সাম্প্রতিককালের নোভেল করোনাভাইরাস বা COVID-19 (2019-nCoV)-কে বলা যায় নতুন মোড়কে পুরাতনের আবির্ভাব। হ্যাঁ, Nidovirale বর্গের সবচেয়ে বড় ভাইরাস-গ্রুপ Coronaviridae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করোনাভাইরাসগুলো মানুষের কাছে ধরা দিতে থাকে ১৯৬০ সালের দিক থেকে।
তবে এদের ভয়ংকর রূপের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে ২০০২-০৩ সালের SARS (Severe Acute Respiratory Syndrome) মহামারির মধ্য দিয়ে। মোটামুটি ২০০৩ সালের জুন মাসের মধ্যে SARS-CoV ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও ২০১২ সালে সৌদি-আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে নতুন করে আগমন ঘটে করোনা গোত্রের MERS-CoV (Middle East Respiratory Syndrome-CoronaVirus) ভাইরাসটির।
এছাড়াও আরো বেশ কিছু করোনাভাইরাস বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রোগের কারণ হিসেবে নজরে এলেও আজকের কোভিড-১৯-ই প্রথম করোনাভাইরাস, যা সমগ্র পৃথিবীব্যাপী কোনো মহামারি সৃষ্টির জন্য দায়ী।
বলা বাহুল্য, সর্বপ্রথম চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের ৬১ বছর বয়স্ক একজন বৃদ্ধের প্রাণনাশের মাধম্যে নিজের অস্তিত্বের প্রগাঢ়তা জানান দেয় এই কোভিড-১৯ বা SARS-CoV-2, যার ভয়াবহতা আজ আর কারো অজানা নয়। নতুন এই করোনাভাইরাসকে SARS-CoV-2 বলার কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে Nature জার্নালের একটি গবেষণাপত্রে। সেখানে বলা হয়েছে, এর প্রাকৃতিক মূল হোস্ট এবং প্রায় ৭৯.৬% জেনেটিক কোড পুরাতন SARS-CoV এর সাথে মিলে যায়।
এবার একটু ফিরে দেখা যাক। SARS-এর উৎপত্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় চীনের গুয়াংডং প্রদেশের একটি ওয়েট মার্কেটকে। সেই মার্কেটের একটি সিভেট ক্যাট বা খাটাশ জাতীয় প্রাণী থেকে মানুষের দেহে প্রথম সংক্রমিত হয় SARS-CoV।
তবে সিভেট ক্যাটই এর মূল ‘হোস্ট’ নয়। ২০১৩ সালে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত একটি দল SARS-CoV এর মূল বাহক হিসেবে Horseshoe নামক বাদুড়ের একটি প্রজাতিকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করে।
এখানে বলে রাখা ভালো, ভাইরাস মূলত জীব ও জড়ের মাঝামাঝি একপ্রকার অণুজীব, যাদের বংশবৃদ্ধির জন্য অন্য কোনো জীবের দেহে আশ্রয় নিতে হয়, যেখানে এরা অনুকূল পরিবেশে এদের DNA বা RNA-এর প্রয়োজনীয় রেপ্লিকেশন ঘটায়, আর সেই অনুকূল জীবকেই বলা হয় তাদের ‘হোস্ট’।
যা-ই হোক, এখন প্রশ্ন হলো সেই চীনা-বাদুড় থেকে আফ্রিকান সিভেট ক্যাটে ভাইরাসের সংক্রমণ হলো কীভাবে এবং সেখানে ওয়েট মার্কেটের ভূমিকাই বা কতটুকু?
সে প্রশ্নের উত্তরে যাবার আগে, একটু ঘুরে আসি উহানে প্রথম মৃত্যুবরণকারী সেই বৃদ্ধের কাছে। ব্লুমবার্গের তথ্যানুযায়ী তিনি ছিলেন উহানের হুয়ানান সি-ফুড মার্কেটের একজন নিয়মিত ক্রেতা, যেখানে সিএনএন–এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হচ্ছে, “সেই মার্কেট ছিল সি-ফুড মার্কেটের চেয়েও বেশি কিছু!”
