শিশু নির্যাতনের ধরন ও লক্ষণ সম্পর্কে এর আগের লেখায় আলোচনা করা হয়েছে। এই লেখায় থাকছে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে আপনার ভূমিকা বা করণীয় কী, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।
শিশু নির্যাতন রোধে আপনার প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে নিজে আগে জানা যে, কী উপায়ে আপনার শিশুকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারবেন। একইসাথে আপনার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও বিস্তারিতভাবে জানাতে হবে শিশু নির্যাতন সম্পর্কে এবং সাথে সাথে তাদেরকেও বোঝাতে হবে প্রতিরোধের উপায়গুলো। আর যদি শিশুর মধ্যে নির্যাতিত হবার কোনো লক্ষণ পেয়ে থাকেন, তবে দেরি না করে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। যত দ্রুত আপনি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন, আপনার সন্তানের জন্য ততই তা মঙ্গলজনক হবে।
শারীরিক নির্যাতন প্রতিরোধ
শিশুরা ভুল করবে এবং ভুল থেকেই শিখবে। একজন সচেতন বাবা-মা বা অভিভাবক হিসেবে আপনাকেই শিশুর এই ভুল আচরণ বা কাজকে সঠিক আচরণে রূপান্তর করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কী করে শিশুকে ভুল আর সঠিকের পার্থক্য বোঝাবেন? গায়ে হাত তুলবেন, নাকি ধমকে ভয় দেখিয়ে সন্তানকে ভালো-খারাপ শেখাবেন? মনে রাখবেন, এই মেরে অথবা ভয় দেখিয়ে ভালো মন্দ শেখানোর প্রক্রিয়াতে হয়তো আপনার সন্তান আপনার কাছেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আসুন শিশুর উপর শারীরিক নির্যাতন রোধে কী হওয়া উচিত আপনার ভূমিকা, সে সম্পর্কে জেনে নেই।
আপনার হুট করে রেগে যাওয়ার অভ্যাস কমান
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় বাবা-মা বা অভিভাবকের বদরাগী স্বভাবের জন্য। শিশুর লালন পালন সুস্থ ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে হলে আপনাকে এই বদরাগী স্বভাব বদলাতে হবে।
আপনার পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো শিশুর থেকে দূরে রাখুন
নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যাগুলো আপনার শিশুর প্রাত্যহিক আর দশটা সমস্যার সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না। পারিবারিক যেকোনো সমস্যা, যেটা আপনার ছোট্ট সোনামণির পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, এমন সব বিষয় থেকে শিশুকে দূরে রাখুন।
শিশুর কাছে ভালো শ্রোতা হয়ে উঠুন
শিশুরা এটা-ওটার বায়না করবেই, এক্ষেত্রে আপনি যদি শিশুর এসব চাহিদা পূরণ করতে অপারগ হন বা আপনার সন্তান যদি অনেক বেশি বায়না করা স্বভাবের হয়, সেক্ষেত্রে আপনি রাগারাগি করে বা মেরে বোঝানোর চেষ্টা না করে, তাকে আদর করে বুঝিয়ে বলুন। যেকোনো সময়েই আপনার শিশুর কথা গুরুত্ব সহকারে শুনুন।
নেশাগ্রস্থ অবস্থায় শিশুর থেকে দূরে থাকুন
যদি বাবা-মা অথবা অভিভাবক অ্যালকোহলিক হয়, সেক্ষেত্রে শিশুর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার মাত্রা সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আপনি আপনার এই বদভ্যাস ত্যাগ করুন; আর যত দিন তা ছাড়তে পারছেন না, তত দিন মদ্যপ অবস্থায় শিশুর থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করুন।
শিশুকে ঘরের বাইরে যাওয়ার সুযোগ দিন
প্রতিটি শিশুর সঠিক শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো বাইরের জগতের সাথে সংস্পর্শ থাকা। বাচ্চাকে ঘরে আটকে না রেখে তাকে বাইরে যাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ দিন, অন্য বাচ্চাদের সাথে মেলামেশার সুযোগ করে দিন। এ উপায়ে শিশুর শারীরিক নির্যাতন অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ
শিশুর উপর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে বাবা-মা বা অভিভাবকের সচেতনতার চেয়ে বড় প্রতিরোধক আর কিছু নেই। দেখে নিন শিশু যৌন নির্যাতন প্রতিরোধের কিছু উপায়।
শিশুদের বুঝিয়ে বলুন শরীরে কিছু অঙ্গ নিতান্তই ব্যক্তিগত
