছে। আর দর্শকসারি ঊর্ধ্বশ্বাসে সম্মোহিতের মত চেয়ে থাকে স্টেজের দিকে। ম্যাজিশিয়ানের হাতের কারুকাজ, চোখের ভাষা আর কালো কাপড়ের দোলা তাদের নিয়ে যায় সম্মোহনের অন্য এক জগতে।
আজ আমরা তেমনি এক ম্যাজিশিয়ানের জীবন কাহিনী এবং তার ম্যাজিকের রহস্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। যাকে পৃথিবীর কোন শক্তিই বেঁধে বা আটকে রাখতে পারেনি। না কোন হাতকড়া (Handcuff), বড় বড় তালা, অথবা কোন বাক্সে বা সেলে, কোন কিছুতেই বেঁধে বা আটকে রাখতে পারেনি কোন শক্তি। অন্যন্য সব ম্যাজিক ট্রিক দিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছেন পুলিশ সহ যেকোন বাজিকে। দুঃসাহসিক সব ম্যাজিক ট্রিক দিয়ে সারা দুনিয়া মাতিয়েছেন, উনিশ শতকের শুরুর দিকের আমেরিকান সুপারহিরো হ্যারি হুডিনি। আমাদের এই ধারাবাহিকের নায়ক। হ্যারি হুডিনি একাধারে ম্যাজিশিয়ান, সম্মোহক (ইলিউশনিস্ট), দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জার, Escapist, নায়ক এবং লেখক। আরো বেশ কিছু বিশেষণে হ্যারি হুডিনিকে বিশেষায়িত করা যায়। হুডিনির এত সব বিশেষণের প্রত্যেকটি নিয়েই আমাদের আজকের ধারাবাহিক।
১৮৭৪ সালের ২৪ শে মার্চ হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে হ্যারি হুডিনির জন্ম। রাব্বি মায়ের উইয এবং সেসিলিয়া স্টেইনারের ৭ সন্তানের একজন হ্যারি হুডিনি। হুডিনির প্রকৃত নাম এরিক উইয (Erik Weisz)। ১৮৭৬ সালে পিতা রাব্বি মায়েরের হাত ধরে চোখে নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দেন। আমেরিকার উইসকনসিনের অ্যাপলেটনে বসবাস শুরু করেন। নিদারুণ দারিদ্র্যতায় দিন কাটছিল উইয পরিবারের। অসচ্ছল পরিবারকে খানিকটা সচ্ছলতা দিতে আট বছর বয়সী এরিক খবরের কাগজ এবং পুরোনো জুতা পালিশ করে বিক্রি করতেন।
অতঃপর ১৮৮৩ সালের ২৮শে অক্টোবর, এরিক দেখা দিলেন অন্য রুপে। সেই নয় বছরের খবরের কাগজ বিক্রেতা ছেলেটি সার্কাসে শারীরিক কসরত দেখিয়ে নাম কুড়ালো। অতি উৎসাহী এরিক নাম কুড়িয়ে নিজের নামের একটি সাইনবোর্ডও তৈরি করে ফেললেন। নিজেই নিজের নাম দিলেন “Ehrich, the Prince of the Air ”। ১৩ বছর বয়সে এরিক বাবার সাথে নিউ ইয়র্ক চলে এলেন। তখন একটি বোর্ডিং হাউজে থাকতেন। পরিবারের দারিদ্র্যতা ঘুচাতে তখনও এরিককে ছোট খাটো কাজ করতে হত। কখনো কারো ফুট ফরমাস খাটতেন কখনওবা ফটোগ্রাফারের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু দারিদ্র্যতা এরিককে তার স্বপ্নকে ভুলতে দেয়নি।
এর মধ্যেই এরিক এবং তার ভাই থিওডোর মিলে ম্যাজিক শেখা শুরু করলেন। এরিক ম্যাজিকের গুরু মানতেন আরেক বিখ্যাত ইলিউশনিস্ট জীন ইউজীন রবার্ট হুডিনকে। যার জীবনী এবং কর্ম এরিককে এতটাই অনুপ্রেরণা দিয়েছিল যে তিনি নিজের নামের উইয বাদ দিয়ে রাখলেন হুডিনি। হয়ে গেলেন এরিক হুডিনি। আর হ্যারি নামটি নিলেন হ্যারি কেলার এর নাম থেকে। এবং ১৭ বছর বয়সে এরিক উইয হয়ে গেলেন হ্যারি হুডিনি। ততদিনে ভাইয়ের সাথে ম্যাজিক শিখে রাস্তায় এবং বিভিন্ন মিউজিক শোতে “The Brothers Houdini” নামে ম্যাজিক দেখাতে লাগলেন এবং প্রশংসা কুড়াতে লাগলেন।
