অদ্ভুত কোনো ব্যাপার কিংবা নাটকীয় কোনো গল্প কিংবা অলৌকিক কোনো ঘটনার প্রতি মানুষের আজন্ম আগ্রহ। এসব ঘটনা যখন বইয়ের পাতায় কিংবা মানুষের মুখে ‘গল্প’ হিসেবে থাকে, তখন এসবে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা বাধে তখনই, যখন এসব ঘটনাকে কেউ ‘সত্য’ বলে দাবী করে। এ ধরনের ঘটনা বর্তমান কালে ঘটলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর যৌক্তিকতার মাধ্যমে যাচাই করা যায়, আসলেই ঘটনাটি ঘটেছে কিনা আসলেই ঘটনাটি সত্য কিনা। কিন্তু অনেক অনেক আগের কোনো ঘটনাকে যখন কেউ অলৌকিক বা সত্য বলে দাবী করে, তখন যাচাই বাছাই করতে সমস্যা হয়। সত্য মিথ্যা নির্ণয় করতে সমস্যা হয়। এই সীমাবদ্ধতার সুযোগে অনেক কাল্পনিক আর বানোয়াট জিনিস মানুষের কাছে আজ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
কীভাবে কোনো অলৌকিক ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাই করবো? অলৌকিকতাকে বিচার বিশ্লেষণ করার জন্যও সুন্দর কিছু নিয়ম আছে।আঠারো শতকের দিকে ডেভিড হিউম নামে একজন স্কটিশ চিন্তাবিদ ছিলেন। অলৌকিকতাকে ব্যবচ্ছেদ করার চমৎকার একটি উপায় তৈরি করেছিলেন তিনি। অলৌকিকতা কী? ঠিক কীরকম ঘটনা ঘটলে আমরা তাকে অলৌকিক বলে ধরে নেব?
ডেভিড হিউমের মত অনুসারে যে সকল ঘটনা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ামাবলীকে লঙ্ঘন করে সেগুলোকে অলৌকিক বলা যায়। বিজ্ঞানের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে মানুষের পক্ষে পানির উপর হাঁটা সম্ভব নয়। ঘটনাক্রমে কেউ যদি পানির উপর দিয়ে দিব্যি হেঁটে যায় তাহলে ঐ ঘটনাটি হবে অলৌকিক ঘটনা। পানি থেকে ওয়াইন তৈরি হওয়া, মস্তিষ্কের চিন্তা-শক্তির মাধ্যমে ঘড়ির চলন থামিয়ে ফেলা, দূর থেকে প্রবল মনোযোগ দিয়ে ধ্যান করে গাড়ি স্টার্ট করে ফেলা, ব্যাঙকে রাজকুমারে পরিণত করা, রাজকুমারকে ব্যাঙে পরিণত করা, মিষ্টি কুমড়া থেকে গাড়ি তৈরি করা ইত্যাদি ঘটনাগুলো ঘটে থাকলে সেগুলো হবে অলৌকিক ঘটনার চমৎকার উদাহরণ।
এ ধরনের ঘটনাগুলো যদি সত্যি সত্যি ঘটতো তাহলে প্রকৃতির নিয়মগুলোর জন্য বেশ সমস্যা হতো। অন্তত বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তো সমস্যা হতোই। কারণ এই ঘটনাগুলো মামুলী ব্যাপার হলে বিজ্ঞানের সকল স্তম্ভই ধ্বংস হয়ে যেত এবং নতুন করে গড়ে উঠতে হতো। এ ধরনের ঘটনাগুলো সত্যি সত্যি ঘটলে বিজ্ঞানের নিয়মাবলীগুলো আদৌ তৈরি করা যেত কিনা সন্দেহ।
আমাদের কাছে বিজ্ঞান আছে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ এমন অলৌকিক ঘটনার কথা বললে সেগুলোকে আমরা কীভাবে গ্রহণ করবো? কীভাবে গ্রহণ করা উচিৎ? অলৌকিকতার ব্যবচ্ছেদ করার জন্য এই প্রশ্নটাই হচ্ছে ডেভিড হিউমের মূল পয়েন্ট। হিউমের উত্তরও ছিল চমৎকার। ডেভিড হিউম যেভাবে এর একটি সুরাহা করেছেন সেটা এখানে তুলে দিলাম।
No testimony is sufficient to establish a miracle, unless the testimony be of such a kind, that its falsehood would be more miraculous than the fact which it endeavors to establish.