এখন আসা যাক, এই ‘ওয়েট মার্কেট’ কী- সেই প্রসঙ্গে। সহজভাবে বলতে গেলে, ওয়েট মার্কেট হলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্র। শুধুমাত্র চীন নয়, বরং থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ এশিয়ার অনেক দেশেই দেখা মেলে এসব বৈধ-অবৈধ ওয়েট মার্কেটের। যদিও লস এঞ্জেলস টাইমস এর মতে, ওয়েট মার্কেট নয়, বলা উচিত ‘ওয়াইল্ড লাইফ মার্কেট’।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভিডিও প্রতিবেদন এবং আর্টিকেলে উঠে এসেছে এসব ওয়েট মার্কেটের ভয়ংকর সব চিত্র, যেখানে দেখা যায় প্রচণ্ড অস্বাস্থ্যকর এবং নাজুক অবস্থায় এক প্রজাতির প্রাণীকে রাখা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো প্রজাতির প্রাণীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে।
সরু-ঘিঞ্জি, স্যাঁতস্যাঁতে, দম আটকানো বদ্ধ জায়গায় একটি খাঁচার ওপর রাখা হচ্ছে আরেকটি খাঁচা; ক্রেতার সামনেই উন্মুক্ত পরিবেশে হত্যা করা হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত প্রাণীটিকে; হয়তো বধ করা হচ্ছে কোনো বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির কচ্ছপকে আর তার পাশেই তাকিয়ে রয়েছে কোনো অস্ট্রেলিয়ান নেউলে; নেই কোনো পরিচ্ছন্নতা কিংবা স্বাস্থ্যবিধি। প্রাণীর শরীর থেকে মানুষের শরীরে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কী অবাধ-সুন্দর সুযোগ!
স্টিভেন গেইল স্ট্যার, একজন পরিবেশ এবং মানবাধিকার বিষয়ক তদন্তকর্মী, এক ভিডিও প্রতিবেদনে ব্যাংককের এক অবৈধ ওয়েট মার্কেটের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন,
সংবদ্ধ খাঁচাগুলোয় কী নেই! অস্ট্রেলিয়ান কাকাতুয়া থেকে শুরু করে নীলরঙা টিকটিকি, কিংবা আফ্রিকান উদ্বিড়াল থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ফেরেট, অথবা কোনো বিরল প্রজাতির সাপ। কে জানে, হয়তো এর কোনো একটি খাঁচা থেকেই শুরু হতে পারে পরবর্তী কোনো মহামারি!
প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বাস্তুতন্ত্র কখনই এদের একসাথে থাকতে দেয়নি। তাই এই ধরনের পরিবেশে সহজেই এক প্রাণীর বহন করা ভাইরাস অন্য প্রাণীতে প্রবেশ করতে পারছে, আর সেখান থেকে সংক্রমিত হচ্ছে মানুষে। এই সংক্রমণের উপায় সম্পর্কে PREDICT এর প্রতিষ্ঠাতা ডেনিস ক্যারল নটিলাসকে বলেন,
সাধারণত এসব প্রাণী জবাই করা থেকে শুরু করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ কিংবা প্রস্তুত-প্রক্রিয়ার যেকোনো ধাপেই আপনি আক্রান্ত হতে পারেন, মূলত এমন অবস্থায় যখন আপনি ভাইরাস বহনকারী প্রাণীটির রক্ত কিংবা শরীর নিঃসৃত তরলের সরাসরি সংস্পর্শে আসেন। মনে করে দেখুন, মিশরে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাসটি প্রথম সংক্রমিত হয়েছিল এক নারীর শরীরে, যিনি সরাসরি আক্রান্ত মুরগি জবাই করার কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
এর ভয়াবহতা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি আরও বলেন,
আপনাকে বুঝতে হবে, ভবিষ্যতের হুমকিগুলো পরিবেশেই ঘোরাফেরা করছে, অর্থাৎ বিভিন্ন রকম নতুন ভাইরাসের একটি বড় আধার বাস্তুতন্ত্রে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু আমরা কেবলমাত্র তখনই এদের জানতে পারছি, যখন এরা নতুন কোনো রোগের কারণ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
এবার হয়তো পরিষ্কারভাবে মেলানো যাচ্ছে চীনা-বাদুড় থেকে আফ্রিকান সিভেট ক্যাটে ভাইরাসের সংক্রমণ অথবা SARS মহামারীর সাথে গুয়াংডং এর সেই ওয়েট মার্কেটের সম্পর্ক। চলুন ফিরে যাই, উহানের সেই সি-ফুড মার্কেটে।
