সভ্যতার শুরু থেকেই জাদুবিদ্যা ও জাদুকর উভয়ের প্রতি মানুষের প্রচন্ড রকমের আগ্রহ রয়েছে। তবে কালোজাদু বলতে স্বভাবতই নেতিবাচক জাদুবিদ্যাকেই বোঝায়। হ্যারি পটারের জাদুর দুনিয়ার কথা তো আপনাদের সবারই মনে আছে। ওদিকে সিসিন কিংবা দ্য উইচিং এর মতো গা ছমছমে ভৌতিক সিনেমার ব্ল্যাক ম্যাজিকের কথাই বা বাদ দেই কীভাবে? তবে যা-ই বলুন না কেন, কালো জাদু নিয়ে আমাদের মাঝে ভয় এবং কৌতূহল দুটোই বিদ্যমান রয়েছে। জাদুবিদ্যার চর্চা মোটেই নতুন কিছু নয়। পৃথিবীতে বহুকাল আগে থেকেই মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা ও বিভিন্ন লোকাচারের চর্চা ছিল।
মূলত, সভ্যতা-পূর্ব যুগে সর্বপ্রাণবাদ ও আত্মার সন্তুষ্টি প্রার্থনার মাধ্যমে প্রাকৃতিক অতীন্দ্রিয় শক্তিকে বশীভূত করাই জাদুকরদের আদি মূলমন্ত্র ছিল। প্রচলিত প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলোতেও কোনো না কোনোভাবে ব্ল্যাক ম্যাজিক বা কালো জাদুর প্রসঙ্গ উল্লেখ থাকলেও এর চর্চা করা সব ধর্মেই কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। তাই কালো জাদু বিষয়ে নাড়াচাড়া করা আমাদের কাছে খানিক ভীতিকরই।
কিন্তু আমাদের কাছে যা ভীতিকর, পৃথিবীর কোনো এক দেশে তা-ই হয়তো বা প্রীতিকর! হ্যাঁ, এমন একটি দেশের কথাই জানাবো আপনাদের; নাম বেনিন, পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট একটি দেশ। সেই দেশের মানুষের প্রধান ধর্মই হলো কালো জাদু। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ভুডু। পড়তে নিশ্চয়ই একটু অবাক লাগছে যে, কালো জাদু বলতে যেখানে আমরা খুব ভয়ংকর কিছু বুঝি, সেটা আবার মানুষের ধর্ম হয় কীভাবে? তবে বেনিনে ভুডু বা কালো জাদুবিদ্যা ধর্মের থেকেও বেশি কিছু। কেননা ভুডু চর্চা এখানকার জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, আচার, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের সাথে হাজার হাজার বছর ধরে এমনভাবে মিশে আছে যে, তা এই সমাজের অস্তিত্বের অপর নাম। বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় ও দুর্বোধ্য ধর্মীয় চর্চা ও সংস্কৃতির নাম ভুডু। বলা বাহুল্য, বাকি দুনিয়ার লোক প্রায়শই ভুডুর আচারগুলোকে এখনো মোটা দাগে আদিম, অদ্ভুতুড়ে, বর্বর, অসভ্য আচার আচরণ হিসেবেই গণ্য করে।
কেমন এই অদ্ভুতুড়ে রহস্যময় ধর্ম, এর উৎপত্তিই বা কোথায়, অনুসারীদের বিশ্বাস ও রীতিনীতিগুলোই বা কেমন?
