বর্তমানে ক্রমবর্ধমান নগরায়ন এবং গতিশীল যান্ত্রিক সমাজে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস দিতে পারে যেন দু’চাকার সাইকেল। পৃথিবীর অনেক আধুনিক দেশ বর্তমানে এই বাহনটিকে বেশ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। সাইকেল শুধুমাত্র নগরায়নের প্রশান্তি নয়, সাইকেল চালকের স্বাস্থ্য উন্নয়নের বিচারেও এর ভূমিকা অপরিসীম। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে, ছোট থেকে বৃদ্ধ সবাইই সাইকেল চালিয়ে তাদের নিত্যদিনের কাজ সম্পন্ন করছেন। আজ আমরা তেমন কিছু শহরের কথা জানব, যেখানে তেল পোড়ানো যানের চাইতে সাইকেল নামক দ্বিযানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব রয়েছে অনেক বেশি।
আমস্টারডাম, নেদারল্যান্ড
সাইকেলবান্ধব বলতে যে শহরটির কথা প্রথমে চলে আসে, সেটি হলো নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম। নেদারল্যান্ডের সবচাইতে জনবসতিপূর্ণ শহর এটি। শহরের প্রায় ৩৮ শতাংশ মানুষের যাতায়াতের বাহন হিসেবে প্রথম পছন্দ সাইকেল। আমস্টারডামের মোট জনসংখ্যার চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা নাকি অনেক বেশি। এক তথ্য হতে জানা যায় সাত লক্ষ লোকের আবাসস্থল আমস্টারডামে সাইকেলের সংখ্যা প্রায় ৮ লক্ষ। তাই আমস্টারডামকে সাইকেলের শহর বা দু চাকার শহরও বলা হয়ে থাকে।
শহরে সাইকেল পার্কিংয়ের জন্য রয়েছে আলাদা সাইকেল স্টেশন। শহরে আসা পর্যটকদের জন্য নেদারল্যান্ড ন্যাশনাল সাইকেল নেটওয়ার্কের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় বাইসাইকেল ট্যুরিজম, যেখান থেকে নতুন সাইকেল ভাড়া নেয়া যায়। তার সাথে সাইকেল আরোহীকে দেয়া হয়ে থাকে সাইকেল স্মরণিকা, এতে রয়েছে সাইকেলের পৃথক রূপের মানচিত্র, কীভাবে সাইকেল চালাতে হবে, নিরাপদ সাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে যেসব নিয়মকানুন মানতে হবে, তার নির্দেশনা সম্বলিত সুনির্দিষ্ট বর্ণনাও সুন্দরভাবে দেয়া রয়েছে স্মরণিকাতে।
শহরে রয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট সাইকেল স্ট্যান্ডিং পার্ক। শহরে সাইকেলের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক সাইকেল আরোহী তাড়াহুড়োয় সঠিক জায়গায় সাইকেল পার্ক করতে ভুলে যান। আবার অনেকে নির্দিষ্ট কোন লেনে তার সাইকেলটি রেখেছেন, তা গুলিয়ে ফেলেন। ফলে অনেকে সময় নিজের সাইকেলটি না পেয়ে তাকে হেঁটে বা পাবলিক পরিবহনে করে বাসায় ফিরতে হয়। আর নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক না করার কারণে পার্কবিহীন সাইকেলগুলো পাঠানো হয় সাইকেলের খোয়াড়ে। পরে উপযুক্ত মালিককে তথ্য প্রমাণ দিয়ে তা ফিরিয়ে দেয়া হয়।
বার্লিন, জার্মানি
সাইকেলবান্ধব শহর হিসেবে বার্লিনেরও বেশ পরিচিতি রয়েছে। শহরের চার লক্ষ মানুষ তাদের দৈনন্দিন যাতায়াতের জন্য এই দ্বিচক্রযানের ওপরেই নির্ভরশীল। শহরের ৯০০ কিমি (প্রায় ৫৫৯ মাইল) সাইকেলের জন্য পৃথক পথ রয়েছে, যার ফলে সাইকেল আরোহীরা সাইকেল চালানোতে বেশ নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দ অনুভব করে থাকেন। সাইকেল রাস্তাগুলো সমতল এবং তুলনামূলকভাবে বেশ প্রশস্ত হওয়ায় দিন দিন শহরে সাইকেল আরোহীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরের পরিবহন সংস্থাও সাইকেল চালানোর ব্যাপারে শহরবাসীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য নানা প্রোগ্রাম নিয়ে থাকেন।
কোপনেহেগেন, ডেনমার্ক