তার লেখা বাক্যগুলো বেশ কঠিন লাগছে না? হ্যাঁ, কঠিনই বলা যায়। তিনি এটা লিখেছিলেন অনেক অনেক বছর আগে। তখনকার সময়ের ইংরেজি ভাষা আর আজকের আধুনিক ইংরেজি ভাষায় বেশ পার্থক্য বিদ্যমান। এখানে তার কথার মর্মার্থ সহজভাবে উপস্থাপন করছি।
ধরা যাক, একজন লোকের নাম কদম আলী। কদম আলী এসে এমন একটি ঘটনার কথা বললো যে বাস্তবতার নিয়ম অনুসারে এই ঘটনা ঘটা অসম্ভব। তার মানে এটা অলৌকিক ঘটনার কাতারে পড়ে। এখন কোন পরিস্থিতিতে পড়লে এই ঘটনাকে অলৌকিক হিসেবে গ্রহণ করে নেব?
এর জন্য দেখতে হবে কদম আলী মিথ্যা কথা বলে কেমন। যদি এমন হয় যে আমার জীবনে কখনো কদম আলীকে মিথ্যা বলতে শুনিনি, তার পক্ষে মিথ্যা কথা বলা কখনোই সম্ভব নয়, তাহলে তার বলা অলৌকিক ঘটনাটিকে মেনে নেবার একটি সুযোগ থাকে। যদি দেখা যায় অলৌকিক ঘটনাটি যতটা অসম্ভব, তার চেয়েও বেশি অসম্ভব হচ্ছে কদম আলীর মুখে মিথ্যা কথা বের হওয়া, তাহলে তার কথাটি প্রাথমিকভাবে মেনে নেয়া যায়।
এরপর আসছে ভুল (Mistake) এবং ভ্রান্তি (Illusion) সংক্রান্ত ব্যাপার। কদম আলীর পক্ষে মিথ্যা বলা অসম্ভব, আবার ঘটনাটিও বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে অসম্ভব। তাহলে এর পেছনে অন্য কোনো কৌশল অবস্থা করছে না তো? এমনও তো হতে পারে, কদম আলী যা দেখেছে সেটি ভুলভাবে দেখেছে কিংবা কোনো ধাঁধাময় ভ্রান্তির গোলকধাঁধায় পড়ে বেগুন গাছকে সেগুন গাছ হিসেবে দেখেছে।
যেমন- একদিন কদম আলী এসে বললো চাঁদে কোনো এক ব্যক্তিকে দেখা গেছে। সে নিজের চোখে দেখেছে ঐ ব্যক্তি চাঁদের মধ্যে লাফালাফি-নাচানাচি করছে। যদি এরকম দাবী করে, তাহলে অবশ্যই ধরে নিতে হবে সে মিথ্যা বলছে। যদি তার পক্ষে মিথ্যা বলাটা অসম্ভব হয়, তাহলে অবশ্যই কোনো না কোনো ভ্রান্তি বা হ্যালুসিনেশনের মাঝে সে এটা দেখেছে। কারণ পৃথিবীতে বসে পৃথিবীতে বসবাসকারী বাসিন্দাকে চাঁদে লাফালাফি করতে দেখা অবশ্যই অসম্ভব।
এই উদাহরণটা একদমই মামুলী ছিল। একটা বাস্তব উদাহরণ টানার চেষ্টা করি। ১৯১৭ সালের দিকে ফ্রান্সিস গ্রিফিথ ও এলসি রাইট নামে দুই বোন কতগুলো ভিন্নধর্মী ছবি তুলেছিল। ছবিতে দেখা যায় তাদের সামনে ডানাওয়ালা কতগুলো শুভ্র প্রাণ আনাগোনা করছে। তারা দাবী করেছিল এগুলো আসলে পরী। চিত্রটি এরকমই একটি ছবি যেখানে পরীদের পাশে এলসি পোজ দিয়ে আছে।
নিশ্চয় সকলে ধরে নিয়েছে, এটা অবশ্যই ভুয়া ছবি। ব্যাপারটা মামুলী হনে হচ্ছে? মনে রাখা দরকার সালটা ছিল ১৯১৭। আজকের যুগের ডি.এস.এল.আর, ফটোশপ, আর এন্ড্রয়েডের ফটো এডিটর তখন ছিল না। কেউ এদের কথা কল্পনাও করতে পারেনি। শত বছর আগে যেসব মানুষ বসবাস করতো তাদের কাছে ব্যাপারটা কতটা অবিশ্বাস্য তা ভাবা যায়? এই ছবি এমনকি বিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমসের স্রষ্টা ‘আর্থার কোনান ডয়েল’কেও বোকা বানিয়ে ফেলেছিল। উনার মতো বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ বোকা হয়ে গেলে অন্যান্য মানুষেরা কী করবে তা ভাবা যায়? বোকা বানানোর তালিকায় অন্যান্য শিক্ষিত মানুষ তো ছিলই।
