Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শিশুর উপর যৌন নির্যাতন

ঘটনা- ১

নিতু খুব চঞ্চল একটা শিশু। সারাক্ষণ লাফালাফি, ছোটাছুটি করতেই থাকে। বয়স ছয় কি সাত হবে। মুখে কথার ঝুরি লেগেই থাকে। দেখতেও বেশ মিষ্টি। সবাই আদর করে, কোলে নেয়।

কিছুদিন ধরে নিতু চুপচাপ হয়ে গেছে। আগের মত হাসে খেলে না। রাতে মাঝেমধ্যে ঘুমের মধ্যে কেঁপে কেঁপে ওঠে।

কয়েকদিন আগে নিতুকে নিয়ে ওর বাবা-মা একটা দাওয়াতে যায়। সেখানে এক ভদ্রলোক ওকে কোলে নেয়। চকলেটের কথা বলে সে নিতুকে নিয়ে সবার অলক্ষ্যে চলে যায়। একটা সময় সে নিতুর জামার ভেতর হাত দিয়ে শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় স্পর্শ করতে থাকে।

ভয়ার্ত শিশুর প্রতিচ্ছবি © nblive.in

ঘটনা- ২

রাতুল এবার তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। শান্ত ভদ্র ছেলে হিসাবেই সবাই জানে। ওদের বাসায় দুই রুম। এক রুমে রাতুল একা থাকে, আরেক রুমে রাতুলের বাবা-মা থাকে।

গ্রাম থেকে রাতুলের বাবার চাচা এসেছে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর, তিনি রাতুলের রুমে ঘুমাতে যায়। মাঝরাতে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে রাতুলের ঘুম ভেঙে যায়। রাতুল ওর বিশেষ জায়গায় তীব্র ব্যথা অনুভব করে।

পরদিন থেকে রাতুল আর সেই লোকটার সাথে ঘুমাতে যায় না। তার বাবা তাকে খুব ধমক দিলেও, সে শুধু একটা কথাই বলে, “আমি তার সাথে ঘুমাবো না।”

নির্যাতিত শিশুর নিজেকে অন্ধকারে আড়াল করে রাখা © banglatribune.com

ঘটনা- ৩

রিপার আজ বাসর রাত। বিয়ের দিন মেয়েরা কাঁদে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রিপা শুধু কাঁদছে না, প্রচণ্ড ভয় নিয়ে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। সাগর অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাপারটা খেয়াল করলো। সে রুমে এসেছে, এটা রিপা খেয়াল করেনি। কাছে গিয়ে যে-ই বসল, অমনি রিপা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। 

কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে সাগর তাকে আশ্বস্ত করল ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু এত ভয় পাচ্ছে কেন সে?

তখন ইতস্তত করে রিপা সাগরকে সব খুলে বলল। কিভাবে সে তার আপন চাচার দ্বারা ছোটবেলায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল! সে কাউকে এই কথা বলতে পারেনি ভয়ে, কারণ কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। বরং তাকেই সবাই বকবে, মারবে।
সব শুনে সাগর তাকে আশ্বস্ত করল, এই ট্রমা থেকে বের হতে সে তাকে সবরকম সমর্থন দেবে।

ঘটনা- ৪

সজীব বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। কিছুদিন আগে সে তার খালার বাসায় বেড়াতে যায়। রাতে তার খালাত ভাইয়ের সাথে এক রুমে ঘুমায়। পরদিন থেকে তার খালাত ভাই আর তার কাছে যেতে চায় না। সে তাকে প্রচণ্ড ভয় পায়।

দশ বছর আগে একবার সজীবদের বাসায় ওর এক আংকেল আসে। রাতে আংকেল তাকে প্রচন্ড ব্যথা দেয়। কিন্তু সজীবের কথা কেউ বিশ্বাস করেনি তখন। দিনের পর দিন সজীব সেই ব্যথা সহ্য করে যেত।

দশ বছর আগের ও পরের ঘটনায় কিছু কি মিল পাচ্ছেন পাঠক?