এই বিশ্বের অন্যতম উন্নত সমৃদ্ধ এক দেশের নাম ডেনমার্ক। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন শহরকে বলা হয়ে থাকে দু চাকার যানের জন্য এক আদর্শ শহর। বর্তমানে কোপেনহেগেন বিশ্বব্যাপী সাইকেল বান্ধব শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। শহরের পৌরসংস্থা প্রদত্ত এক তথ্য হতে জানা যায়, শহরের প্রায় ৪১ শতাংশ নাগরিক যাতায়াতের জন্য সাইকেল ব্যবহার করে থাকে। ডেনিশরা খুবই পরিবেশ সচেতন। আর পরিবশের দূষণ রোধে সাইকেল সংস্কৃতি তাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পরিবেশকে সবুজ রাখা এবং নিজেদের শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য ডেনমার্কের অধিবাসীরা শিশু বয়স থেকেই সাইকেল চালানো শুরু করে।
ডেনমার্কের অধিবাসীদের প্রতিটি পরিবারেই সাইকেল যেন এক বাধ্যতামূলক বাহন এবং প্রত্যেক পরিরিবারে তা থাকা যেন এক নিয়মে পরিণত হয়েছে। কোনো পর্যটক কোপেনহেগেনে ভ্রমণে এলেই প্রথমে তার চোখে পড়বে শহরের বিভিন্ন স্ট্যান্ডে দাঁড় করে রাখা শত শত সাইকেলের সারি। সাইকেল চালানোর জন্য নির্মাণ করা হয়েছে আলাদা সাইকেল লেন। কোথাও কোথাও নির্মিত হয়েছে সাইকেল সুপার হাইওয়ে। শুধু তা-ই নয়, সাইকেল চালানোকে উৎসাহিত করার জন্য সরকারের মন্ত্রী, এমপিরাও এই দু চাকার যান ব্যবহার করে পার্লামেন্ট এবং সরকারী কার্যালয়ে অাসা যাওয়া করে থাকেন।
কোপেনহেগেন শহর কতৃপক্ষ সাইকেল আরোহীদের জন্য বিভিন্ন সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। শুধু সাইকেল চালকদের জন্য অবকাঠামো তৈরি করাই নয়, সাইকেল আরোহীরা যেন নিয়ম মেনে সাইকেল চালান কিনা, তা তদারকির জন্য সাইকেল লেনেগুলোতে পৃথক ট্রাফিকেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
মন্ট্রিয়াল, কানাডা
কানাডার মন্ট্রিয়াল শহরটিতে প্রায় ৬০০ কিলোমিটারের (প্রায় ৩৭৩ মাইল) মতো সাইকেল চালানোর জন্য আলাদা রাস্তা রয়েছে, যা ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে সাইকেলের জন্য রাখা রাস্তার চেয়ে দ্বিগুন। প্রতি বছর সাইকেল লেনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, যাতে আরোহীরা নিরাপদে সাইকেল চালাতে পারে। বছরের একটি বিশেষ দিনে বেশ জাঁকজমক করে বার্ষিক সাইকেল উৎসব পালন করা হয় যা পর্যটকদের জন্য এক প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে।
পোর্টল্যান্ড, ওরিগন
সাইকেল বান্ধব শহর হিসেবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের যেরকম সুনাম আছে, সেদিকে থেকে পিছিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ওরিগন রাজ্যের পোর্টল্যান্ড শহরে ইউরোপের বিভিন্ন শহরের ধাঁচে সাইকেল বান্ধব পরিবেশে হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। পোর্টল্যান্ডের ট্রান্সপোর্টেশন ব্যুরো ধীরে ধীরে শহরের অধিবাসীদের জন্য এবং ভ্রমণার্থীদের জন্য নিরাপদ সাইকেল চালানোর অবকাঠামো নির্মাণের ব্যবস্থা করছে।
এছাড়া সাইকেল চালানো শিক্ষা এবং নিরাপদে সাইকেলে ভ্রমণের গাইডলাইনও তৈরি করেছে প্রশাসন। পোর্টল্যান্ডের সাইকেল পরিকাঠামোর অংশ হিসেবে, শহরের ২৬০ মাইল রাস্তা সাইকেল লেন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সাইক্লিস্টদের জন্য শহর ভ্রমণের ব্যাপারে বিনামূল্যে মুদ্রিত শহর ও তার আশপাশের শহরের নকশা এবং নিরাপদ ভ্রমণ সংক্রান্ত নানাবিধ তথ্য প্রদান করা হয়ে থাকে। এছাড়া সাইকেল ভাড়া দেয়ার ব্যবস্থাও চালু রাখা হয়েছে এই শহরে।
বার্সেলোনা, স্পেন
