২০১১ সালের ২রা মে। বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলো তখনও লিবিয়ার যুদ্ধ নিয়েই ব্যস্ত। মাত্র দুইদিন আগেই ন্যাটোর বিমান হামলায় নিহত হয়েছিল মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফীর তিন দৌহিত্র এবং কনিষ্ঠ পুত্র সাইফ আল-আরব। লিবিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল গাদ্দাফী অক্ষত আছেন, কিন্তু তার নতুন কোনো ছবি বা অডিও বার্তা প্রকাশিত না হওয়ায় সন্দেহে ছিল অনেকেই। তাই সেদিন টিভি চ্যানেলগুলো যখন পূর্ব ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ করেই নিয়মিত অনুষ্ঠান বন্ধ করে হোয়াইট হাউজ থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বক্তব্য প্রচার করতে শুরু করেছিল, তখন প্রথমে অনেকেই ভেবেছিল ওবামা হয়তো লিবিয়া বিষয়ক কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দিবেন।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে ওবামা এমন একটি সংবাদ দেন, যার জন্য বিশ্ববাসী প্রস্তুত ছিল না। তিনি জানান, দীর্ঘ এক দশকের অভিযান শেষে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন-লাদেনকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার বক্তব্য থেকে এবং পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি থেকে জানা যায়, ওসামা বিন লাদেনের এক বার্তা বাহকের উপর নজরদারি করার মাধ্যমে সিআইএর গোয়েন্দারা পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের একটি বাড়িতে ওসামা বিন লাদেনের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে। পরবর্তীতে পাকিস্তানের অনুমতি ছাড়াই রাতের অন্ধকারে মার্কিন নেভি সীলের একটি বিশেষ টিমের সদস্যরা বাড়িটিতে অভিযান চালায় এবং বিন লাদেনসহ পাঁচজনকে হত্যা করে।
বিন লাদেনের মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে সাতটি বছর। কিন্তু তার মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক আজও শেষ হয়নি। অনেক অনুসন্ধানী সাংবাদিকই বিন লাদেনকে খুঁজে বের করা এবং হত্যা করার ঘটনাপ্রবাহের সরকারী ভাষ্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন পাকিস্তান সরকারের ভূমিকা নিয়েও। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা, বিন লাদেনকে যে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়টি নিয়েই বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করে। কারো দাবি বিন লাদেন আসলে আগেই মারা গিয়েছিলেন, আবার কারো দাবি বিন লাদেন এখনও বেঁচে আছেন। কিন্তু কতটুকু সত্যতা আছে এই দাবিগুলোর? সেটি নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
কেন মৃতদেহের ছবি প্রকাশ করা হয়নি?
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু সম্পর্কে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, ঘটনার পর এত বছর পেরিয়ে গেলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মৃতদেহের কোনো ছবি প্রকাশ করেনি। এমনকি, ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে তার মৃতদেহ শনাক্ত করা হয়েছিল বলে দাবি করা হলেও এখনও পর্যন্ত সেই ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলও প্রকাশ করা হয়নি। এসব লুকোচুরির কারণেই অনেকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। যেখানে আইন ভঙ্গ করে সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুদন্ডের ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে ওসামা বিন লাদেনের মৃতদেহের ছবি প্রকাশে আইনগত কোনো বাধা না থাকলেও তা প্রকাশ না করায় অনেকেই সন্দেহ করেন, তাকে হত্যা করার দাবিটি আসলে মিথ্যা।