প্রথমেই বলে রাখা দরকার- ধর্ম হিসেবে ভুডু বা কালো জাদুর চর্চা কেবল বেনিন বা পশ্চিম আফ্রিকাতেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়, বরং এটি এর পার্শবর্তী দেশ টোগো, নাইজেরিয়ারও অন্যতম প্রধান ধর্ম। এছাড়াও মধ্য আমেরিকার দেশ হাইতি, কিউবা কিংবা নিউ অরলিয়েন্স এবং লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলেও ব্যাপকভাবে ভুডুর চর্চা রয়েছে। সব মিলিয়ে গোটা বিশ্বের ৬০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের ধর্ম ভুডু।
ভুডু নিয়ে যত বিতর্ক
কালোজাদু বলতে প্রথমেই আপনার চোখে হয়তো বা সিনেমায় দেখা সুঁই ফোটানো একটি ভুডু পুতুলের ছবি চোখে ভাসবে, যেখানে খারাপ আত্মাকে বেঁধে রাখা হয়। তবে এ কথা বলতেই হয় যে, আধুনিক কালে ইউরোপ এবং আমেরিকান সংস্কৃতিতে কালো জাদুর চর্চাকে যেমন ভয়ঙ্করভাবে দেখানো হয়, তার সাথে সত্যিকারের ভুডুর মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। কেননা, পশ্চিমা বিশ্ব ভুডুকে প্রায়ই ডাইনী বা ডাকিনীবিদ্যা অর্থাৎ শয়তান পূজারীদের সাথে গুলিয়ে ফেলে। বস্তুত, ভুডু অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় একটি ধর্ম। কারণ তারা খারাপ আত্মা নয়, বরং ভালো আত্মার প্রার্থনা করে, যা তাদের জীবনে মঙ্গল বয়ে আনে।
ভুডু চর্চা শান্তিপূর্ণ হলেও ভুডু নিয়ে সাধারণ মানুষের ভ্রান্ত ধারণা ও বিতর্কের শেষ নেই। অধিকাংশের ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও, সত্যি বলতে, খোদ বেনিনেও ভুডু নিয়ে এখনো সংশয়ের কমতি নেই। এখনো দেশে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে ভুডুয়ানদের কালো জাদুর খারাপ প্রভাবকে দায়ী করা হয়। এসব কারণে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সামনে প্রায়শই তাদেরকে কিছুটা হুমকির মুখে পড়তে হয়।
ভুডু কী?
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, ভুডু হলো কালো জাদুর ধর্ম। তবে এই ধর্মটি কিন্তু অন্যান্য ধর্ম থেকে একদমই আলাদা। কেননা, ধর্মের চেয়েও এর সাথে তাদের একান্ত নিজস্ব একটি দর্শন ও আদর্শ এখানে বেশি গুরুত্ব পায়। এই ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- এটি একইসাথে সর্বেশ্বর এবং একেশ্বরবাদী। তাই ভুডুয়ানরা সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে একজন পরম ঈশ্বরে আস্থা রাখে। ভুডুয়ানরা যাকে গুড গড বা ভালো ঈশ্বর বলে ডাকে, তার নাম বনডাই।
তবে খানিকটা হিন্দু ধর্মের মতো বিভিন্ন জগতকে কেন্দ্র করে তাদের ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবী রয়েছেন। ভুডুয়ানদের মোট দেবতার সংখ্যা এক শতাধিক, যাদেরকে তাদের ভাষায় মাহু বলা হয়। দেবতাদের নামগুলোও বেশ অদ্ভুত। যেমন- যুদ্ধবাজদের দেবতার নাম গৌ, রোগব্যাধি, আরোগ্য এবং মাটির দেবতার নাম সাকপাতা, ঝড়, বজ্রপাত আর ন্যায়বিচারের দেবতার নাম হেভিয়রসো আর পানির দেবতার নাম মামি ওয়াটা।
ভুডু বিশ্বাস
ভুডু ধর্মের মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক দর্শনকে কেন্দ্র করে। জীবন, আত্মা, সংগীত, নৃত্য- এ সবকিছুর সমন্বয় ঘটেছে এরূপ দর্শনে, যা মানুষের আদিমতম অতিপ্রাকৃতিক জীবনাচরণও বটে। যদিও আধুনিক বিশ্বের ভাবনায় কালো জাদু বলতে দুষ্টু জাদুকরদের ভণ্ডামো ছাড়া আর কিছুই নয়, যারা বিভিন্ন ধোঁকাবাজি করে লোকের ক্ষতি করে। কিন্তু বস্তুত ভুডুর প্রিস্ট বা ওঝাগণ মানুষকে খারাপ শক্তি থেকে রক্ষা করেন। অনেক সময় তারা মানুষকে আধ্যাত্মিক আচার-আচরণ ছাড়াও প্রাকৃতিক ও ভেষজ চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
