Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ম্যাকগ্রা ফাউন্ডেশন: স্তন ক্যান্সার সচেতনতার এক অগ্রদূত সংগঠন

প্রতিবছর জানুয়ারিতে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত সিডনি টেস্টের ৩য় দিনে পুরো স্টেডিয়াম সাজে এক বর্ণিল সাজে। সব কিছুতেই লাগে গোলাপী রঙের ছোঁয়া। দিনটি এক দিনের জন্যে পরিণত হয় পিংক ডেতে। ধারাভাষ্যকার থেকে শুরু করে আম্পায়ারের হ্যাট কিংবা খেলোয়াড়দের ক্যাপ, জার্সির লোগো, ব্যাটের স্টিকার, স্টাম্প সবকিছুই ছেয়ে যায় গোলাপী রংয়ে। চলুন জেনে নেওয়া যাক এর নেপথ্যের ইতিহাস। আজ থেকে এক যুগেরও বেশি সময় আগে যে স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ফাউন্ডেশনটি ধীরে ধীরে সেই লক্ষ্য এবং এবং উদ্দেশ্য অর্জনে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি।

গোলাপী রঙে সেজেছেন সিডনি টেস্ট দেখতে আসা সমর্থকরা; ছবিসূত্র: News API

১৯৭০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে জন্মগ্রহণ করেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। পুরো নাম গ্লেন ডোনাল্ড ম্যাকগ্রা। ম্যাকগ্রার ডাক নাম ছিল পিজিয়ন। ১৯৯৩ সালে নিউজিল্যান্ড এর বিপক্ষে তার আন্তর্জাতিক টেস্টে অভিষেক। ১৯৯৯-২০০৩ এ অস্ট্রেলিয়ার ৩টি বিশ্বকাপ জয়েই বল হাতে ম্যাকগ্রার অবদান ছিল চোখে পড়ার মতো। ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম এক সফল বোলার।

২০০৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে নিয়েছিলেন ২১টি উইকেট। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কাকে ৫৩ রানে হারিয়ে টানা ৩য় বার বিশ্বকাপ ঘরে তোলে অজিরা। ম্যাকগ্রা নিয়েছিলেন ২৬টি উইকেট। ‘প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট’ এর পুরস্কার হাতে উঠেছিল ম্যাকগ্রার। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি তিনি। ম্যাকগ্রার ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস ১৫/৭, যা তিনি নিয়েছিলেন ২০০৩ এর বিশ্বকাপে নামিবিয়ার বিপক্ষেে। অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ২৫০টি, উইকেট নিয়ছেেন ৩৮১টি। ১২৪টি টেস্ট ম্যাচে তার উইকেট সংখ্যা ৫৬৩।

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সাম্রাজ্যের অন্যতম এক সেনাপতি ছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। তবে ব্যক্তিগত জীবনটা এতটা সুখের ছিল না ম্যাকগ্রার। ১৯৯৫ সালে হংকং এর একটি নাইট ক্লাবে ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট জেন লুইস এর সাথে তার প্রথম দেখা। দুজনের মন দেওয়া নেওয়া শুরু তখন থেকেই। ১৯৯৭ সালে জেনের দেহে স্তন ক্যান্সার ধরা পড়লে ম্যাকগ্রার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চান জেন। কিন্তু বাঁধা পড়েন ম্যাকগ্রার ভালবাসায়। অনিশ্চিত ভবিষ্যত জেনেও তীব্র ভালবাসার টানে ২০০১ সালে জেনকে বিয়ে করেন গ্লেন ম্যাকগ্রা।

জেন ম্যাকগ্রা; ছবিসূত্র: The daily Mail

অসুস্থ থাকা অবস্থাতেই জেন জন্ম দেন হলি এবং জেমস নামক দুই সন্তানের। তবে জন্ম দিলে কী হবে? নিজের অসুস্থতার কারণে দুই সন্তানকে কখনোই পরম মমতায় মাতৃস্নেহে জড়াতে পারেননি জেন। জেন অনুভব করতে লাগলেন এই পৃথিবীতে তার সময় আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে। তবে আর কোনো সন্তানকে যেন মা হারা হতে না হয় সে জন্যে ‘টুগেদার উই ক্যান মেক অ্যা ডিফারেন্স’ স্লোগান নিয়ে ২০০৫ সালে ম্যাকগ্রা দম্পতি প্রতিষ্ঠা করেন ম্যাকগ্রা ফাউন্ডেশন।

ম্যাকগ্রা ফাউন্ডেশন এর লোগো; ছবিসূত্র: The Sydney Morning Herald

এই সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য জনগণের মধ্যে স্তন ক্যান্সার বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। নারী ও পুরুষকে স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতন করা এবং স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের ও তাদের পরিবারকে আর্থিকভাবে, মানসিকভাবে সেবা প্রদান করা। তবে মৃত্যুর পূর্বে কখনোই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েননি জেন। তার সেবার কাজে নিয়জিত সেবিকারা তাকে অনবরত সাহস জুগিয়েছেন। জেন ম্যাকগ্রা বলেন-

আমার সেবিকারা আমাকে কখনোই মানসিকভাবে হতাশ হতে দেয়নি। তারা আমাকে বুঝিয়েছে আমি শুধু একজন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীই নই। বরং আমি কারো বন্ধু, কারো স্ত্রী, কারো মা।