মৃতদেহের ছবি কেন প্রকাশ করা হয়নি, তা নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। রিপাবলিকান দলের সিনেটর এবং সিনেট আর্মড সার্ভিস কমিটির সদস্য জিম আইনহোফ জানান, তিনি বিন লাদেনের মৃতদেহের ১৫টি ছবি দেখেছেন, কিন্তু সেগুলো এতই বীভৎস যে, প্রকাশ করার যোগ্য না। তার বর্ণনা অনুযায়ী, একটি বুলেট বিন লাদেনের চোখ ভেদ করে মাথার ভেতরে প্রবেশ করে এরপর বিস্ফোরিত হয়ে মাথার অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। ফলে তার চোখ এবং মাথার মগজ বেরিয়ে পড়েছিল। এরকম বীভৎস ছবি প্রকাশ করা হলে আল-কায়েদা সেগুলোকে নতুন সদস্য নিয়োগ এবং তাদেরকে প্রতিশোধ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার কাজে ব্যবহার করতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই মৃতদেহের কোনো ছবি প্রকাশ করা হয়নি।
ছবি প্রকাশ না করার আরেকটি কারণও থাকতে পারে। অভিযানে অংশ নেওয়া নেভি সীল সদস্য ম্যাট বিসোনেট তার ‘নো ইজি ডে‘ বইয়ে বর্ণনা দেন, তিনি এবং আরেকজন সৈন্য বিন লাদেনের বুক লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করেছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার শরীর সম্পূর্ণ নিথর হয়ে যায়। তবে বিজনেস ইনসাইডারের সামরিক বিষয়ক প্রতিবেদক জ্যাক মার্ফি অভিযানে জড়িত থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই জন সদস্যের বরাত দিয়ে জানান, বাস্তবে শুধু ম্যাট বিসোনেট না, বিন লাদেনের মৃত্যুর পরেও নেভি সীল টিমের একাধিক সদস্য তার মৃতদেহের উপর কয়েক রাউন্ড করে গুলি চালায়। তার বর্ণনা অনুযায়ী, শেষপর্যন্ত বিন লাদেনের শরীরে শতাধিক বুলেটের ছিদ্র ছিল।
মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর আইন অনুযায়ী অপারশেন পরিচালনার সময় কারো উপর কত রাউন্ড গুলি চালানো যাবে, সে ব্যাপারে কোনো বিধি নিষেধ নেই। কিন্তু তারপরেও অভিযানে অংশ নেওয়া সৈন্যদের ক্ষোভ এবং প্রতিশোধ থেকে চালানো এতগুলো গুলি কোনো আদর্শ অনুযায়ীই স্বাভাবিক না। এরকম একটি ছবি প্রকাশ করা হলে আল-কায়েদা সদস্যদের ক্ষোভের সম্ভাবনা ছাড়াও বিশ্বব্যাপী অভিযানটি প্রচন্ড নিন্দা এবং সমালোচনার শিকার হতে পারত। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও হয়তো বিভিন্ন আইনী জটিলতা সৃষ্টি এবং তদন্ত শুরু হতে পারত। এসব কারণেই ছবি প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
ছবি প্রকাশ না করা থেকে কী প্রমাণিত হয়?
মৃতদেহের ছবি প্রকাশ করা হয়নি বলেই অধিকাংশ মানুষ বিন লাদেনের মৃত্যু সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কিন্তু বাস্তবে ছবি প্রকাশ না করার কারণে বিন লাদেনের মৃত্যু নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত না হলেও, এ থেকে তিনি যে আগেই মারা গিয়েছিলেন, সেটাও প্রমাণিত হয় না। বিন লাদেন কেন বর্তমানে বেঁচে নেই, তার পক্ষে নিচে অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু শুধুমাত্র ছবি না থাকার কারণেই যে দাবি করা হয় বিন লাদেন আগেই (২০০২ সালে) মারা গিয়েছিলেন, সেই যুক্তিটি খুবই দুর্বল।
বিন লাদেন আগেই (২০০২ সালে) মারা গিয়ে থাকলে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তার যতগুলো ভিডিও এবং ২০১১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যতগুলো অডিও প্রকাশিত হয়েছে, সবগুলোই নকল, কৃত্রিমভাবে তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু যে গোয়েন্দাসংস্থা নিখুঁতভাবে কয়েকশো ঘন্টার অডিও-ভিডিও তৈরি করে বছরের পর বছর ধরে বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিতে পারে, তারা তো খুব সহজেই বিন লাদেনের মৃতদেহের ফটোশপ করা ছবি প্রকাশ করে এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারত! কিন্তু এক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি।
স্নোডেন কি বিন লাদেনের বেঁচে থাকার দাবি করেছেন?