সাইকেল আরোহীদের জন্য সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন জায়গা হিসেবে পরিচিত স্পেনের বার্সেলোনা শহর। শহরের পরিবহণ সংস্থা নিরাপদ সাইকেল চালানোকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। আর এ কারণে প্রশাসন চার চাকার গাড়িগুলোর গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে নানাবিধ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। শহরে সাইক্লিস্টদের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য আলাদা সাইকেল পথ প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। ২০০৭ সাল থেকে এখানে রেন্ট সিস্টেমের আওতায় সাইকেল ভাড়া দেয়ার প্রোগ্রাম চালু হয়েছে, বর্তমানে এই প্রোগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। দু চাকার যানকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রতিবছর মে মাসে বেশ আনন্দমুখর পরিবেশে বার্ষিক বাই সাইকেল সপ্তাহ পালিত হয়। শহরের পর্যটকদের জন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এমন সাইকেল পথ নির্মাণ করা হয়েছে, যার জন্য অবশ্যই ভ্রমনার্থীকে রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক।
প্যারিস, ফ্রান্স
সাইকেল চালানোর জন্য প্যারিস এক আদর্শ স্থান। ২০০৭ সালে সাইকেল-শেয়ারিং প্রোগ্রাম চালু হওয়ার পর থেকে শহর জুড়ে সাইকেল চালানোর পরিমাণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শহরের ১৮০০ সাইকেল স্টেশন থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০০০ এর অধিক সাইকেল ভাড়া দেয়া হয়ে থাকে। ৩০ মিনিটের কম দূরত্বের জন্য সাইকেল আরোহীকে কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হয় না। চীনের পর এটির বিশ্বের বৃহৎ বাই সাইকেল রেন্টাল প্রোগ্রাম। শহরের সমতল রাস্তা, শহরের ব্যস্ততাহীন রাস্তায় সাইকেল চালানোর পক্ষে বেশ আরামদায়ক। সাইকেল চালানোর জন্য রয়েছে আলাদা সাইকেল লেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই শহরটিকে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বের সেরা সাইকেল বান্ধব শহর হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলছে।
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড
আয়ারল্যান্ডের পুরো ডাবলিন শহর জুড়ে রয়েছে ১০০টির অধিক সাইকেল স্টেশন। এসব স্টেশন পরিচালনার জন্য বছরে প্রত্যেক স্টেশন বাবদ সাবস্ক্রিপশন ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ২২ ডলার। ডাবলিনের বেশ কয়েকটি পর্যটন সংস্থা রয়েছে, যারা সাইকেল আরোহীদের জন্য নানা সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে থাকেন। এসব সংস্থার মাধ্যমে নতুনদের সাইকেল চালানো শেখানো থেকে শুরু করে প্রশিক্ষিত সাইক্লিস্টদের ভ্রমণের নানা সুব্যবস্থার বন্দোবস্ত করা হয়ে থাকে ।
সাংঘাই, চীন
চীনের সাংঘাই শহরে ৪৩০ মিলিয়নের বেশি মানুষের সাইকেল রয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে সাংঘাই একমাত্র স্থান, যেখানে প্রতিদিন এতো বিপুল সংখ্যক জনগণ সাইকেলের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব গন্তব্যে পৌঁছে থাকে। ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরের অর্ধেক মানুষ তাদের দৈনন্দিন যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে সাইকেলকেই পছন্দের তালিকায় রাখে।
বিশ্বের বাইক শেয়ারিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে সাংঘাই বিশ্বের চতুর্থ শহর। এখানে প্রতিদিন ১৯০০ সাইকেল ভাড়া দেয়া হয়। তবে শহরে দিন দিন সাইকেল আরোহীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাইকেল লেনের জন্য ধীরে ধীরে এর একটি বৃহৎ অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শহরটিতে নিরাপদে সাইকেল চালানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে সাংঘাই পরিবহন সংস্থার আশাবাদ।
ফিচার ইমেজ- www.bikecitizens.net