একজন সচেতন নাগরিক চীনের মাইক্রোব্লগিং ওয়েবসাইট Weibo তে পোস্ট করেছিলেন সেই সি-ফুড মার্কেটের একটি ভিডিও, যা পরবর্তীকালে সিএনএন-এর কাছে আসে। সেখানে খাঁচাবন্দী অবস্থায় মার্কেটের একটি অংশে দেখা যায় সাপ, র্যাকুন কুকুর, হরিণ আর সঁজারুর কয়েকটি প্রজাতিকে। দেখা গেছে ক্রেতাদের সামনে প্রাণীহত্যার ফুটেজও। এরপর চীন-সরকারের সেন্সর Weibo থেকে ভিডিওটি ডিলিট করে দেয়।
যদিও কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের জন্য হুয়ানান ওয়েট মার্কেট-ই দায়ী কি না- এই বিষয়ে এখনও কোনো নিশ্চিত বা জোরালো প্রমাণ নেই, তবে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলছেন বাদুড়, কেউ বলছেন সাপ, আবার কেউ বলতে চাইছেন প্যাঙ্গোলিন বা বনরুই এই ভাইরাস সংক্রমণের জন্য দায়ী। সবচেয়ে বেশি সন্দেহ যাচ্ছে প্যাঙ্গোলিন বা বনরুই-এর দিকে, কারণ ওয়েট মার্কেটগুলোতে বেশ কয়েক বছর ধরে এটি পাচার হয়ে যাওয়া প্রাণীদের তালিকার শীর্ষে।
চীনের উহান থেকেই উৎপত্তি- এ কারণে এই ভাইরাসকে ‘চায়না ভাইরাস’ বা ‘উহান ভাইরাস’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ার একটি প্রবণতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিদ্যমান। উৎপত্তির এ বিষয়টি মেনে নিলেও ভাইরাসটির নামের সাথে চীনের নাম জড়ানোয় অসন্তোষ জানিয়েছেন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্বশীলেরা।
ওদিকে শুধু নামের জন্য অসন্তোষই নয়, করোনাভাইরাস নিয়ে চীনে ষড়যন্ত্র-তত্ত্বও বেশ রমরমা। সম্প্রতি চীনের মিলিটারি অনলাইন পোর্টাল xilu.com-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে কোভিড-১৯-কে “চীনকে শায়েস্তা করবার উদ্দেশে তৈরি মার্কিন জৈব-রাসায়নিক অস্ত্র” হিসেবে অভিযোগ করা হয়।
এদিকে মেডিক্যাল জার্নাল The Lancet-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে একদল চীনা বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, হুয়ানান সি-ফুড মার্কেটে প্রবেশের আগে অন্য কোথাও সংক্রমণ ঘটেছিল এই ভাইরাসের! গবেষণাটি করা হয় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রথম ৪১ জনকে নিয়ে, যেখানে প্রথম শনাক্ত হওয়া রোগী সহ ১৩ জনের সাথে ওই সি-ফুড মার্কেটের কোনো সম্পর্কই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সংক্রমণের পর থেকে হুয়ানান সি-ফুড মার্কেটসহ চীনের প্রায় বিশ হাজারেরও বেশি ওয়েট মার্কেট বন্ধ করে দেওয়া হয়, সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় সব ধরনের ওয়াইল্ড-লাইফ মার্কেটের ওপর। তবে ২০০২ সালে SARS সংক্রমণের পর চীনকে একই পদক্ষেপ নিতে দেখা গেলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
এসব মার্কেট চলছিল দেশটির প্রভাবশালী-পুঁজিপতিদের ছত্রছায়ায়। অন্যদিকে চাইনিজ অ্যাকাডেমি অভ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ২০১৭ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৭৩ বিলিয়ন ডলারের এই বাণিজ্যের সাথে জড়িয়ে রয়েছে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান। ফলে রাতারাতি সেসব বন্ধ করাও মুশকিল ছিল।
বাদুড় হোক বা প্যাঙ্গোলিন, উহানের সেই ওয়েট মার্কেট হোক বা অন্য কোনো ওয়াইল্ড-লাইফ মার্কেট- এতসব তর্কবিতর্কের একটি মাত্রই সারাংশ- আমরা যদি সামনের পৃথিবীকে আরও বড় কোনো মহামারির হাত থেকে বাঁচাতে চাই, তাহলে অবশ্যই নজরে আনতে হবে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এসব ওয়েট মার্কেটগুলোকে, নতুবা এভাবেই হয়তো মানুষের ওপর একের পর এক নেমে আসতে থাকবে প্রকৃতি-মাতার প্রতিশোধ।