ঘটনা- ৫

শায়লা চাকরিজীবী মহিলা। তার একমাত্র ১০ বছরের ছেলে রাফসানকে বাসার গৃহ পরিচারিকার কাছে রেখে যান। শায়লা লক্ষ্য করেন, রাফসান কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। আতঙ্কের মধ্যে থাকে। গৃহপরিচারিকাকে দেখলে ভয় পায়। একদিন তিনি রাফসানের শরীরে অনেকগুলো খামচির দাগ দেখতে পেলেন!

সারাক্ষণ চারপাশে নির্যাতন কল্পনা করা © campaignlive.co.uk

উপরোক্ত ঘটনাগুলো আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। প্রকাশ্যে খুব কমই আসে এগুলো। আড়ালেই থেকে যায় বেশি। ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা দীর্ঘদিন পর্যন্ত জীবনে প্রভাব ফেলে। 

শিশু যৌন নির্যাতন প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা যুবকবয়সী কেউ তাদের পরিতৃপ্তির জন্য বিভিন্নভাবে করে থাকে। কেউ আদরের ছলে, কেউ কোনো কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে, কেউ জোর করে, কেউ ভয় দেখিয়ে, কেউবা ঘুমের ছলে। যেভাবেই শিশুকে নির্যাতিত করা হোক না কেন, উক্ত ঘটনা শিশুটির জীবনে প্রভাব ফেলে। কখনো প্রভাব হয় তাৎক্ষণিক, কখনো প্রভাব ফেলে সারাজীবনের জন্য। ফলে শিশু আত্মগ্লানি, আত্মহত্যা, প্রতিশোধপরায়ণতা, প্রবল ভীতি, যৌন অক্ষমতা, বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি ট্রমায় ভুগতে থাকে। আরো ভয়াবহ হয় তখন, যখন দেখা যায় যে, ছোটবেলায় কেউ নিপীড়িত হলে বড় হয়ে সে-ও নিপীড়ক হয়! 

ধর্ষণে স্বীকারের ঘটনা প্রকাশ্যে আসলেও পারিবারিক যৌন নিগ্রহের ঘটনা বেশিরভাগ সময়েই আড়ালে থেকে যায়। অনেকেই শিশুটির কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না। কেউবা আবার সমাজ, লোকলজ্জার ভয়ে চুপ করে থেকে যায় এবং শিশুকে উল্টো ধমক দেয় ভুলে যেতে ঘটনাটি। কিন্তু এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব পড়ে শিশুটির মানসিক বিকাশের উপর। ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুটির মানসিক বিকাশ, ভবিষ্যৎ। এমনকি অনেকে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে বিপথগামীও হয়ে থাকে। 

নির্যাতিত শিশুর রূপক প্রতিবিম্ব © lawyersclubbangladesh.com

যৌন নির্যাতন বলতে কী বোঝায়?

শিশু নির্যাতনের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট নির্যাতন হলো যৌন নির্যাতন। শিশুকে জোর করে নির্যাতনকারীর শরীরের কোনো অংশ স্পর্শ করানো বা শিশুর শরীরের কোনো অংশ জোর স্পর্শ করাকে সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ বা যৌন নির্যাতন বলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) হিসাবমতে, প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

শিশুর উপর প্রভাব

মানসিক

বিষণ্নতা, সহিংস আচরণ, নিজেকে বিভিন্ন কায়দায় কষ্ট দেয়া, আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি ও হীনম্মন্যতা, দুঃস্বপ্ন, অসামাজিক আচরণ, সমবয়সীদের সাথে মিশতে না পারা, হঠাৎ হঠাৎ চমকে ওঠা, আত্মহত্যার প্রবণতা, স্বাভাবিক মানসিক বিকাশে বাধা ইত্যাদি।

শারীরিক

শিশু গুরুতরভাবে আহত হতে পারে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিরতরে প্রজনন ক্ষমতা হারাতে পারে, নিউরোলজিক্যাল ড্যামেজ, দ্রুত ওজন কমে যাওয়া, শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি। 

করণীয় কী?

