মধ্যবয়সী তারেক হাসান একটি বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে উঁচু পদে চাকরি করেন। নাম-যশ-অর্থ কোনো কিছুরই কমতি নেই তার। বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠানে তাকে প্রায়ই আমন্ত্রণ করা হয়। নিজের বাগ্মিতায় সবাইকে মুগ্ধ করে রাখেন তিনি।
কিন্তু চটপটে তারেক সাহেব ইদানীং কেমন যেন খিটখিটে মেজাজের হয়ে গিয়েছেন। সবসময় কেমন একটা ক্ষুধা লেগেই থাকে। যখন তখন পানি পিপাসা পাচ্ছে। পানি পান করেও শান্তি নেই। ঘনঘন টয়লেটে যেতে হয়। কয়েকদিন আগে শখের বাগানে কাজ করার সময় পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন, ক্ষতটাও কেমন জানি সারছে না। দ্রুত ওজনও কমে যাচ্ছে তার। সারাক্ষণ একটি ক্লান্তি আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে।
উপায়ন্তর না দেখে তারেক সাহেব একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। ডাক্তার সব শুনে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করতে বললেন। রিপোর্টে ধরা পড়লো, তার শরীরে বাসা বেঁধেছে ডায়াবেটিস। শুরু হলো তারেক সাহেবের কড়া রুটিনে আবদ্ধ জীবন।
ডায়াবেটিস কি?
আমাদের শরীরে বিলিয়ন বিলিয়ন কোষে প্রতি মুহূর্তে লক্ষ-কোটি কাজ হয়ে চলেছে। এই কাজ সুষ্ঠুভাবে সমাধা হওয়ার জন্য চাই শক্তি। শক্তির সবচেয়ে বড় যোগানদাতা কার্বোহাইড্রেট। এর মধ্যে রয়েছে ভাত, ডাল, আলু, শাকসবজি, গম ভুট্টা প্রভৃতি। জটিল বিক্রিয়া শেষে এগুলো আমাদের শরীরের কোষে গ্রহণ উপযোগী সরল অণুতে পরিণত হয়। এই সরল অণু হচ্ছে গ্লুকোজ। গ্লুকোজ অণুকে শরীরের কোষ গ্রহণ করে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন করে। এই শক্তি দেহকে সচল রাখে।
কিন্তু কোষে গ্লুকোজ প্রবেশ করতে হলে একটি হরমোন লাগে। এর নাম ইনসুলিন। আমাদের দেহের কোষে একধরনের চ্যানেল থাকে যেটা দিয়ে গ্লুকোজ শরীরে প্রবেশ করে। স্বাভাবিক অবস্থায় চ্যানেলটি বন্ধ থাকে। গোটা ব্যাপারটিকে আমরা নিম্নোক্তভাবে তুলনা করতে পারি।
ধরুন, ঘরের একটি কক্ষ হলো একটি দেহকোষ। আর ঘরের দরজা হচ্ছে ইনসুলিন ঢোকার চ্যানেল। সাধারণত নিরাপত্তার জন্য আমরা ঘরের দরজা যেমন বন্ধ করে তালা মেরে রাখি, তেমন গ্লুকোজ চ্যানেলটিও তালা মারা থাকে অর্থাৎ বন্ধ থাকে। তালা খুলতে যেমন চাবি লাগে, তেমনই গ্লুকোজ চ্যানেল খুলতে চাবি লাগে। এই চাবির নামই হলো ইনসুলিন। ইনসুলিন না থাকলে গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ করতে পারবে না। ফলে কোষে শক্তি উৎপাদন হবে না। আর কোষ শক্তি না পেলে তার কাজ ঠিকমতো করতে পারবে না। অথচ রক্তে অফুরন্ত গ্লুকোজের যোগান রয়েছে। কিন্তু কোষগুলোকে অভুক্ত অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে প্রস্রাবের সময় এবং ঘনত্ব বেড়ে যায়।
এই সামগ্রিক অবস্থাটি ডায়াবেটিস মেলাইটাস বা সংক্ষেপে ডায়াবেটিস নামে পরিচিত। বারে বারে প্রস্রাব করার জন্য এই রোগের আরেক নাম বহুমূত্র রোগ।
(প্রায় একই ধরনের আরেকটি রোগ আছে যার নাম Diabetes Incipidus, যেখানেও রোগী বারে বারে প্রস্রাব করে থাকে। কিন্তু আমাদের চারপাশে ডায়াবেটিস নামে যে রোগটির সাথে আমরা পরিচিত সেটি ডায়াবেটিস মেলাইটাস।)
স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের রক্তে অভুক্ত অবস্থায় প্রতি লিটারে ৫.৬ থেকে ৬.১ মিলি মোল গ্লুকোজ থাকে। খাবার গ্রহণের দুই ঘণ্টা পরে এটা বেড়ে যায়। তবে বেড়ে গেলেও তা প্রতি লিটারে ৭.৮ মিলি মোলের কম থাকে। অপরদিকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে অভুক্ত মানুষের দেহে প্রতি লিটার রক্তে ৭.০ মিলি মোলের উপরে গ্লুকোজ উপস্থিত থাকে। আর খাওয়ার দু’ঘণ্টা পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি লিটারে ১১.১ মিলি মোলের উপরে।
ইনসুলিনের সরবরাহ
