মানব সভ্যতার ইতিহাসে আগুন আবিষ্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আগুন জ্বালানোর পর থেকে প্রাচীনকালে মানুষ জীব-জন্তুর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে শিখেছে, রপ্ত করেছে খাবার সেদ্ধ করে খাওয়ায় নিয়ম। খাবার সেদ্ধ করার মাধ্যমে খাবারের মধ্যে থাকা ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু মারা যায় এবং তা স্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে। তবে অসাবধানতার ফলে কখনো কখনো এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং তা মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আগুনের ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষের প্রয়োজন সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা। নইলে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা; যা কেড়ে নিতে পারে মানুষের মূল্যবান জীবন। শুধুমাত্র নিজে সচেতন হলেই চলে না কারণ আশেপাশে থাকা ব্যক্তির অসাবধানতার দরুনও হারাতে হতে পারে নিজের জীবনটি। তাই আগুন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতার বিকল্প নেই।
কীভাবে আগুন জ্বলে?
আগুন জ্বলার জন্য মূলত তাপ, অক্সিজেন এবং আগুন জ্বলতে সাহায্যকারী পদার্থ বা দাহ্য বস্তু প্রয়োজন। এই তিনটির সাহায্য ব্যতীত আগুন জ্বলে না। তাই আগুন নিয়ন্ত্রণ কিংবা নির্বাপণের জন্য প্রয়োজন এই তিনটির যেকোনো একটিকে আলাদা করে ফেলা। তবে প্রশ্ন আসতে পারে আমাদের চারপাশে এই জিনিসগুলো সর্বত্র থাকলেও আগুন কেন জ্বলে না?
আমাদের চারপাশে সর্বদা তাপ, অক্সিজেন এবং দাহ্যবস্তু থাকা সত্ত্বেও আগুন না জ্বলার মূল কারণ হচ্ছে এরা জ্বলন বিন্দু বা ইগ্নিশন পয়েন্টে একত্র হতে পারছে না। অর্থাৎ তাপ, অক্সিজেন এবং দাহ্য পদার্থ যখন সঠিক মাত্রায় একই বিন্দুতে মিলিত হতে পারে, তখনই আগুন জ্বলে ওঠে। তবে বিভিন্ন দাহ্য পদার্থের জ্বলন বিন্দু বিভিন্ন রকমের। যেমন কয়লার জ্বলন বিন্দু ৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সহজভাবে বললে ৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপ যদি কয়লার মধ্যে উৎপন্ন হয় এবং সেসময় সেখানে অক্সিজেনের উপস্থিতি থাকে, তাহলে সেখানে আগুন জ্বলবেই। প্রায়ই আমরা বিভিন্ন কয়লা খনিতে আগুন লাগার খবর পাই। এই আগুন লাগার মূল কারণ- সেখানে ৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপে অক্সিজেনের সহায়তায় আগুন জ্বলে ওঠে।
বাসা-বাড়িতে আগুন কীভাবে লাগে?
আগুন যেকোনো স্থানে যেকোনোভাবেই লাগতে পারে। তবে বাসা-বাড়িতে সাধারণত বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট এবং রান্নাঘরের চুলা থেকে বা রান্না করার সময় আগুন লেগে থাকে। এছাড়াও বিভিন্নভাবে যেকোনো সময় আগুন লেগে যেতে পারে। তাই অন্যসব ব্যাপারেও সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগলে কী করবেন?
সাধারণত বৈদ্যুতিক তার যখন পুরনো হয়ে যায়, তখন সেখান থেকে শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া ভোল্টেজ ওঠা-নামার কারণেও অনেকসময় আগুন লেগে যেতে পারে। এক্ষেত্রে দ্রুত আগুন নেভানোর চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই আগুন লেগে গেলে যা করতে হবে-
- আগুন ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তাই নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রথমেই ফায়ার সার্ভিস সেন্টারে কল করুন।
- যদি ছোট কোনোকিছু থেকে আগুনের উৎপত্তি ঘটে, যেমন- টোস্টার, ব্লেন্ডার, রাইস কুকার ইত্যাদি, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে এর বৈদ্যুতিক সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করুন যেন এর মধ্যে নতুন করে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে না পারে। এতে করে আগুন বাড়ার আশঙ্কা কমে যাবে, তবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যেন কোনোভাবেই যেন আপনি নিজে বিদ্যুৎ দ্বারা আক্রান্ত না হন।
- প্রথম কাজটি করতে গিয়ে যদি আপনি ব্যর্থ হন, কিংবা যদি তা নাগালের বাইরে চলে যায়, তাহলে ঘরের বিদ্যুতের যে মেইন সুইচটি আছে, সেটি বন্ধ করার চেষ্টা করুন। তবে যদি বিদ্যুতের মেইন সুইচ যদি যথেষ্ট নিরাপদ হয়, তবেই চেষ্টা করুন। এটি বন্ধ করতে পারলে বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে এবং পরবর্তীতে সহজেই আগুন নেভানো সম্ভব হবে। তবে মেইন সুইচ নাগালের বাইরে চলে গেলে আর চেষ্টা করার প্রয়োজন নেই।
- বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুন লাগলে কখনোই পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করবেন না। কারণ পানির মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এক্ষেত্রে বেকিং সোডা থাকলে তা আগুনের ওপর ঢেলে দিন, কারণ বেকিং সোডা অক্সিজেন অপসারণ করে। বেকিং সোডা না থাকলে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করুন। তবে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রেরও ধরন আছে। ব্যবহারের সময় অবশ্যই সি ক্যাটাগরির অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করুন অথবা ‘এবিসি’ অর্থাৎ যা যেকোনো অগ্নি নির্বাপনের জন্য ব্যবহার করা হয়, সেটি ব্যবহার করুন। ভুল করেও ‘এ’ অথবা ‘বি’ ব্যবহার করবেন না, এতে করে আগুন ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। এবং আগুন নেভানোর পর আগুনের উৎস থেকে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করুন। অন্যথায় মেইন সুইচ বন্ধ করুন।