প্রথমেই আপনার শিশুকে ‘আদর’ সম্পর্কে বোঝান। তার স্পর্শকাতর জায়গাগুলো নিয়ে তাকে সচেতন করুন। তাকে বুঝতে দিন যে কেউ এসব স্থানে হাত দিতে পারে না। যিনি এসব কাজ করবেন, তিনি ভালো লোক নন। 

শিশুকে যার তার কোলে চড়তে দেবেন না। যে কেউ শিশুকে কোলে নিয়ে আদর না করে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। 

ঘুরতে যাবার কথা বলে আপনার শিশুকে কোথাও যেন নিয়ে না যায়। তাতেও অনেক সময় শিশু যৌন নিগ্রহের শিকার হতে পারে। তাই শিশুকে যার তার সাথে বাইরে যেতে দেবেন না।

অনেক সময় দেখা যায়, পরিচিত কারো কোলে অনেকেই তাদের সন্তানকে চড়তে দেয়। বাইরেও যেতে দেয়। এই কাজটিও সবসময় করবেন না। দূরে যেতে দেবেন না। পরিচিত হলেও তার দ্বারা শিশু নিগ্রহের শিকার হবে না, এমন কথা নেই। শিশু যদি কোনো ব্যক্তির কাছে যেতে না চায় বা তার বিষয়ে নালিশ করে কিংবা তার সঙ্গে অস্বাভাবিক অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা দেখায়, তাহলে অভিভাবককে সতর্ক হতে হবে। ওই ব্যক্তি যত আপনজনই হোক না কেন, ভেবে দেখতে হবে সে কোনোভাবে শিশুকে ব্যবহার করছে কি না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলেন,

“শিশুরা বানিয়ে কথা বলে এটা অনেক বাবা-মায়ের ধারণা। তাই অনেক বাবা-মা শিশুদের কথা আমলে নেয় না। কিন্তু এটা ঠিক নয়। তাতে শিশুরা ভালনারেবল হয়ে ওঠে।”

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন,

“আমাদের ধারণা নির্যাতন শুধু ছেলেরাই করে থাকে। অথচ আমরা এমনও রোগী পেয়েছি, যাকে নির্যাতনকারী একজন মেয়ে ছিল!”

সবসময় খেয়াল করুন আপনার শিশুর মানসিক অবস্থা কেমন। সে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হলে, মানসিকভাবে কিছু লক্ষণ দ্বারা এগুলো প্রকাশ পাবে। আপনি সেই লক্ষণগুলো দ্বারাও বুঝতে পারবেন আপনার শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে কি না। 

নির্যাতিত শিশুর লক্ষণ সমূহ 

১. সে হঠাৎ খুব চুপচাপ হয়ে যাবে।
২. কারো সাথে আগের মতো মিশবে না।
৩. যার দ্বারা নিগৃহীত হয়েছে, তাকে দেখলেই ভয় পাবে। ছুটে পালাতে চাইবে। চিৎকার চেঁচামেচিও করতে পারে।
৪. অনেক সময় দেখা যাবে, কোনো একজন পুরুষ দ্বারা নিগ্রহ হলেও সে সব পুরুষ দেখলেই প্রচণ্ড রকম ভয় পায়।
৫. অনেক সময় দেখা যায় কিছু শিশু আঁকাআঁকি করতে পছন্দ করে। তখন সে তার সাথে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনা ছবি এঁকে প্রকাশ করে।
৬. আতংকে থাকে সবসময়।
৭. ঘুমের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রলাপ বকতে পারে।

নির্যাতিত শিশুর চিকিৎসা

সবার আগে উচিত বাবা-মায়ের শিশুটিকে মানসিক সমর্থন দেওয়া। এই ভয়াবহ ঘটনায় শিশুটি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সঠিকভাবে চিকিৎসা না করালে জীবন হুমকির মুখে পড়ে। প্রভাব পড়ে দীর্ঘদিন ব্যক্তিজীবনে। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ  ডাক্তারেরও শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

প্রাণবন্ত শিশুদের হাসি © prothomalo.com

ফিচার ইমেজ- yourdost.com

Related Articles