বিশ্বজুড়ে চলছে নভেল করোনা তাণ্ডব, কুপোকাত হচ্ছে একের পর এক দেশ। লকডাউনের ফলে অচল হয়ে পড়ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং স্থবির হয়ে পড়ছে জনজীবন। বিজ্ঞানী এবং গবেষক থেকে শুরু করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সকলেই হন্যে হয়ে এই সমস্যার সমাধান খুঁজছেন। জনসচেতনতা, শহর লকডাউন, ওষুধ এবং ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের প্রাণান্ত চেষ্টাসহ সম্ভাব্য সকল উপায়েই চেষ্টা করছেন তারা। কিন্তু কিছুতেই করোনাভাইরাসের দৌরাত্ম থামানো যাচ্ছে না।
তবে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন হার্ড ইমিউনিটিকে করোনাভাইরাস সমস্যার সমাধান হিসেবে ইঙ্গিত করেছেন। যুক্তরাজ্য সরকারের প্রধান বিজ্ঞান উপদেষ্টা প্যাট্রিক ভ্যালেন্স বলেছেন, “দেশের এক প্রকার হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলা প্রয়োজন যাতে করে আরও মানুষ এই রোগ প্রতিরোধী হয়ে সংক্রমণ কমিয়ে আনতে পারে”।
কিন্তু কী এই হার্ড ইমিউনিটি? নভেল করোনা সমস্যার সমাধানে হার্ড ইমিউনিটি কি আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আজকের লেখা।
হার্ড ইমিউনিটি এবং এর অর্জন প্রক্রিয়া
প্রথমেই জানা দরকার হার্ড ইমিউনিটি কী। যখন কোনো অঞ্চলের অল্প কিছু মানুষ বাদে বেশিরভাগ মানুষই কোনো নির্দিষ্ট রোগ প্রতিরোধী হয়ে যায় তখন উক্ত রোগ সেখানে মানুষ থেকে মানুষে সহজে ছড়াতে পারে না। ফলে সেই অঞ্চলের নন-ইমিউন মানুষগুলোর সেই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়, তথা পরোক্ষভাবে তারাও অনাক্রম্য হয়ে যায়।
বিষয়টি একটি উদাহরণে মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যাক। মনে করি, কোনো অঞ্চলের ৫০ জন অধিবাসীর ৪০ জনই পোলিও প্রতিরোধী। তাহলে বাকি ১০ জন নন ইমিউন লোকদের পোলিওতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। অর্থাৎ তারাও পরোক্ষভাবে পোলিও প্রতিরোধী। এই ধরনের ইমিউনিটিকে বলে হার্ড ইমিউনিটি।
আমাদের শরীর কোনো নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে দুই উপায়ে অনাক্রম্য হতে পারে- স্বাভাবিক সংক্রমণ এবং ভ্যাক্সিন প্রয়োগ। যখন আমাদের শরীর কোনো জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়, তখন শরীর সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে সাড়া দেয় এবং তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। একইসাথে শরীর সেই জীবাণুকে চিনে রাখে। ফলে, পরবর্তীতে সেই জীবাণু দ্বারা আবার আক্রান্ত হলে, শরীর সেটিকে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে পারে।
বেশিরভাগ রোগের ক্ষেত্রেই এই ইমিউনিটি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং সারাজীবন বিদ্যমান থাকে।
হার্ড ইমিউনিটি যেভাবে করোনাভাইরাসকে থামাতে পারে
প্রথমেই জানা থাকা দরকার যে, কোনো ভাইরাস যত বেশি সংক্রামক, সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হলে সেই ভাইরাস দ্বারা তত বেশি মানুষকে আক্রান্ত হওয়া প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, হাম একটি অত্যন্ত সংক্রামক রোগ এবং এর ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি পেতে হলে ৯০% মানুষকে আক্রান্ত হতে হবে।
আবার, জনসাধারণের মাঝে ব্যাপক আকারে ভ্যাক্সিন প্রয়োগের মাধ্যমেও হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা যায়। মূলত, গুটিবসন্ত এবং পোলিওর মতো রোগকে এই উপায়েই নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। কোভিড-১৯-ও এভাবে নির্মূল করা যেতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন আবিষ্কার এবং তা বাজারে আসতে যে সময়ের প্রয়োজন সেটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তাই করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের কৌশল হিসেবে যেটি বলা হচ্ছে সেটি হলো, বিস্তৃত আকারে এবং ব্যাপকভাবে একে ছড়তে দেওয়া। যখন ভাইরাস এভাবে ছড়াতে থাকবে তখন প্রচুর মানুষ এর দ্বারা আক্রান্ত হবে। যদি আক্রান্ত মানুষজন কোভিড-১৯ হতে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে তাহলে তারা এই রোগ প্রতিরোধী হবে। ফলে ভাইরাস নতুন করে সংক্রমিত করার মতো কোনো মানুষ খুঁজে পাবে না। ফলে সংক্রমণের হার শূন্যে নেমে আসবে।