এরপর অনেকগুলো দিন কেটে যায়। ছবির রহস্য অমীমাংসিতই থেকে যায়। সময়ের পালাবদলে যারা ছবি তুলেছিল তারা বয়স্ক হয়ে যায়। যখন এলসি ও ফ্রান্সিস বুড়ো হয়ে যায় তখন তারা এই ছবিটির ব্যাপারে মুখ খুলে। তারা স্বীকার করে নেয় ছবির পরীগুলো আসলে সত্যিকার পরী ছিল না। কার্ডবোর্ড কেটে বিশেষ উপায়ে ছবি তোলার মাধ্যমে এরকম চিত্র পাওয়া গিয়েছিল।
এবার ঘটনাটিকে ডেভিড হিউমের দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করে দেখি। নিচের দুটি পয়েন্টের মাঝে কোন পয়েন্টটি বেশি অলৌকিক বলে মনে হয়? কোনটি তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণ অযৌক্তিক বলে মনে হয়?
১. ঘটনাটি সত্যি। সেখানে আসলেই ডানাওয়ালা ক্ষুদ্র পরী ছিল এবং পরীগুলো ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
২. তারা বানিয়ে বানিয়ে এটি বলেছে এবং ছবিতে কোনো না কোনো চালাকি করেছে।
এখানের কোন ঘটনাটি বেশি অলৌকিক তা একটি শিশুও অনুধাবন করতে পারবে। ডেভিড হিউমের পদ্ধতি অনুসারে সম্ভাব্য যে ঘটনাটি সবচেয়ে কম অলৌকিক হবে সেটিই তুলনামূলকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। পৃথিবীতে কেউ কখনো পরী দেখেনি, পরীরা কী দিয়ে গঠিত তাও কেউ জানে না, পরীদের ছবি তোলা সম্ভব কিনা তা কেউ বলতে পারে না। মেয়েদের ছবি তোলার সময় ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানো পরী এসে পোজ দিয়েছে এমন ঘটনা অত্যন্ত অবাস্তব এবং খুব বেশি অলৌকিক। সেই তুলনায় ছবিতে জালিয়াতির ব্যাপারটি অনেক কম অলৌকিক। একজন মানুষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে জালিয়াতি করতেই পারে, এটা স্বাভাবিক। অবাস্তব নয়। হিউমের নীতি অনুসারে জালিয়াতির ব্যাপারটিই সত্য হবার কথা ছিল। ঘটনার অনেক বছর পর এটি সত্য হয়েছেও।
আমরা কোনো একটি ঘটনা সম্পর্কে ভালো করে জানি না, তার মানে এই না যে ঘটনাটি অলৌকিক হয়ে যাবে। ছবিতে পরীর রহস্য সম্বন্ধে কেউ জানতো না, অনেকে ধরে নিয়েছিল এটি অলৌকিক। পরবর্তীতে যখন সত্য ঘটনা ফাঁস হলো তখন সকল অলৌকিকতা চলে গেল। আমরা কোনো একটি জিনিসের ব্যাখ্যা না জানলেই যে সেটি অলৌকিক হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। যে জিনিসটিকে আমরা আজকে ব্যাখ্যাতীত বলে জানছি, কয়েকদিন পর সেটিই হয়ে যেতে পারে সহজ ব্যাখ্যার সাধারণ বাস্তবতা।
এলসি ও ফ্রান্সিসের কারচুপিতে কোনো মানুষের ক্ষতি হয়নি। বরং অনেক শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান মানুষকে এর মাধ্যমে বোকা বানানো গেছে বলে তা আনন্দের খোঁড়াকও হয়েছে। কিন্তু মাঝে মাঝে এ ধরনের ঘটনা হাঁসি বা আনন্দের পর্যায়ে থাকে না। কিছু কিছু ঘটনা সীমা ছাড়িয়ে যায়। যেমন ১৯১৭ সালের দিকে পর্তুগালের একদল মেয়ে দাবী করে বসে তারা নাকি মাতা মেরির আদলে একজন একজন নারীকে প্রতিদিন পাহাড়ের উপরে হাঁটতে দেখে। তার সাথে মাঝে মাঝে কথাও হয়। জাদুকরী কর্মকাণ্ডও করে দেখায়। মাতা মেরী নাকি অমুক দিন পাহাড়ের কাছে সকলকে একত্র হতে বলেছে। ঐদিন তিনি সকলকে এমন অলৌকিক কিছু করে দেখাবেন যেন সকলে তার ব্যাপারে বিশ্বাস করে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সেখানে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ জড় হয়েছিল অলৌকিকতা দেখার জন্য।