আমাদের জীবন কোনো না কোনো পর্যায়ে ব্যর্থতার ভীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কঠিন কোনো পরীক্ষা অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো চাকরির ভাইভা থেকে শুরু করে জীবনের নানা পর্যায়ে এই ভীতির আগমনী ঘণ্টা বাজতে পারে।
অনেকেই ভয়ে ভয়ে থাকেন, এই ভীতির চক্করে পড়ে জীবনটাই যদি বরবাদ হয়ে যায়! তবে আপনি যা ভাবছেন, ঠিক তেমনটা নয়, এই ভীতির মাত্রা আপনা-আপনিই দূরীভূত হওয়ার উপায়ও আছে। যদিও এতে কিছুদিন সময় লাগবে, কিন্তু আপনি এটা ঠিকই কাটিয়ে উঠতে পারবেন। হয়তো একসময় বুঝতে পারবেন যে, আপনার এই ব্যর্থতার পিছনে লুকিয়ে থাকা ভীতিটি একরকম অর্থহীনই।
আশার বাণী তো অনেক হলো, এবার একটু নিরাশার বাণীও শোনা যাক। আর তা হলো, আমাদের মধ্যেই অনেক মানুষ আছেন, যারা দুর্ভাগ্যবশত এই ভীতি কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হন বা প্রতিনিয়ত হচ্ছেন। আর এই সমসাময়িক ভীতি নামক গোলকধাঁধাটি মূলত ‘অ্যাটিকিফোবিয়া’ নামেই পরিচিত।
অ্যাটিকিফোবিয়া আসলে কী?
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে, ‘Atychiphobia’ হচ্ছে ব্যর্থতাভীতি বা ব্যর্থ হবার ভয়। এটি ক্যারোক্রাফিওফোবিয়া (kakorrhaphiophobia) বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভীতি নামেও পরিচিত। তবে ব্যর্থতার সাময়িক ভীতিসম্পন্ন ব্যক্তির চাইতে অ্যাটিকিফোবিয়ার প্রভাব ব্যক্তির উপরে বেশি ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে।
‘অ্যাটিকিফোবিয়া’র কাজই হচ্ছে, আপনার সামনে কোনো কিছুকে অকাট্য ভিত্তি হিসাবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া, ধরে নিতে বাধ্য করা যে, ব্যর্থতা আপনার জন্য সবচেয়ে খারাপ ঘটনা। হয়তো বা এর পিছনে লজ্জাজনক কোনো পরিস্থিতির ট্রমাটিক প্রভাব থাকাও অসম্ভব কিছু না। হয়তো এর পিছনে আপনার শৈশবের কোনো ধারণা কিংবা চলমান ঘটনা কাজ করছে। অথবা আপনার বাবা-মায়ের প্রত্যাশার চাপ ও কঠোর বিধিনিষেধও এর জন্য দায়ী হতে পারে।
সাধারণত অ্যাটিকিফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেকোনো মূল্যে ব্যর্থতাকে এড়িয়ে যেতে চান, তবে এর জন্য কিন্তু তিনি বিভিন্ন পন্থার আশ্রয় নিতেও ভুল করেন না। উদাহরণস্বরূপ দেখা যায়, চাকরির মৌখিক পরীক্ষার জন্য একজন অ্যাটিকিফোবিয়াতে আক্রান্ত ব্যক্তি উপস্থিত হওয়ার সাহস অর্জন করে উঠতে পারেন না. কারণ একটাই, ব্যর্থ হবার ভীতি। অথবা এমনও দেখা যায়, উক্ত ব্যক্তি প্রয়োজনের চাইতে অতিরিক্ত প্রস্তুতি নিয়ে ইন্টারভিউ বোর্ডে এক ঘন্টা আগে হাতে চাকুরি পাবার উপযুক্ত কারণসমূহের প্রেজেন্টেশন নিয়ে বসে আছেন; অথচ দেখা গেলো, এগুলোর কোনো দরকারই পড়লো না। মূল সমস্যা হচ্ছে, এই ভীতিও কিন্তু ব্যক্তির জীবনে মানসিক, শারীরিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে খারাপ প্রভাব ফেলে।
অ্যাটিকিফোবিয়ার কারণ ও লক্ষণসমূহ