আপনার শিশুকে বুঝিয়ে বলুন, শরীরের কিছু অঙ্গ একান্তই ব্যক্তিগত, সবাই সেগুলো দেখতে বা ছুঁতে পারে না। বাচ্চাকে ছোট থেকেই তাদের শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে জানতে শেখান। যেমন- বাবা-মায়ের সামনে বাচ্চা পোশাক ছাড়া অবস্থায় থাকতে পারে, কিন্তু বাইরের কারো সামনে অবশ্যই পোশাক পরা অবস্থায় থাকতে হয়। শুধুমাত্র বাবা-মা কাপড় বদলে দেওয়া বা গোসল করিয়ে দেওয়া ও বাথরুম ব্যবহারের সময় পোশাক খুলে দিতে পারেন, এটি স্বাভাবিক।
আপনার শিশুকে শরীরের সীমানা সম্পর্কে বলুন
বাচ্চাকে শেখান, তার শরীরের কোন কোন অংশে অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারে না এবং অন্য কেউ আপনার সন্তানকে তাদের শরীরের কোন অংশগুলোতে স্পর্শ করতে বলতে পারেন না। অনেকেই প্রথমটি সন্তানকে শিখিয়ে দিলেও, দ্বিতীয়টি সম্পর্কে বলার প্রয়োজন মনে করেন না। ফলে শিশুর উপর যৌন নির্যাতন অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। কারণ শিশুকে যৌন নির্যাতনের অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে অপরাধী বাচ্চাদের দিয়ে নিজের শরীরের ব্যক্তিগত অংশে স্পর্শ করার পন্থা অবলম্বন করে।
শিশুকে বলুন শরীর সম্পর্কীয় গোপনীয়তা ঠিক নয়
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীরা শিশুদের বোঝায় যে, সে বাচ্চার সাথে যা করছে সেটি আসলে একধরনের গোপন খেলা, আর কাউকে এই গোপন খেলার কথা বলা যাবে না। এর ফলে হয়তো আপনার অজান্তেই দীর্ঘদিন আপনার সন্তান যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে চলে। বাচ্চাকে বুঝিয়ে বলুন, এগুলো মোটেই খেলা নয়, আর যারা এই ধরনের খেলার কথা গোপন রাখতে বলে, তারা খারাপ মানুষ। তাই যা-ই ঘটুক বা যে-ই বলুক না কেন, এই ধরনের কিছু ঘটলে আপনার সন্তান যেন সেটা কখনো গোপন না রাখে, সে ব্যাপারে তাকে বুঝিয়ে বলুন।
শিশুকে বলুন কেউ তার ব্যক্তিগত অঙ্গের ছবি তুলতে পারবে না
আরেকটি ভুল যেটি বাবা-মায়েরা অনেক বেশি করে থাকেন সেটি হলো, বাচ্চাকে বোঝাতে ভুলে যাওয়া বা বোঝানোর প্রয়োজন মনে না করা যে, স্বাভাবিক ছবি তোলা আর অস্বাভাবিক ছবি তোলার মধ্যে পার্থক্য কী। ছবি তুলতে অধিকাংশ বাচ্চাই পছন্দ করে। কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে, আমাদের চারপাশে অনেক অসুস্থ মানসিকতার মানুষ রয়েছে, যারা বাচ্চাদের নগ্ন ছবি তোলে এবং সেই ছবি দিয়ে ব্যক্তিগত কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করে। তাই আপনার ছোট্ট সোনামণিকে বুঝিয়ে বলুন, কেউ তার ব্যক্তিগত অঙ্গের বা নগ্ন ছবি তোলার অধিকার রাখে না।
শিশুকে শেখান কীভাবে অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে বের হয়ে আসতে হয়
আপনার সন্তানকে অবশ্যই শেখান, কোনটি অস্বস্তিকর অবস্থা আর কোনটি স্বাভাবিক অবস্থা। যখন আপনি আপনার সন্তানকে আদর করেন, তখন তাকে বুঝিয়ে বলুন এটি স্বাভাবিক। কিন্তু অচেনা কেউ বা অন্য কেউ যদি এভাবে আদর করে বা শরীরে স্পর্শ করে, তবে সেটা স্বাভাবিক পরিবেশ বা অবস্থা নয়। আর এ ধরনের পরিবেশ থেকে বাচ্চাকে বের হওয়ার কৌশল সম্পর্কে বুঝিয়ে বলুন।
শিশুর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন
শিশুর উপর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধের অন্যতম একটি উপায় হলো, শিশুর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে করে যেকোনো কিছু আপনার সন্তান আপনাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারে। আপনার সন্তান যদি যৌন নির্যাতনের শিকার হয় এবং আপনাকে সেই ব্যাপারে বলে, তবে তাকে বকাঝকা বা ভয় না দেখিয়ে তার পাশে দাঁড়ান, প্রতিবাদ করুন। তা না হলে দেখা যাবে, আপনার সন্তান নিয়মিত এসবের ভেতর দিয়ে গেলেও, আপনাকে কখনো বলার সাহস দেখাবে না।
মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধ
মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুদের জন্য ভীষণ বিধ্বংসী একটি ব্যাপার। মানসিক নির্যাতনের শিকার হলে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ যত সহজে নিজেকে বুঝিয়ে বা গুছিয়ে নিতে পারে, একজন শিশুর পক্ষে সেটি অসম্ভব। এর ফলে পূর্ণ বিকশিত হওয়ার আগেই অনেক বাচ্চা তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের সবরকম শক্তি হারিয়ে ফেলে। আসুন শিশুর উপর মানসিক নির্যাতনের প্রতিরোধক হিসেবে কী হওয়া উচিত আপনার আচরণ, সে সম্পর্কে জানা যাক।