আমাদের দেহে পরিপাকতন্ত্রে পাকস্থলীর পরে যে অংশ রয়েছে তার নাম ডিওডেনাম। ইংরেজি ‘সি’ আকৃতির ডিউডেনামের সাথে একটি গ্রন্থি অঙ্গাঙ্গীভাবে অবস্থিত, এর নাম প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়। গ্রন্থিটি ইঞ্চি ছয়েক লম্বা, ওজনে ৬০-১০০ গ্রামের মতো হবে। এটি একইসাথে অন্তঃক্ষরা এবং বহিঃক্ষরা গ্রন্থি। অর্থাৎ প্যানক্রিয়াস একইসাথে হরমোন এবং এনজাইম দুই-ই ক্ষরণ করে। এই অন্তঃক্ষরা অংশের বিটা সেল থেকে ক্ষরিত হয় ইনসুলিন।
প্রকারভেদ
আমরা আবার আগের উদাহরণে ফিরে যাই। ধরুন, আপনার ঘরে তালা দেওয়া রয়েছে। এখন ভাবুন তো, কোন কোন অবস্থায় আপনি ঘরে ঢুকতে পারবেন না?
প্রথমত, আপনার কাছে যদি চাবিটাই না থাকে। আর দ্বিতীয়ত, চাবি থাকা সত্ত্বেও যদি তালাটা কাজ না করে। এটাই তো দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা, তাই না?
আমাদের শরীরেও একই ব্যাপার ঘটে। কিছু কিছু মানুষের দেহে ইনসুলিনের উৎপাদন কমে যায়। ফলে ইনসুলিনের অভাব হয়। আর সেজন্য প্রতিটি কোষ প্রয়োজনীয় ইনসুলিন পায় না এবং তাদের ভেতরে গ্লুকোজ ঢুকতে পারে না। এদেরকে কোনোভাবে ইনসুলিন সরবরাহ করলে এই সমস্যা মিটে যায়। অর্থাৎ এ সমস্ত রোগীদের দেহে সমস্ত ব্যাপারটি ঘটে ইনসুলিনের অভাবের কারণে। তাই একে বলে Insulin Dependent Diabetes Mellitus বা ইনসুলিনের উপর নির্ভরশীল ডায়াবেটিস। একে Type-1 Diabetes Mellitus বা প্রথম শ্রেণীর ডায়াবেটিস নামেও ডাকা হয়।
দ্বিতীয়ত, এমন কিছু ব্যাপার আছে যখন কোষের ইনসুলিন যার সাথে বন্ধন করে সেই ইনসুলিন রিসেপটর (Receptor) ইনসুলিনের প্রতি তার সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলে। ইনসুলিনের প্রতি আকর্ষণ কমে যায়। ফলে ইনসুলিনের সাথে ইনসুলিন রিসেপটরের বন্ধন হয় না। কোষেও গ্লুকোজ ঢুকতে পারে না। এদের দেহে কিন্তু পর্যাপ্ত ইনসুলিন বর্তমান থাকে। ব্যাপারটা এমন যে, চাবি থাকা সত্ত্বেও আপনি দরজা খুলতে পারছেন না। কারণ তালা কাজ করছে না। এ ধরনের ডায়াবেটিসকে বলে Insulin Independent Diabetes Mellitus বা ইনসুলিন অ-নির্ভরশীল ডায়াবেটিস। এদেরকে Type-2 Diabetes Mellitus-ও বলা হয়।
এছাড়া আরো কিছু কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মাতৃত্বকালীন ডায়াবেটিস। একে ইংরেজিতে বলা হয় Gestational Diabetes Mellitus। গর্ভবতী নারীদের দেহে স্বাভাবিক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ইনসুলিন প্রয়োজন হয়। কারণ ইনসুলিন মানবদেহে আরো বেশ কিছু কাজে নিয়োজিত। এখন মাতৃদেহ যদি পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদনে অক্ষম হয়ে পড়ে, তাহলে দেহে স্বভাবতই গ্লুকোজ বেড়ে যাবে। গর্ভবতী নারীদের প্লাসেন্টা থেকেও কিছু হরমোন ক্ষরিত হয় যা মাতৃত্বকালীন ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী। এসব নারীদের সন্তান প্রসবের পর আর ডায়াবেটিস থাকে না।
এছাড়া জেনেটিক কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে। অটিজম বা ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম এ আক্রান্ত মানুষের এজন্য ডায়াবেটিসে ভোগার সম্ভাবনা বেশি। পাশাপাশি অগ্ন্যাশয়ের সমস্যার কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে; যেমন: যদি অগ্ন্যাশয়ে ক্যান্সার হয় কিংবা সংক্রমণ হয়, তবে ডায়াবেটিস হতে পারে। হরমোন সমস্যার কারণেও ডায়াবেটিস হতে পারে। কুশিং সিন্ড্রোম বা এক্রোমেগালি, যা থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোনের কারণে হয়ে থাকে, এদের ডায়েবেটিসের উপর প্রভাব আছে। কিছু ঔষধও ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ গ্লুকোকর্টিকয়েড, থায়াজাইড কিংবা ফেনাইটইন জাতীয় ঔষধগুলোর ডায়াবেটিসের কারণ হিসেবে ভূমিকা থাকতে পারে। সাইটো-মেগালো-ভাইরাস, জন্মগত রুবেলা ভাইরাস কিংবা কক্সস্যাকি ভাইরাসগুলোর সংক্রমণ ডায়াবেটিসে প্রভাব ফেলে।