- আগুন নেভানোর আগেই যদি মেইন বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়, তাহলে যেকোনো ধরনের অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। বিদ্যুতের সংযোগ না থাকার ফলে তখন আগুন নতুন করে ছড়াবে না। অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র না থাকলে মোটা কম্বল কিংবা পুরু অন্য কোনো কাপড় ব্যবহার করতে পারেন অথবা পানি ঢেলে নেভাতে পারেন। তবে এসব ক্ষেত্রে পানির ব্যবহার না করাই ভালো।
- যদি আকস্মিকভাবে আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে যায় এবং তা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, কিংবা আগুনের ধোঁয়ায় আপনার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়, তবে দ্রুত পরিবারের কিংবা বাসার সকলকে নিয়ে ঘর ত্যাগ করুন। বের হবার সময় বাসার দরজা বন্ধ করে বের হবার চেষ্টা করবেন, এতে আগুন ছড়ানোর আশঙ্কা কিছুটা হলেও কমে যায়।
- যদি বের হবার পথেই আগুন লাগে, তাহলে যথাসম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রেখে বিকল্প কোনো পথ দিয়ে বের হবার চেষ্টা করুন। আগুন সাধারণত নিচ থেকে উপরের দিকে ওঠে, তাই নিচ দিয়ে বের হবার ব্যবস্থা না থাকলে ছাদে অবস্থান নিন। যতক্ষণ সম্ভব আগুনের তাপ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।
রান্নাঘরে কিংবা রান্না করার সময় আগুন লাগলে কী করবেন?
সাধারণত তেল বা চর্বি জাতীয় খাবার রান্না করতে গিয়ে অনেক সময়ই কড়াইয়ে কিংবা কুকারে আগুন লেগে যায়। তেল অতিরিক্ত গরম হয়ে গেলে ধোঁয়া ওঠা শুরু করে এবং এক পর্যায়ে আগুন লেগে যায়। তাই এসব রান্না করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করা অতীব জরুরি। তাই আগুন লেগে গেলে প্রথমেই ফায়ার সার্ভিস সেন্টারে কল করুন। এবং আগুন নেভাতে যা করবেন-
- প্রথমেই আগুনের প্রবাহ বন্ধ করার জন্য চুলার তাপ প্রবাহ বন্ধ করে দিতে হবে। এতে করে আগুন ছড়ানোর আশঙ্কা কমে যাবে। তারপর কড়াই বা পাত্র কোনো ধাতব ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন, এতে অক্সিজেন প্রবাহ বন্ধ হয়ে আগুন নিভে যাবে। ঢাকতে গিয়ে কোনো ধরনের সিরামিকের ঢাকনা কিংবা প্লাস্টিক ব্যবহার করবেন না।
- ঢাকনা দিতে না পারলে কিংবা দেয়ার পরও আগুন বাইরে চলে আসলে আগুনের ওপর বেকিং সোডা কিংবা লবণ ঢেলে দিতে পারেন। এগুলো আগুন নেভাতে সাহায্য করে। তবে বেকিং সোডা এবং লবণ ব্যতীত অন্য কিছু কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না।
- এসবের পরও আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসলে ‘বি’ ক্যাটাগরির অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করুন।
- চর্বিযুক্ত খাবার রান্না করার সময় আগুন লেগে গেলে কখনোই পানি দিয়ে তা নেভানোর চেষ্টা করবেন না, এতে আগুন আরও বেড়ে যায়। কোনো ধরনের পাতলা কাপড় দিয়েও তা নেভানোর চেষ্টা করা যাবে না। এতে কাপড়ে আগুন লেগে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
- অনেকসময় আগুন লাগার পর মানুষ পাত্রটিকে হাত দিতে ধরার চেষ্টা করে। এ চেষ্টা কোনোভাবেই করা যাবে না। কারণ এতে হাত পুড়ে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে।
- চর্বিজাতীয় খাবার রান্নার সময় ভারি ধাতব পাত্রে রান্না করার চেষ্টা করুন এবং ধোঁয়া ওঠার সময় পর্যন্ত সামনে থাকার চেষ্টা করুন। কেননা, আগুন মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে যেতে পারে তাই সাবধানতার বিকল্প নেই।
- রান্না করার সময় কখনো কখনো কাপড়ে আগুন লেগে যায়, তাই এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পরিমাণ সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কোনোভাবে কাপড়ে আগুন লেগে গেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে পানি ঢেলে সে আগুন নিভিয়ে ফেলতে হবে।
- যদি আকস্মিকভাবে আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে যায় এবং তা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় কিংবা আগুনের ধোঁয়ায় আপনার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়, তাহলে দ্রুত পরিবারের কিংবা বাসার সকলকে নিয়ে ঘর ত্যাগ করুন। বের হবার সময় বাসার দরজা বন্ধ করে বের হবার চেষ্টা করবেন এতে আগুন ছড়ানো এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা হলেও কমে যায়।
সামান্য পরিমাণ আগুন সময়মতো নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা ছড়িয়ে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। তাই এসব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পরিমাণে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কেননা সবকিছু ছাপিয়ে মানুষের জীবন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিরাপদে বেঁচে থাকতে সাবধানতার বিকল্প নেই।