বৈজ্ঞানিক কিছু ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, মানুষের মস্তিষ্কের কিছু ত্রুটিপূর্ণতার দরুন এই ফোবিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। এই ত্রুটিপূর্ণতার বিশদ ব্যাখ্যার জন্য আমাদের আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে অ্যাটিকিফোবিয়ার বিভিন্ন লক্ষণ চিহ্নিত করা যায়।
এ ধরনের মানসিক সমস্যার সাথে জড়িত ব্যাপারগুলোর মধ্যে বড় সমস্যাটি হচ্ছে, এটি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন প্রকারের লক্ষণ নিয়ে মাথাচাড়া দেয়। অবশ্য এগুলোর ভিতরেও সাধারণ কয়েকটি লক্ষণ রয়েছে। আবার অ্যাটিকিফোবিয়া মূলত মানসিক সমস্যার রূপ নিয়ে হাজির হলেও এটি কোনো কোনো সময় শারীরিক অসুস্থতার প্রধান কারণও হতে পারে।
বলা যায়, অ্যাটিকিফোবিয়াতে আক্রান্ত ব্যক্তি সারাক্ষণ ব্যর্থ হবার একটি তীব্র, অযৌক্তিক ভয়ের ভেতরে বসবাস করেন। এমনকি এই ভয় তাদের সামাজিক ও কর্মজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দেখা যায়, ওই ব্যক্তি কোনো একটি কাজের আগে হয়তো এর বাইরে চিন্তা করার সুযোগই পান না। এমনও হতে পারে, ব্যর্থ হবার অগ্রিম চিন্তা করে সেই কাজে হাত দিতেই সাহস পান না; অথবা দিলেও মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে বসেন। হয়ত কাজ শুরু করেও বার বার থেমে যান অথবা বাতিল করে দিতে থাকেন। কারণ, তিনি চিন্তা করতে থাকেন, কাজটি হয়ত যথেষ্ট ভালো হয়নি। আসলে এটির মাত্রা আক্রান্ত ব্যক্তির উপরে নির্ভর করে; এখানেও সহজেই বিভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যায়।
অ্যাটিকিফোবিয়াতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়।
- দ্রুত রক্ত চলাচল
- শরীর কাঁপতে থাকা
- দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস
- বুকে চাপ পড়া অথবা ব্যথা অনুভূত হওয়া
- শ্বাস ধরে রাখতে না পারা
- বমি বমি ভাব
- পরিপাকজনিত সমস্যা
- আত্মবিশ্বাসহীনতা
- ভয় পাওয়ার অনুভুতি
- ঘামতে থাকা
- মাথাব্যথা
- পেশীর নিয়ন্ত্রণহীনতা
- আতংকিত হয়ে পড়া
এই লক্ষণগুলো বিচ্ছিন্নভাবে বা একসাথে দেখা দিতে পারে। কখনো মাথাব্যথা দিয়ে শুরু হলেও, এরপরে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে আতংকিত হওয়া, যেকোনোটি হতে পারে। বমির ভাবও দেখা দিতে পারে, যা আপনার পাকস্থলীতে খারাপ অনুভূতির সৃষ্টি করে আর আপনাকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিবার ওয়াশরুমে যেতে বাধ্য করে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মনে রাখা দরকার যে, অ্যাটিকিফোবিয়া একেকজনকে একেক উপায়ে আক্রমণ করতে পারে। এর সাথে জড়িত আরও কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত।
অ্যাটিকিফোবিয়া সম্পর্কিত ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়সমূহ
যেহেতু এটির মূল কারণ সম্পর্কে আমরা শতভাগ অবগত নই, তাই ধরে নেওয়া যায়, এর পেছনে কতিপয় ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ কাজ করে। এমনও কিছু আলামত রয়েছে, যার উপরে ভিত্তি করে বলা যায়, বংশধারা, পরিবেশ, বেড়ে ওঠা ইত্যাদি বিষয় এর পেছনে থাকতে পারে। যদি আপনার কোনো নিকটাত্মীয় এতে ভুগে থাকেন, তাহলে এটি আপনাকেও আক্রান্ত করতে পারে। তবে পুরো ব্যাপারটি নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত নন।