২০১৫ সালে ব্রাজিলে জিকাভাইরাস মহামারী আকারে ধারণ করার ২ বছর পর একদল গবেষক সালভাদর শহরে জিকাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত জনসংখ্যার প্রায় ৬৩% লোকের উপর এক গবেষণা চালান। গবেষণায় দেখা যায়, হার্ড ইমিউনিটি জিকাভাইরাসের বিস্তার রোধে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
গবেষণা বলছে, যখন কোনো রোগ সূচকীয় হারে ছড়াতে থাকে তখন যদি মোট জনসংখ্যার অর্ধেককেও তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধী করা যায়, তাহলে মহামারী আর সেই হারে ছড়াতে পারে না।
হার্ড ইমিউনিটি জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার হারের সাথেও গাণিতিকভাবে সম্পর্কিত। জীবাণু ছড়ানোর হারকে Reproduction number, R0 দ্বারা প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, করোনাভাইরাসের R0 ২ থেকে ২.৫ এর মধ্যে। অর্থাৎ একজন আক্রান্ত মানুষ দুজনের মাঝে এটি ছড়াতে পারেন।
তাহলে কোনো জনপদের একজন যদি আক্রান্ত হয় তাহলে তার মাধ্যমে আরও দুজন মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে। এভাবে ৪, ৮, ১৬, ৩২ … চলতে থাকবে। কিন্তু যদি সেই জনপদের অর্ধেক লোকও সেটি প্রতিরোধী হয়ে যায়, তাহলে একজন মানুষ একজনেই ছড়াবে। অর্থাৎ ১, ১, ১ … এভাবে চলতে থাকবে, যা আগের ছড়ানোর হারের তুলনায় অর্ধেক। সুতরাং যত বেশি মানুষ প্রতিরোধী হবে সংক্রমণের হার তত কমে আসবে এবং একসময় শূন্যে নেমে আসবে।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় হার্ড ইমিউনিটির সীমাবদ্ধতা
আগেই বলা হয়েছে, যেহেতু করোনাভাইরাসের ভ্যাক্সিন এখনও আবিষ্কৃত হয়নি, তাই হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য ব্যাপকভাবে একে ছড়তে দিতে হবে। হিসেব করে দেখা গেছে, করোনার ক্ষেত্রে এটি অর্জনের জন্য মোট জনসংখ্যার ৬০% মানুষকে আক্রান্ত হতে হবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসকে যদি ব্যাপক এবং অপ্রতিরোধ্যভাবে ছড়াতে দেওয়া হয় তাহলে সেটা খুবই ভয়াবহ হবে। কেননা সেক্ষেত্রে বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ এতে আক্রান্ত হবে। অনেক মানুষ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হবে। ফলে তাদের জন্য হাসপাতাল এবং আইসিইউ সেবার প্রয়োজন হবে। এখন কথা হচ্ছে, এখন যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে তাদের চিকিৎসা করতেই রাষ্ট্র হিমশিম খাচ্ছে, যখন এর কয়েকগুণ লোকের জন্য হাসপাতাল সেবার প্রয়োজন হবে তখন কীভাবে সামাল দেবে সেটা বোধগম্য নয়। সেই সাথে কয়েক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুঝুকি তো রয়েছেই।
আবার, হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের অন্যতম শর্ত হলো, আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ হওয়ার মাধ্যমে সেই রোগ প্রতিরোধী হতে হবে। করোনাভাইাস নতুন একটি ভাইরাস হওয়ায় এর সম্পর্কে এখনও পর্যাপ্ত তথ্য বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। ফলে তারা এখনও জানেন না যে, যারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন তারা ঠিক কতটুকু প্রতিরোধী হচ্ছেন বা আদৌ প্রতিরোধী হচ্ছেন কি না! কেননা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদেরও পুনরায় করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখা গেছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ফ্লু জাতীয় ভাইরাসে মিউটেশন হয়ে নিয়মিত বিরতিতে নতুন নতুন প্রকরণের সৃষ্টি হয়। ফলে শরীর কোনো একটি প্রকরণ দ্বারা সংক্রমিত হয়ে অনাক্রম্য হলেও পরবর্তীতে যদি নতুন কোনো প্রকরণ দিয়ে সংক্রমিত হয়, তাহলে প্রথম ক্ষেত্রে যে ইমিউনিটি অর্জিত হয়েছিল সেটি দ্বিতীয়টির বেলায় নিরর্থক হয়ে পড়বে। অর্থাৎ ফ্লু জাতীয় ভাইরাসের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
সুতরাং হার্ড ইমিউনিটিকে করোনাভাইরাস সমস্যার সমাধানের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা নিঃসন্দেহে বিপর্যয়মূলক হবে। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলে এমন কৌশল কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। তাই এর বিকল্প সমাধানের দিকেই বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মনোনিবেশ করা উচিত।