১৮৯৪ সালে, বিশ বছর বয়সে হ্যারি শুরু করলেন জীবনের নতুন এক অধ্যায়। বিয়ে করলেন উইলেমিনা বিয়াত্রিচে বেসিকে। জীবন সঙ্গিনীকে নিয়ে যোগ দিলেন ওয়েলস ব্রাদার সার্কাসে। সেখানে তারা গান গেয়ে মেটামরফোসিস নামক একটি ম্যাজিক দেখাতেন। কি সেই “Metamorphosis Trick”? চলুন দেখে নেই সেই ম্যাজিক এবং তার অন্তরালের রহস্য।
মেটামরফোসিস (Metamorphosis)
মেটামরফোসিস ট্রিকের মাধ্যমে দুইজন মানুষের স্থান পরিবর্তন দেখানো হতো। বিষয়টা কি? প্রথমে হুডিনির হাত হাতকড়া (Handcuff) দিয়ে পেছনে বাঁধা হত। দর্শকসারির কেউ চাইলে সেই হাতকড়া পরীক্ষা করেও দেখতে পারতেন। তারপর হুডিনিকে একটি কালো বস্তার মত ব্যাগে ঢুকানো হতো এবং সেই বস্তার মাথা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হতো। এবার আস্ত হুডিনিকে একটি বাক্সের ভেতরে পুরে ফেলে স্ত্রী বেসি নিজে একটি কালো পর্দা দিয়ে পুরো বাক্সটি ঢেকে দিতেন এবং নিজে সেই বাক্সের উপরে উঠে দাঁড়াতেন। বেসের তিন তালির সাথেই সাথেই বাক্সবন্দি হুডিনি বাক্সের উপর দাঁড়িয়ে পড়তেন আর বেসি হুডিনির মতো একই হাতকড়া এবং বস্তাবন্দি অবস্থায় বাক্সে পড়ে থাকতেন। ৩ সেকেন্ডের মাঝে হুডিনির উপরে চলে আসা এবং বেসির একইভাবে বাক্সবন্দি হয়ে পড়াটা সকলের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়।
ট্রিকের অন্তরালের রহস্য
ম্যাজিকটি যতটা না ট্রিকের তার চেয়ে বেশি অনুশীলনের। কারণ ৩ সেকেন্ড খুবই কম সময়, দুইজন মানুষের একই সাথে আলাদা সজ্জায়, আলাদা অবস্থানে পৌছানোর জন্য।
প্রথমত, হুডিনি যেকোন দড়ি এবং বাঁধন খোলার ওস্তাদ ছিলেন (আমরা পরবর্তীতে তার হাতকড়া খোলার কৌশল সম্পর্কে জানবো)।
দ্বিতীয়ত, যে বস্তাটি হুডিনিকে পরানো হত তার মুখের দিকে কয়েকটা ছিদ্র থাকতো। ফলে বস্তার মুখ দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকলেও হুডিনি সেই দড়ি কায়দা করে খুলে বের হয়ে আসতেন। পুরো ব্যাপারটি বাক্সের মধ্যে ঘটে বলে দর্শকগণ তা দেখতে পেতেন না।
তৃতীয়ত, পর্দার আড়াল থেকে যে তিনটি করতালির আওয়াজ পাওয়া যেত তা বেসির নয়, হুডিনির। এটি একটি সংকেত বলা যায়। প্রথম তালির আওয়াজ পেয়ে বেসি বাক্সের উপর পর্দা দিয়ে ঢেকে দাঁড়াতেন। ২য় তালির সংকেতে হুডিনি বক্স থেকে বের হওয়া শুরু করতেন এবং তৃতীয় তালির সংকেতে বেসি সম্পূর্ণরুপে হাতকড়া পড়ে বস্তাবন্দি হয়ে বাক্সের ভেতরে ঢুকে পড়তেন। মাত্র তিন সেকেন্ডেই দুই জন মানুষ তাদের স্থান বদলে ফেলেন। পুরোটাই তাদের টানা অনুশীলনের ফল।
মেটামরফোসিসের সাথে হুডিনি হাতকড়া পরা অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার অনেক ট্রিক দেখান। কেউ কোন ধরণের হাতকড়া পরিয়েও হুডিনিকে বেঁধে রাখতে পারেননি। হুডিনি এ নিয়ে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হয়েছিলেন। Handcuff চ্যালেঞ্জ হুডিনিকে “International Superhero” র খেতাব এনে দেয়। তখন তার জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে ছিল যে মানুষ তাকে “Harry Handcuff Houdini” কোনো কোনো অঞ্চলে “The Handcuff King” নামে ডাকতো। যখনি নতুন কোন শহরে যেতেন, তখনি কোনো না কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতেন এবং প্রতি চ্যালেঞ্জে ১০০ ডলার বাজি ধরতেন। ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স এবং স্কটল্যান্ডের স্থানীয় পুলিশও তার চ্যালেঞ্জ থেকে বাদ পড়েনি। হুডিনিকে কখনই বাজিতে হারতে হয়নি। দরিদ্র যুবক হুডিনির নাম তখন শহরে বন্দরে, লোকের মুখে মুখে, হয়ে উঠলেন সংবাদপত্রের শিরোনাম।
খ্যাতি আর যশ নিয়ে মেতে থাকার মানুষ হুডিনি নন। বরং নিত্য নতুন দুঃসাহসিক ম্যাজিক দেখিয়ে জনমনের মধ্যমণি হয়ে থাকাই তার পছন্দ। এবার হাতে নিলেন ঝুলন্ত অবস্থায় Straitjacket খুলে ফেলার ট্রিক। Straitjacket সাধারণত বড় ধরণের অপরাধীদের পড়ানো হয়, কিংবা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন রোগীদের পরানো হয়। এই জ্যাকেটের বৈশিষ্ট্য হল এতে অনেকগুলো বেল্ট থাকে যা দিয়ে অপরাধীর হাত প্রয়োজন মতো বিভিন্নভাবে বাঁধা যায়। যাতে অপরাধী সহজে পালাতে না পারে কিংবা রোগী কারো ক্ষতি না করতে পারে। ব্যস্ত রাস্তায় কিংবা জনসমাবেশ ডেকে হুডিনি এই ট্রিকটি দেখাতেন।
The Hanging Straitjacket Escape
এই শো টিতে তিনি কোনো সহযোগীর সাহায্য নিতেন না। বরং পুলিশের সাহায্য নিতেই তিনি পছন্দ করতেন। Straitjacket পড়েই হুডিনি ক্ষান্ত হতেন না। হাতে হাতকড়া পরানো হতো এবং পা দুটি দড়ি দিয়ে বেঁধে একটি ক্রেন দিয়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয়া হতো। যাতে তিনি কিভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় Straitjacket হতে বের হন সেটা সবাই দেখতে পায়।
ট্রিকের অন্তরালের রহস্য
Straitjacket এর রহস্যভেদ করেছিলেন হুডিনি নিজেই। এ নিয়ে “Handcuff Escape” নামক একটি বইও লিখেছিলেন। খোলার নিয়ম-
- উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয়ার পর হুডিনি পুরো শরীর যথাসম্ভব শক্ত করে খুব বড় করে শ্বাস নিতেন যাতে জ্যাকেটটি কিছুটা ঢিলা হয়। জ্যাকেট পরার সময় তিনি অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হাত, ডান হাতটি উপরে রাখতেন এবং বাম হাতটি নিচে।
- ডান হাতের কনুই দিয়ে ইচ্ছামতো টানাটানি করতেন এতে জামাটি আরো ঢিল হয়ে পড়ে। এবার ডান হাত বাম কাঁধের দিকে তোলার চেষ্টা করতেন পুরো শরীর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। বেশ খানিকটা ঢিলা হলে দাঁত দিয়ে বেল্ট বা বাঁধনগুলো খুলে ফেলতেন। এভাবে খুব সহজেই খুলে যেত হাতের বন্ধন।
- হাত মুক্ত হয়ে গেলে পিঠের এবং শরীরের বাকি বাঁধনগুলো খুলে ফেলা কোনো ব্যাপার নয়।
জ্যাকেটটি যেকোন অবস্থাতেই এই পদ্ধতিতে খুলে ফেলা যেত। কিন্তু হুডিনি ক্রেন দিয়ে ঝুলতেন কেন? কারণ জ্যাকেটটি খানিকটা ভারী হওয়ায় অতিদ্রুত খুলতে তিনি মহাকর্ষের সাহায্য নিতেন। তাছাড়া ব্যাপারটা বেশ নাটকীয়ও বটে।
এই ছিল হুডিনির শুরুর দিকের ২টি বিখ্যাত ম্যাজিক ট্রিক। ভয়ঙ্কর সব ম্যাজিক ট্রিক নিয়ে বাকি কাহিনী থাকছে পরবর্তী পর্বে।
Happy Reading!