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু সম্পর্কে আরেকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হচ্ছে, তিনি যে এখনও জীবিত আছেন, শুধু তা-ই না, তিনি সিআইএর তত্ত্বাবধানে বাহামা দ্বীপপুঞ্জে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছেন এবং মার্কিন সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত মাসে ১ লাখ ডলার বেতনও নিচ্ছেন। বলা হয়ে থাকে, বিন লাদেন সম্পর্কে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ তথ্যটি জানিয়েছেন সাবেক মার্কিন এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি) কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেন, যিনি এনএসএ’র বিভিন্ন গোপন তথ্য ফাঁস করে আলোচিত হয়েছেন। এই সংবাদটিতে দাবি করা হয়, স্নোডেন নাকি বলেছেন, বিন লাদেন আসলে সিআইএর একজন গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট। তাই তাকে হত্যা করার মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে বাস্তবে তাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তত্ত্বটি বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নয়াদিগন্ত, কালের কণ্ঠ, যুগান্তর সহ বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকার অনলাইন সংস্করণেও। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এটি সম্পূর্ণ ভুয়া একটি সংবাদ। সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় ওয়ার্ল্ড নিউজ ডেইলি রিপোর্ট নামের একটি স্যাটায়ারমূলক ওয়েবসাইটে, যাদের কাজই হচ্ছে মজা করার উদ্দেশ্যে সত্যিকার চরিত্রদেরকে নিয়ে বিভিন্ন বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করা। ওয়েবসাইটটির Disclaimer পেজেই পরিষ্কারভাবে তাদের এ ভূমিকার বর্ণনা দেওয়া আছে এবং বলা আছে, বাস্তবের কোনো ব্যক্তির সাথে মিলে গেলেও এই সাইটে প্রকাশিত সবগুলো চরিত্র আসলে কাল্পনিক।
আসলে কী আছে স্নোডেনের ফাঁস করা ডকুমেন্টে?
ওয়ার্ল্ড ডেইলি নিউজ রিপোর্টের সংবাদটি এডওয়ার্ড স্নোডেনের বরাত দিয়ে প্রকাশ করা হলেও বাস্তবে এরকম কোনো দাবি স্নোডেন কখনোই করেননি। স্নোডেনের কোনো সাক্ষাৎকার, কোনো টুইট, বা স্নোডেনের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয় যে পত্রিকাগুলোতে, তার কোথাও এ জাতীয় কোনো দাবি নেই। বরং যা আছে, তা সম্পূর্ণ বিপরীত। অন্যান্য কিছু অনুসন্ধানী সাংবাদিক যেখানে সরকারী ভাষ্যের বিবরণ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন, সেখানে স্নোডেনের প্রকাশিত নথিপত্রের মধ্যে সরকারী ভাষ্যের কিছু কিছু উপাদানের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়।