শিশুকে তার প্রাপ্য মনোযোগ এবং ভালোবাসা দিন
যখন আপনার সন্তান তার কোনো খেলনা, তার নিজের আঁকা কোনো ছবি কিংবা অন্য যেকোনো কিছু আপনাকে দেখাতে বা তার কোনো ভালো লাগার অভিজ্ঞতা আপনাকে জানাতে ছুটে আসবে, তখন তাকে ব্যস্ততা বা অন্য কোনো কিছুর অজুহাত দিয়ে চলে যেতে না বলে বরং তাকে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে কাছে ডাকুন। তার কাজের প্রশংসা করুন, পারলে তাকে কিঞ্চিৎ পুরস্কার দিন।
শিশুকে ছোট করা/কটু কথা বলা থেকে বিরত থাকুন
বাবা-মা বেশিরভাগ সময়ই সন্তানদের এমন অনেক কথা বলে থাকেন, যা হয়তো তারা মন থেকে বলেন না, যেমন “তুমি কেন তোমার অন্য ভাই-বোনের মতো নও” কিংবা “তোমার জন্ম না হলেই ভালো হতো”। এ ধরনের কথাগুলো হয়তো বাবা-মা বা পরিবারের অন্য কেউ রাগে অথবা কোনো কিছুতে বিরক্ত হয়ে তেমন কিছু না ভেবেই বলে ফেলেন, কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব পড়ে আপনার শিশুর সমগ্র অস্তিত্বের উপর। এমন ধরনের কোনো কটু কথা কখনোই বলবেন না, যাতে আপনার সন্তান নিজেকে ছোট ভাবে।
শিশুকে বন্ধুত্ব করতে সুযোগ দিন
এমন অনেক বাবা-মা বা অভিভাবক আছেন, যারা বাচ্চাদের বাইরের কারো সাথে মিশতে ও খেলতে দেন না। একটি কথা মাথায় রাখুন, বাচ্চাদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তাদের সমবয়সী অন্য বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্বের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। তাই বাচ্চাদের সুযোগ দিন সমবয়সী অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলার এবং বন্ধুত্ব করার।
স্যরি বলতে শিখুন
আপনার ছোট্ট সোনামণিতো আপনারই একটি অংশ, তাকে সঠিক উপায়ে মানুষ করে তোলা আপনার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি কখনো বাচ্চার কচি মনে কষ্ট দিয়ে ফেলেন, তাহলে ছোট্ট করে ‘স্যরি’ বলুন। স্যরি বলার মানে এই না যে, আপনি বাচ্চার কাছে নিজেকে ছোট করে ফেললেন বা বাচ্চাকে বেশি ‘লাই’ দিয়ে ফেললেন, বরং স্যরি বলা মানে ভুল করলে আপনার বাচ্চাকেও স্যরি বলার মানসিকতা তৈরি করে দেওয়া।
শিশুর নিজেকে উপেক্ষিত ভাবা প্রতিরোধ
সন্তানকে ভালোবাসেন না এমন একটি বাবা-মা পাওয়াও প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সন্তানের প্রতি আপনার অপার ভালোবাসা থাকার পরেও কেন আপনার সন্তান নিজেকে উপেক্ষিত ভাববে? শিশুর নিজেকে উপেক্ষিত ভাবা বন্ধ করতে বা আপনি কীভাবে আপনার সন্তানের আরও কাছাকাছি যাবেন, আসুন সে ব্যাপারে জানা যাক।
আপনার শিশুকে সময় দিন
প্রিয়জনকে দেওয়া সবচেয়ে বড় উপহার হল সময়। আপনার বাচ্চার সাথে যতটুকু পারেন সময় কাটান। দেখবেন সন্তানের সাথে আপনার সম্পর্ক তো মধুর হবেই, সাথে আপনার বাচ্চা নিজেকে উপেক্ষিত নয়, উল্টো নিজেকে আপনার অতি প্রিয় মানুষ ভাবতে শুরু করবে।
শিশুর স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সব কিছুর খোঁজ রাখুন
আপনার শিশুর সুস্বাস্থ্য, লেখাপড়া এবং অন্যান্য সবরকম সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আপনার। অসুস্থ হলে শিশুকে সুচিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি তার সেবা-যত্ন করার দায়ও আপনার। শিশুর সুশিক্ষার দিকেও নজর আপনাকেই রাখতে হবে, সে স্কুলে যাচ্ছে কিনা বা ঠিক মতো লিখাপড়া করছে কিনা, সেদিকে নজর রাখা আপনার কর্তব্য। স্কুলে ভর্তি করে দিলেই আপনার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
শিশুর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন
আপনি যদি আপনার সন্তানের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে আর সব সমস্যা নিজে থেকেই কমে যাবে। বাচ্চার সাথে সব সময় গুরুগম্ভীর না থেকে মাঝেমধ্যে তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে দেখুন, দেখবেন বাচ্চা আর নিজেকে আপনার থেকে আলাদা কেউ ভাববে না।