ভুডুর গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তারা দুটি ভিন্ন জগতে বিশ্বাস করে। একটি হলো আমরা যে জগতকে প্রত্যক্ষ করি, অপরটি আমাদের অদেখা অদৃশ্য আরেকটি জগৎ। আর মৃত্যু হলো এই দুই জগতের যোগসূত্র। তারা বিশ্বাস করে, মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ এই দ্বিতীয় জগতে প্রবেশ করে। তাদের মতে, জীবিতদের সাথে সাথে মৃত ব্যক্তিগণও আমাদের মাঝেই বসবাস করেন। আমাদের মৃত পূর্বপুরুষদের প্রভাব আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের জীবনে সমৃদ্ধি ও মঙ্গলের জন্য তাদের আত্মার সন্তুষ্টি অর্জন প্রয়োজন। আর এজন্য ভুডুর কিছু নির্দিষ্ট আচার পালন করতে হয়।
মৃত ব্যক্তির আত্মাকে তাদের ভাষায় বলা হয় লোয়া। মজার ব্যাপার হলো আত্মা বা লোয়া বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। বিভিন্ন প্রয়োজনে যাজক বা ওঝারা বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির আত্মার শরণাপন্ন হন। যেমন- সমাজে অসহিষ্ণুতা ও সমতার শিক্ষা নিয়ে আসতে চাইলে তারা মহাত্মা গান্ধী কিংবা মার্টিন লুথার কিংয়ের আত্মাকে আমন্ত্রণ জানান। ভুডু ওঝাগণ বিশেষ মন্ত্র পাঠ করে জাদুর মাধ্যমে এ সকল আত্মাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন বলে বিশ্বাস করা হয়। আর এ কাজটিকে তারা সমাজসেবা হিসাবেই মনে করেন। মূলত আত্মার সাহায্য নিয়ে ব্যক্তির ভেতরকার আত্মোপলব্ধির জাগরণ করাই এই জাদুর বৃহৎ উদ্দেশ্য।
আচারসমূহ
ভুডু ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানগুলো বেশ অদ্ভুত এবং মজার। তাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আচার অনুষ্ঠান হলো গুনগুন। প্রতিবছর একটি বিশেষ দিনে এই গুনগুন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গুনগুনরা বিভিন্ন রঙের অদ্ভুত আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান। তারা বাদ্যের তালে তালে নেচে-গেয়ে মানুষকে আনন্দ দেন। তাদের বিশ্বাস, এদিন গ্রামবাসীদের পূর্বপুরুষদের আত্মা এসে গুনগুনের উপর ভর করে।
তারা মূলত বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রামের বিভিন্ন বিরোধ মেটাতে সাহায্য করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। গুনগুনের দেয়া সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে গুনগুনরা শ্রদ্ধার পাত্র হলেও সাধারণ মানুষ গুনগুনের থেকে একশো হাত দূরে থাকেন। কেননা, তারা মনে করেন, গুনগুন যদি কাউকে স্পর্শ করে, তবে সেই ব্যক্তি ও গুনগুন দুজনেরই তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই গ্রামবাসীরা অনুষ্ঠানের দিন গুনগুনের থেকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখেন।
প্রাণী উৎসর্গ
ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভের ইচ্ছায় তার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পশু প্রাণী উৎসর্গীকরণ বা বলিদান পৃথিবীর বহু ধর্মেরই একটি প্রাচীনতম রীতি। তেমনি ভুডু ধর্মের ঐতিহ্যবাহী আচারগুলোর আলোচনা করতে গেলে পশু বলি বা উৎসর্গর প্রসঙ্গ না আনলেই নয়। এই আচারটি ভুডু সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