উদাহরণস্বরূপ, পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক সাইমুর হের্শ দাবি করেন, বিন লাদেনের বার্তাবাহক আবু আহমেদ আল-কুয়েতির উপর নজরদারি করে বিন লাদেনের সন্ধান পাওয়ার বিবরণটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বরং এক পাকিস্তানী গোয়েন্দা কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় পুরস্কারের লোভে সিআইএর কাছে এসে বিন লাদেনের বাসস্থানের কথা জানিয়ে দিয়ে যায়। স্নোডেনের ফাঁস করা ডকুমেন্ট থেকে যদিও আল-কুয়েতির মাধ্যমেই বিন লাদেনের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল কিনা, তা জানা যায় না, কিন্তু এরকম একজন বার্তাবাহকের উপর যে সিআইএ দীর্ঘদিন যাবৎ নজরদারি করছিল এবং তার গন্তব্যস্থানগুলোতে বিন লাদেনের অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করেছিল, তার প্রমাণ ঠিকই পাওয়া যায়।
স্নোডেনের ফাইলগুলো থেকে আরো জানা যায়, সিআইএ ২০০৭ সালে ইরাকে আল-কায়েদার প্রধান আবু আইয়ুব আল-মাসরির কাছে বিন লাদেনের লেখা একটি চিঠি উদ্ধার করতে পেরেছিল। এছাড়াও বিন লাদেনকে হত্যার পর তার বাসভবন থেকে উদ্ধার করা ফাইলগুলো নিয়ে ব্যাপক গবেষণার সংবাদও উঠে আসে স্নোডেনের ফাঁস করা নথিপত্রগুলোতে। কিন্তু ঐসব ফাইলে ঠিক কী ছিল, কিংবা সেগুলো বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ কোনো গোয়েন্দা তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল কিনা, তা জানা যায় না। তবে স্নোডেনের ফাইল থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্যটি উঠে আসে, তা হলো মার্কিন সরকার আসলেই বিন লাদেনের ডিএনএ পরীক্ষা করেছিল এবং তার ফলাফলও মিলে গিয়েছিল।
কেউ কি বিন লাদেনের বেঁচে থাকার দাবি করছে?
অ্যাবোটাবাদের অভিযানে (অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার) বিন লাদেন নিহত হয়েছিলেন কিনা, সে বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়, যখন ঘটনার কয়েকদিন পরেই এক বিবৃতির মাধ্যমে আল-কায়েদা নেতৃত্ব ব্যাপারটি স্বীকার করে নেয়। প্রধান নেতার মৃত্যু কোনো সংগঠনের জন্যই সুসংবাদ না, তা প্রচারিত হলে সংগঠনের সদস্যদের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে পারে। কিন্তু তারপরেও তারা সেটি স্বীকার করে নিয়েছিল। বিন লাদেনের মৃত্যুর পর তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী আইমান আল-জাওয়াহিরি আল-কায়েদার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। গত সাত বছর ধরে জাওয়াহিরি অনেকগুলো অডিও এবং ভিডিও প্রকাশ করেছেন, যার কোনোটিতেই বিন লাদেন বেঁচে আছেন, এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
জাওয়াহিরি একা না, মৃত্যুর কয়েকমাস আগেও বিন লাদেনের সাথে পত্র মারফত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগাযোগ ছিল, এরকম অনেক আল-কায়েদা নেতাই এখনও বেঁচে আছেন, সিরিয়াতে বিভিন্ন বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করছেন এবং নিয়মিত বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, আবু মুহাম্মদ আল-জুলানী, যিনি সে সময় আল-কায়েদার ইরাক শাখার গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন এবং পরবর্তীতে আল-নুসরা ফ্রন্টের প্রধান হয়েছিলেন, তিনি ২০১৫ সালেও আল-জাজিরার সাথে টিভি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। কিন্তু এই নেতাদের কেউই কখনো মার্কিন অভিযানে বিন লাদেনের মৃত্যুর বিষয়টি নাকচ করেননি।
অ্যাবোটাবাদ কমিশনের রিপোর্টে কী বলা হয়েছে?