বাস্তবে আসলেই অলৌকিক কিছু ঘটেছিল? আপনারাই ধরে নিন কী হতে পারে। ঘটনাটি ইতিহাসে ‘মিরাকল অব ফাতিমা‘ নামে পরিচিত। পর্তুগালের ফাতিমা অঞ্চলে ঘটেছিল বলে এই নাম।
এবার একটি কার্ড খেলার উদাহরণ দেই। ধরি, একজন বণ্টনকারী সবগুলো কার্ড চার জন প্লেয়ারের মাঝে বণ্টন করে দিল। সবাই ১৩টি করে কার্ড পেল। আমিও এই চার জনের মাঝে একজন। আমার কার্ডগুলো তুলে দেখে একদমই অবাক হয়ে গেলাম। আজকে আমার কপাল তো দেখা যায় একদমই ফেটে গেছে! ১৩টি আলাদা আলাদা কার্ডের ১৩টিই পড়েছে আমার কাছে এবং সবগুলোই ইশকাপন (পান পাতা)! এমন অবস্থা দেখে আমি একদমই হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। কী করবো বুঝতে না পেরে আমার কার্ডগুলো খুলে ধরলাম। সবাইকে দেখাতে চাইলাম কী অবাক করা একটা সমাবেশ পেয়েছি এবার।
কিন্তু তারপর অন্যরাও এক এক করে তাদের কার্ড টেবিলে রেখে দেখাতে শুরু করলো। তখন দেখলাম আসল চমক। প্রত্যেকের হাতেই এমন আলাদা আলাদা করে ১৩টি কার্ড রয়েছে। চার জনের কাছে ১৩টি হরতন, ১৩টি রুইতন, ১৩টি চিরতন ও ১৩টি ইশকাপন। এবারের সমাবেশটা যেন প্রতিটা পয়েন্টে পয়েন্টে পারফেক্ট!
ঘটনাটি যদি কল্পনা না হয়ে সত্যি সত্যি বাস্তবে ঘটতো তাহলে আমরা কী মনে করতাম? আবারো আসতে হবে ডেভিড হিউমের নীতির ছাঁচে। তিনটি সম্ভাব্য ঘটনা পাওয়া যাবে এতে।
১. অতিপ্রাকৃত কোনো অলৌকিক ঘটনা আসলেই এখানে ঘটেছে। কোনো জাদুকর বা কোনো দেবতা তাদের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙে হরতন, রুইতন, চিরতন ও ইশকাপন এগুলোকে আলাদা করে চারজনের ভাগে চার সেট সাজিয়ে দিয়েছে।
২. এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী সমপাতন (Coincidence)। এলোমেলো ও উদ্দেশ্যহীনভাবে হঠাৎ করে একবার এটি হয়ে গেছে। দৈবচয়ন।
৩. কেউ না কেউ এখানে কোনো চালাকি করেছে। কার্ড নাড়াচাড়া করতে করতে কোনো ব্যক্তি এতই অভিজ্ঞ হয়ে গেছে যে তার অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে এরকম ব্যতিক্রমী ঘটনা সে ঘটাতে পারে।
তিনটির কোনটিকে আমরা গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেব? এদের কোনটিকেই শর্তহীনভাবে মেনে নেয়া যায় না। সবকটিতেই কোনো না কোনো দিক থেকে কিন্তু আছে। তবে তৃতীয় সম্ভাবনাটি বাকি সম্ভাবনাগুলোর তুলনায় বেশি গ্রহণযোগ্য। ২য় সম্ভাবনাটিও ঘটা সম্ভব। দৈবক্রমে এরকম ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ৫৩,৬৪৪,৭৩৭,৭৬৫,৪৮৮,৭৯২,৮৩৯,২৩৭,৪৪০,০০০ বারে একবার। বিলিয়ন ট্রিলিয়ন বারে একবার মাত্র। সংখ্যাটা এত বড় যে, কেউ যদি খাওয়া ও ঘুম বাদ দিয়ে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা করে কার্ড বণ্টন করে যায়, তাহলেও এত পরিমাণ কার্ড বিতরণ করতে কয়েক ট্রিলিয়ন বছর লেগে যাবে। আর এত বছর পরিশ্রম করে কার্ডের কাঙ্ক্ষিত প্যাটার্ন পাবার সম্ভাবনা মাত্র ১ বার।