দীর্ঘদিন স্তন ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে ২০০৮ সালের ২২ জুন সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান জেন ম্যাকগ্রা। জেনের মৃত্যুর পর গ্লেন হাল ধরেন সংগঠনটির; সাথে জেনের রেখে যাওয়া দুই সন্তানেরও। স্ত্রীর মৃত্যু তাকে দুর্বল করতে পারেনি, বরং তার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে তা পূরণ করার চ্যালেঞ্জ। ২০০৯ সালে সিডনি টেস্ট চলাকালে স্ত্রীর স্মরণে হাতে গোলাপী ফিতা পরে আসেন ম্যাকগ্রা।

বিষয়টি সবার নজর কাড়ে। সেই বছরই প্রথমবারের মতো সিডনি টেস্টের তৃতীয় দিনকে ‘জেন ম্যাকগ্রা ডে’ হিসেবে পালন করা হয়। ২০০৯ সালে ইন্টেরিয়র ডিজাইনার সারা লিওনার্দির সাথে ম্যাকগ্রার পরিচয় হয়। পরের বছর তার সাথে দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন গ্লেন ম্যাকগ্রা। স্বামীর কাজে নিরলসভাবে সহায়তা করে যাচ্ছেন গ্লেন ম্যাকগ্রার ২য় স্ত্রী সারা ম্যাকগ্রা। তিনি বলেন-

ওপার থেকে জেন যদি তাকিয়ে দেখে তাহলে ফাউন্ডেশনটি যা অর্জন করেছে তাতে সে খুশি হবে। আমি গর্ব করি সিডনি টেস্ট নিয়ে। ঐ সময় আমাদের পরিবার যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে; তার জন্য ঠিক ততটাই গর্ব করি।

ফাউন্ডেশনটিতে রয়েছে ১১৯ জন দক্ষ সেবিকা। সারা বছরই বিভিন্ন টিমে বিভক্ত হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে স্তন ক্যান্সারের ওপর স্বাস্থ্যবিষয়ক ক্যাম্প করে তারা। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০,০০০ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছে এ ফাউন্ডেশনটি। স্তন ক্যান্সার শনাক্ত থেকে শুরু করে, জনগণকে স্তন ক্যান্সারের বিষয়ে তথ্য প্রদান করা, রোগীদের সেবা প্রদান, রোগী এবং তাদের পরিবারকে আর্থিক এবং মানসিকভাবে সহায়তা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এই সেবিকারা। অ্যাশেজে ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার শত্রুতার কথা সবারই জানা। তবে একমাত্র সিডনি টেস্টের ৩য় দিনে এই দুই দলের খেলোয়াড়রা যেন এক বাঁধনে বাঁধা।

১০ম পিংক টেস্টের আগে অস্ট্রেলিয়ান খেলায়াড়দের সাথে ম্যাকগ্রা; ছবিসূত্র: 4bc.com.au

কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত সিডনি টেস্টের তৃতীয় দিন ছিল ম্যাকগ্রা ফাউন্ডেশনের ১০ম গোলাপী টেস্ট। ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী সমর্থকগোষ্ঠী বার্মি আর্মিরাও এসেছিল গোলাপী সাজে। সেদিন অস্ট্রেলিয়ান সমর্থকরা জেন ম্যাকগ্রার ছবি সম্বলিত বিশাল এক ব্যানার প্রদর্শন করে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে।

জেন ম্যাকগ্রার ছবি সম্বলিত সেই ব্যানার; ছবিসূত্র:dailymail.co.uk

সেদিন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে আসেন অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল। গোলাপী টাই পরা অবস্থায় তাকে দেখা যায় দর্শকদের মাঝে।

গোলাপী টাই এবং ক্যাপে সমর্থকদের সাথে অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী; ছবিসূত্র: The Sydney Morning Herald

এ বছর গোলাপী টেস্টের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি চ্যারিটি ইভেন্ট খোলা হয়, যেখানে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গান গায় অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় শিল্পি ইলা হুপার। এ বছর সংগৃহীত অর্থের মোট পরিমাণ ছিল ৪,৫৫,০৮৪ মার্কিন ডলার। সিডনির বিখ্যাত অপেরা হাউজ সেই রাতে সেজে ওঠে গোলাপী রঙে। গত বছর সিডনিতে অনুষ্ঠিত নারী অ্যাশেজেও অস্ট্রেলিয়ান এবং ইংল্যান্ডের নারী ক্রিকেটাররা গোলাপী রঙের ক্যাপ মাথায় দিয়ে খেলতে নামেন।

সংগঠনটি প্রায় ৫০টিরও বেশী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত, যার মধ্যে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া, টিজিএ মার্কেট, কমিউনিটি ফাস্ট ক্রেডিট নামক প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য, যারা বিভিন্ন সময় আর্থিক অনুদান দিয়ে সংগঠনটিকে সাহায্য করে। ২০১৩ সালে তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড ১৮.৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থ দান করেন। ফাউন্ডেশনটির অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, এলিস পেরি, মাইকেল ক্লার্ক, শেন ওয়াটসনের মতো ক্রিকেটাররা। এ বিষয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রা বলেন-

আমি ধন্যবাদ দিতে চাই সেই সব ব্যক্তিদের, যারা আমাদের সহায়তা করেছেন। তাদের সাহায্য ব্যতীত কোনো কিছুই সম্ভব হতো না। আমি কৃতজ্ঞতা বোধ করি তাদের প্রতি।

ফিচার ইমেজ: dailymail.co.uk

Related Articles