ওসামা বিন লাদেন যে আগে বা পরে মারা যাননি, বরং অ্যাবোটাবাদ অভিযানের সময়ই মারা গিয়েছিলেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া যায় তার স্ত্রী এবং সন্তানদের স্বীকারোক্তিতে। অ্যাবোটাবাদের ঐ বাড়িতে বিন লাদেন একা ছিলেন না। সেখানে তার তিন স্ত্রী, আট সন্তান এবং পাঁচ নাতি-নাতনিসহ মোট ২৮ জনের বসবাস ছিল। মার্কিন অভিযানে নিহত হয় পাঁচজন, এর মধ্যে তারা শুধু বিন লাদেনের মৃতদেহ এবং তার কম্পিউটারগুলো নিয়ে চলে যায়, কিন্তু পেছনে রয়ে যায় বিন লাদেনের পরিবারের সদস্যরা, যাদেরকে আটক করে পাকিস্তানি গোয়েন্দাবাহিনী।
অভিযানের পরপরই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তারা হয়ত ইচ্ছাকৃতভাবে বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়ে আসছিল। তাছাড়া অনুমতি ছাড়াই কীভাবে ভিন্ন একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের ভেতরে প্রবেশ করে এত বড় অভিযান পরিচালনা করে নিরাপদে ফিরে যেতে পারে, এ নিয়েও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রচন্ড সমালোচনার ঝড় উঠে। ফলে বিষয়গুলোর তদন্ত করার জন্য পাকিস্তান একটি শক্তিশালী বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে, যা অ্যাবোটাবাদ কমিশন নামে পরিচিতি পায়।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। ৩০০ জন সাক্ষীর জবানবন্দী এবং প্রায় ৩,০০০ নথিপত্র পর্যালোচনা করার পর তৈরি করা হয় ৭০০ পৃষ্ঠার এ বিশাল রিপোর্ট। পাকিস্তান সরকার রিপোর্টটি প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও আল-জাজিরার অনুসন্ধানী টিম এর একটি কপি পেয়ে যায় এবং তা ফাঁস করে দেয়। ঐ রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, কমিশন বিন লাদেনের স্ত্রীদেরকে এবং পরিবারের সদস্যদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। বিশেষ করে বিন লাদেনের সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী অ্যামালের দেওয়া স্বীকারোক্তি থেকে নিশ্চিতভাবেই জানা যায়, সে রাতে মার্কিন অভিযানেই বিন লাদেন নিহত হয়েছিলেন। এমনকি তাকে বাঁচাতে গিয়ে অ্যামাল নিজেও গুলি খেয়েছিলেন।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তান সরকার বিন লাদেনের স্ত্রী ও পরিবারদেরকে সৌদি আরবের হাতে হস্তান্তর করে। অ্যামাল, যিনি ইয়েমেনের নাগরিক, তিনি সৌদি আরব থেকে পরবর্তীতে ইয়েমেনে চলে যান। তাদের কেউ এখন পর্যন্ত কোথাও বিন লাদেনের পরিণতি সম্পর্কে ভিন্ন কিছু দাবি করেনি। সুতরাং মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ছবি অথবা অন্য কোনো শক্ত প্রমাণ হাজির করেনি, কিন্তু বিভিন্ন সাক্ষ্য এবং অন্যান্য পারিপর্শ্বিক প্রমাণ এটাই নির্দেশ করে যে, বিন লাদেন ২০১১ সালের ২রা মে, মার্কিন অভিযানেই নিহত হয়েছিলেন।
কিন্তু ঠিক কীভাবে নিহত হয়েছিলেন ওসামা বিন লাদেন? কীভাবে খুঁজে বের করা হয়েছিল তাকে? এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে যা দাবি করেছে, অথবা জিরো ডার্ক থার্ডি চলচ্চিত্রে যা দেখানো হয়েছে, সেটাই কি সঠিক, নাকি পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক সাইমুর হের্শ তার সুদীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে যেরকম দাবি করেছেন যে, মার্কিন বিবরণের সবটাই একটা কাল্পনিক কাহিনী, সেটা সঠিক? তারচেয়েও বড় কথা, পাকিস্তানের ভূমিকাই বা কি ছিল এতে? তারা কি জ্ঞাতসারেই বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েছিল? এসব বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করব পরবর্তী পর্বে।