এসব ঝুঁকির পাশাপাশি অন্যান্য কিছু জটিলতাও দেখা দেয়। এ অবস্থায় মানসিক অসুস্থতার সমস্যাটি আরও অধিক পরিমাণে মানসিক সমস্যার জন্ম দেয়। ব্যর্থতাভীতি আর প্রত্যাখ্যানভীতি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তাই একজন ব্যক্তির পক্ষে উভয় সমস্যায় আক্রান্ত হওয়াও অসম্ভব নয়। বিশ্বাসটি দাঁড়ায় এরকম, ব্যর্থ হলেই এই ব্যর্থতার কারণে আপনি প্রত্যাখ্যাত হয়ে যাবেন। এ কারণেই এই দুটি সমস্যা একটি আরেকটির পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও আরও কিছু জটিলতায় পড়তে পারেন আক্রান্ত ব্যক্তিরা।
ব্যর্থতাভীতির কারণে অনেকেই কাজের প্রয়োজনে বাইরে যেতে দ্বিধায় পড়ে যান কিংবা যানই না। আর এভাবেই অ্যাটিকিফোবিয়াতে আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিকভাবে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকেন। তীব্র ব্যর্থতাভীতির কারণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অবসাদ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। নিজেদের ব্যর্থতাভীতি এড়িয়ে চলার জন্য ভুলবশত ব্যক্তি বিভিন্ন রকম মাদকদ্রব্য ও অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়তে পারেন। অ্যাটিকিফোবিয়া এবং এর সাথে জড়িত লক্ষণ ও জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হিসাবে একজন তীব্রভাবে আক্রান্ত ব্যক্তি আত্মহত্যার পথেও ঝুঁকতে পারেন।
তবে অ্যাটিকিফোবিয়াজনিত বিভিন্ন ভয়াবহ বিষয় থাকলেও এ থেকে মুক্তি পাওয়ার যে কোনো রাস্তাই নেই, সেরকমটা কিন্তু নয়।
নিরাময় ও প্রতিকার
অ্যাটিকিফোবিয়া নিরাময়ের মূলত কোনো একমুখী ব্যবস্থা নেই। তবে এ সম্পর্কে তিনটি বিষয় জানা জরুরী।
১. এটি নিরাময় অবশ্যই সম্ভব। তবে সেটি খুঁজে বের করার ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকা প্রয়োজন।
২. নিরাময় তখনই সম্ভব, যখন আপনি নিজে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য সচেতনভাবে সমানতালে চেষ্টা করে যাবেন।
৩. এটির অস্তিত্ব থাকে আপনার অবচেতন মনের গভীরে। তবে সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য না হলেও এটি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আপনার মানসিক শক্তিই এখানে মূল হাতিয়ার হিসাবে কাজ করবে।
ব্যর্থতাভীতি আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে না তো?
জীবন অত্যন্ত মূল্যবান, তাই একে মূল্যায়ন করতে শিখুন। জীবনে ভুলে যাওয়ার মতো কিছু ঘটনা প্রত্যেকেরই ঘটে। কিন্তু সেটিকে পিছনে ফেলে জীবনযাপন করুন নিজের মতো করে। ব্যর্থতার সামান্য ভয় কেন আপনার জীবনকে রুদ্ধ করে রাখবে? চিন্তা করুন। নিজের মধ্যে এই সমস্যা উপলব্ধি করলে আপনি মনোবিদের শরণাপন্ন হতে লজ্জা বা ভয় করবেন না। এত সুন্দর পৃথিবীর চলমান জীবনস্রোতের একটি অংশ হতে চেষ্টা করুন। ব্যর্থতা মানুষেরই হয়, ব্যর্থ না হলে সফলতার আনন্দ পাওয়া যায় না। তাই একে ভয় পাওয়া নয়, জয় করার চেষ্টা করুন।
ফিচার ইমেজ: Huffington post