রিস্ক ফ্যাক্টর
পরীক্ষা করে দেখা গেছে কিছু কিছু ব্যাপার ডায়াবেটিস তৈরিতে প্রভাব ফেলে।
১. যাদের বংশে মা-বাবা কিংবা রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়দের ডায়াবেটিস আছে।
২. যাদের শরীরের ওজন অনেক বেশি এবং যারা শারীরিক পরিশ্রম প্রায় করেনই না।
৩. যাদের দেহে উচ্চ রক্তচাপ এবং মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল আছে।
৪. যারা দীর্ঘদিন স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করেন।
লক্ষণ
ডায়াবেটিস রোগীরা যে সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভোগেন তা হলো বার বার প্রস্রাব করা। ফলে শরীরে তরল কমে যায় এবং বেশি বেশি পানি তৃষ্ণা পায়। অপরদিকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের দেহে ‘কোষীয় অনাহার’ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে দেহ মস্তিষ্ককে ক্ষুধা লেগেছে বলে মেসেজ দেয়। এজন্য ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষুধা লেগেই থাকে। প্রচুর খাওয়া সত্ত্বেও তাদের ওজন কমে যায়। সারাক্ষণ ক্লান্তি ঘিরে রাখে। কোথাও ক্ষত তৈরি হলে সহজে সারতে চায় না। বিভিন্ন চর্মরোগের আক্রমণ বেড়ে যায়। আস্তে আস্তে যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায় ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের।
জটিলতা
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের কিডনী আক্রান্ত হয় এবং চুড়ান্ত পর্যায়ে কিডনী অকার্যকর হতে পারে। তাদের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। আস্তে আস্তে স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হয় এবং স্পর্শ ক্ষমতা কমে যায়। রক্ত প্রবাহ বিভিন্নভাবে বাধা পেয়ে হার্ট এটাক, মস্তিষ্কে স্ট্রোক, এমনকি হাত-পায়ে গ্যাংগ্রিনও হতে পারে।
আমেরিকায় প্রতি বছর ডায়াবেটিসে ২ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে আনুমানিক ৭১ লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০৪০ সালে এই সংখ্যাটি বেড়ে ১ কোটি ৩৬ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
প্রতিকার
শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অত্যাবশ্যক। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে চলতে হবে। সেই সাথে ব্যায়াম করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে রক্ত চলাচল সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতা বেড়ে যায়। সঠিকভাবে জীবনযাপন করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ঔষধ এবং ক্ষেত্রবিশেষে ইনসুলিন ইনজেকশন ব্যবহার করতে হয়।
প্রতিরোধ
ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ওজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওজন বেশি থাকলে তা খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের মাধ্যমে কমানো আবশ্যক। চিনি এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে। আঁশ যুক্ত খাবার খাদ্যতালিকায় যুক্ত করতে হবে। একটি খাদ্যতালিকা মেনে চললে সব থেকে ভালো হয়। কোনো ব্যক্তি যদি ইনসুলিন কিংবা অন্যান্য ঔষধ নিয়মিত গ্রহণ করতে থাকে, তাহলে খাবার নিয়মিত খেতে হবে। কেননা কোনো বেলার খাবার বাদ দিলে তার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হতে পারে।
সুষ্ঠু এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। বর্তমানে ডায়াবেটিস ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এজন্য সবার মাঝে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। কারণ সচেতনতাই পারে আমাদের এই বিভীষিকা থেকে দূরে রাখতে।