একে ‘প্রায়’ অসম্ভবই বলা যায়। তবে তা একদমই অসম্ভব নয়। যত ক্ষুদ্রই হোক তার সম্ভাবনা আছে। ২য় সম্ভাবনাটি যতটা অসম্ভব, তার চেয়েও বেশি অসম্ভব হচ্ছে ১ম সম্ভাবনাটি।
কোনো মানুষ চেনে না, জানে না, কখনো শুনেনি এমন অজানা কোনো শক্তি প্রকৃতিতে বিদ্যমান থাকা বিজ্ঞানের নিয়ম-নীতিগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কার্ডের রঙ পরিবর্তন করে ৪ টি সুবিন্যস্ত সেট করে ফেলেছে- এমন কথা শুনলে ভেতর থেকে একটি কথাই বের হয়ে আসবে- “ধুর, অসম্ভব। যত্তসব অবাস্তব কতাবার্তা।”
কিন্তু ডেভিড হিউম বলছেন এরকম ঘটনাকে সরাসরি অবাস্তবতার ঝুড়িতে ফেলে দেবার দরকার নেই। তিনি বলছেন ঘটনার সাথে বিকল্প ঘটনাগুলোকে তুলনা করে দেখা উচিৎ আগে।
শুধুমাত্র আমাদের মতো পাওয়া ১৩টি কার্ডের আলাদা আলাদা সমাবেশ নয়, ১৩টি কার্ডের যেকোনো সমাবেশ পেতে হলে ট্রিলিয়ন বছর পরিশ্রম করতে হবে। সাধারণ এলোমেলো কোনো প্যাটার্ন আর ১৩টি কার্ডের সবকটিকে একত্রে নিয়ে আলাদা কোনো প্যাটার্ন পাবার সম্ভাবনা একই। আমাদের পাওয়া ১৩টি আলাদা আলাদা কার্ডের প্যাটার্ন পাওয়া যেমন বিরল, তেমনই অন্য কোনো এলোমেলো প্যাটার্নও ২য় বার পাওয়া বিরল।
যে যুক্তিতে আমাদের পাওয়া প্যাটার্নটি অনন্য ছিল, ঠিক একই যুক্তিতে এলোমেলো প্যাটার্নও অনন্য। এলোমেলো প্যাটার্নও একটি প্যাটার্ন। এটিও এর দিক থেকে বিশেষ। এটিও সব দিক থেকে অনন্য। কোনো একটি এলোমেলো প্যাটার্ন ২য় বার পাবার সম্ভাবনাও আগের মতোই- প্রতি ৫৩৬,৪৪৭,৭৩৭,৭৬৫,৪৮৮,৭৯২,৮৩৯,২৩৭,৪৪০,০০০-টিতে ১টি। এলোমেলো কোনো প্যাটার্নে আমরা বিশেষ কোনো কিছু খুঁজে পাই না, অবাক করার মতো কিছু মনে করি না। তাই এগুলোকে মামুলি ঘটনা বলে মনে হয়। কিন্তু একই রংয়ের কার্ড পেলে মনে করি এ এক অনন্য সমাবেশ, এ এক অনন্য মিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নির্দিষ্ট সজ্জা আর এলোমেলো সজ্জার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।
অন্যান্য অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত ঘটনার ক্ষেত্রেও আমরা এরকম বলতে পারি। এমন কিছু একটা ঘটলো যা আমরা বুঝি না। এমন কোন যুক্তিও পাচ্ছি না যা দেখিয়ে বলবো ঘটনাটি মিথ্যা বা কল্পিত গল্প। এরকম হলে কি ঘটনাটিকে আমরা অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক বলে ধরে নেব? না, অবশ্যই না। এরকম ধরে নিলে সঠিক ব্যাখ্যা ও সত্য উদ্ঘাটনের আগ্রহে এখানেই পেরেক মেরে দেয়া হবে। কোনো একটি ঘটনার ব্যাখ্যা না জানলে আমাদেরকে উপযুক্ত ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এর গ্রহণযোগ্য বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যার জন্য অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে একদিন হয়তো এই ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।
Featured Image: Wallop