উৎসর্গীকৃত পশু বা পাখির মাথা, রক্ত এবং পালক অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। এই আচার-অনুষ্ঠান পালন করলে পরমেশ্বর সন্তুষ্ট হন বলে ভুডুয়ানরা বিশ্বাস করেন।
ভুডুয়ানরা বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি পূজা করে থাকেন, যেগুলোর মধ্যে বানর, কুকুর, সাপ, কুমির প্রভৃতি অন্যতম। এসব প্রাণীর মাথার মূর্তির বাজারও রয়েছে সেখানে। এছাড়াও বিশেষ সংগীত ও নৃত্য উৎসব ভুডু সংস্কৃতি ও জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ভুডুর রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক সংকট
ভুডু ধর্ম বৃহৎভাবে একটি ভুডু সংস্কৃতি, যা বেনিন তথা পশ্চিম আফ্রিকার হাজার বছরের প্রাকৃতিক সংস্কৃতিরও একটি অবিচ্ছেদ্ধ অংশ বলা চলে। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে ভুডু সংস্কৃতি অনেকটাই হুমকির মুখে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাইতি এবং মধ্য আমেরিকার অনেক দেশেই ভুডু যাজকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের হাতে নিহত হয়েছেন।
এ অঞ্চলে ভুডুর এমন সংকটের কারণ উদঘাটন করতে হলে আফ্রিকার সাথে আমেরিকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমির প্রসঙ্গও গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকা মার্কিন উপনিবেশ থাকাকালে সেখান থেকে একসময় প্রচুর দাস-দাসীকে মধ্য আমেরিকার দ্বীপগুলোতে বন্দী করা হতো। সেই থেকেই ক্যারিবীয় অঞ্চলটিতে ধীরে ধীরে একটি আফ্রো-ক্যারিবিয়ান জাতিগোষ্ঠীর বসতি গড়ে ওঠে, যাদের অদিকাংশকেই পরবর্তীতে জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।
তবে তাদের জীবনধারার মধ্যে সংগোপনে পূর্বপুরুষের থেকে পাওয়া যুগ যুগ ধরে পালন করা ভুডু আচার-অনুষ্ঠানগুলোও কোনোভাবে থেকে যায়। ফলে এই অঞ্চলে দুটি ধর্ম ও সংস্কৃতির অভিযোজনে খানিক পরিবর্তিত একটি সংকর সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। ফলে এখন পর্যন্ত ক্যারিবীয় ক্যাথলিকগণ অনেকটা গোপনে লোকচক্ষুর আড়ালেই ভুডু বা কালো জাদুর চর্চা করে থাকেন। সুতরাং এখানে একইসাথে চিরায়ত রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে সাংস্কৃতিক সংঘাতের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
কালোজাদু বা ভুডু গোটা আফ্রিকান সংস্কৃতির সাথে এমনভাবে মিশে আছে যে, একে তাদের জীবন থেকে আলাদা করে দেখবার কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃতিকে ঘিরেই তাদের সকল আচার-সংস্কৃতি। প্রকৃতির মাঝেই যারা খুঁজে পায় জীবনের আধ্যাত্মিক শক্তি এবং এসবের মাঝেই যারা খুঁজে ফেরে জীবনের ঐন্দ্রজালিক অর্থ। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একটি একীভূত সত্ত্বা, যেখানে কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। তথাকথিত আধুনিক বিশ্বের কাছে যেখানে তারা এখনও বর্বর অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত, সেখানে তারা বিশ্বাস করে, “বিশ্বের সবকিছুই একসূত্রে গাঁথা। এখানে কোনোকিছুই দূর্ঘটনাবশত ঘটে না, বরঞ্চ সবকিছুই একে অপরের সাথে সম্পর্কিত।”