শহরের ব্যস্ত সড়ক, চলছে শত শত যানবাহন, পাশাপাশি হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখর। এমন রাস্তায় নিশ্চিন্তে, দ্রুতপদে, নিজ গন্তব্যপানে হেঁটে চলেছেন ট্রাউজার আর গাউনের পোশাক পরিহিত এক নারী। যে রাস্তা হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখর, সেখানে দিনে-দুপুরে বিন্দুমাত্র শঙ্কাও ঐ নারীর মনে দোলা দেবার কথা নয়। কিন্তু তাকে বিমূঢ় করে হঠাৎ আবির্ভূত হলো একদল হিংস্র মাঝবয়সী পুরুষ। অন্তত ৫০ জন পুরুষ মুহুর্তেই চারদিক থেকে ঘিরে ফেললো তাকে। শুরু হলো অমানবিক যৌন অত্যাচার। কেউ গাল টিপে দিচ্ছে, কেউ ট্রাউজার টেনে নীচে নামিয়ে নিচ্ছে, কেউ পিঠের দিক থেকে গাউন ছিড়ে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে, কেউ…। বাকিটুকু ভাষায় বর্ণনার অনুপযোগী। পুলিশ এসে ঐ নারীকে উদ্ধার করতে করতে হিংস্র, কামান্ধ পশুর দলের অত্যাচার চললো প্রায় মিনিট বিশেক।
উপরের ঘটনাটি কী পরিচিত লাগছে পাঠক? পরিচিত লাগারই কথা। এমনই ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মতো স্থানে, পহেলা বৈশাখের উৎসবে। তবে উপরের ঘটনাটি বাংলাদেশের নয়। এটি মিশরের কায়রো শহরের ঘটনা। অজানা সেই নারীর গন্তব্য কোথায় তা জানবার প্রয়োজন নেই। তার পরিচয়ও জানবার প্রয়োজন নেই। তবে তার সাথে যে বর্বর ঘটনা ঘটে গেছে, তা জানার প্রয়োজন আছে। কারণ, তার মতো আরো হাজারো মিশরীয় নারীর সাথে তখন এরূপ ঘটনা অহরহই ঘটতো। ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে আবার ফিরে আসবেন কিনা, এই নিশ্চয়তা যে ছিল না তাদের। কারণ তখন মিশর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ‘তাহাররুশ’ নামক এক ভূত, যে ভূত দিনে-দুপুরে, ব্যস্ত রাস্তায়, পুলিশ-প্রশাসনের সামনে মানুষকে রক্তাক্ত করতে পারতো। একটু ভুল হলো বৈকি! ‘মানুষ’ শব্দটি যে এখানে ভুল, তাহাররুশ ভূতের ভয়াল থাবার শিকার ছিল কেবলই নারীরা। সাত থেকে সত্তর বছরের নারীরা!
তাহাররুশ শব্দটি মিশরীয় নারীদের নিকট এক বিভীষিকার নাম। তাহাররুশ একটি আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ হামলা, অত্যাচার। একটি দূরবর্তী অর্থ ‘যৌন হয়রানি’। এই দূরবর্তী অর্থটিই এখন প্রধান অর্থে রূপ নিয়েছে। তাহাররুশ যখন মিশরে সবচেয়ে প্রকট আকারে বিরাজমান, বিশেষত ২০১১-১২ সালের রাজনৈতিক টালমাটাল সময়ে, তখন এর লাগামহীন প্রসারণের জন্য এর নাম হয়ে যায় ‘তাহাররুশ জামাই’ বা ‘গণ যৌন হয়রানি’! মিশরে এর বীজ প্রোথিত হয়েছিল বহু আগেই। বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটে ২০০৫ সালে। আর এই পাশবিক বর্বরতার বীজ ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে একসময় বৃক্ষে পরিণত হয়, যার ডালপালা ২০১১ সালের দিকে কায়রোর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৫-১৬ সালে তো আরবের তাহাররুশ ইউরোপেও সংক্রমিত হয়েছিল খানিকটা!
২০০৫ সালের ২৫ মে। সেদিন মিশরে, সংবিধানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিষয়ক একটি ধারা পরিবর্তনের জন্য সরাসরি গণভোট চলছিল। তবে গণভোটে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে সর্বসাধারণের মধ্যেই ছিল একপ্রকার গুঞ্জন এবং আশঙ্কা। সে আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে সেদিনই ঘটে যায় প্রথম ‘ব্যাপক’ আকারে তাহাররুশের ঘটনা। কায়রোতে গণভোটে অংশগ্রহণ করতে উপস্থিত হওয়া লাখো মানুষের মাঝেই শতাধিক নারী শিকার হন যৌন অত্যাচারের। সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, হঠাৎ করে একের পর এক বাস এসে থামতে থাকে সমাবেশের নিকটে এবং বাস থেকে নেমে আসে শতাধিক মধ্যবয়সী যুবক। তারা সমাবেশস্থলে প্রবেশ করেই পৃথক পৃথক স্থানে নারীদের ঘিরে যৌন নির্যাতন চালায়। অথচ আশেপাশে উপস্থিত ছিল হাজারো ‘নিষ্ক্রিয়’ পুলিশ! এই দিনটি পরবর্তীতে ‘ব্ল্যাক ওয়েনসডে’ বলে পরিচিতি লাভ করে।
মূলত তাহাররুশ আরো আগে থেকেই মিশরে ঘটতো। তবে ২০০৫ সালের আগে তা ছিল প্রায় বিরল। ২০০৫ সালেই প্রথমবারের মতো এই অমানবিক ঘটনাটি প্রকাশ্যে ব্যাপকতা লাভ করে। এর পরের বছরই, অর্থাৎ ২০০৬ সালের ঈদুল ফিতরের দিন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে তাহাররুশ জামাই। সেদিন কায়রোর তালাত হার্ব স্ট্রিটে প্রায় ৫ ঘন্টা যাবত একদল যুবক নারীদের উপর যত্রতত্র হামলা চালায়। সে হামলার শিকার হয় সেদিন ৭ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৭০ বছরের বৃদ্ধাও! ভুক্তভোগীদের মুখে পাওয়া ঘটনার বিবরণও গা শিউরে ওঠার মতো।
প্রতিটি আক্রমণে সাধারণত ২০/৩০ জন হামলাকারী যোগ দেয়, যাদের বয়সও ২০-৩০ এর মধ্যেই। আক্রমণের স্থায়িত্ব কয়েক মিনিট থেকে শুরু করে ঘণ্টাও হয়ে থাকে, নির্ভর করে উদ্ধারকারীর তৎপরতার উপর! হামলাকারীরা প্রথমেই তাদের শিকারকে সঙ্গীর নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় এবং একযোগে ঘিরে ফেলে। এরপরই চারদিক থেকে আক্রমণে কোণঠাসা নারীদেহের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো অনবরত খুঁজে বেড়ায় শত শত হাত! ভীত সন্তস্ত্র, হতবিহ্বল সে নারীর চোখ যখন চারদিকে অজানা-অচেনা মুখগুলোর মাঝে একটু সাহায্য খুঁজে বেড়ায়, তখন তার কানে আসতে থাকে অসংখ্য আশ্বাসবাণী! “তোমার কোনো চিন্তা নেই”, “তুমি আমার বোন, আমি তোমাকে বাঁচাবো”, “এদিকে চলো, আমার সাথে চলো”, “সবাই সরে যাও, রাস্তা করে দাও আমার বোনকে”, আক্রমণকারীরা এরকমই নানান বাক্য ছুঁড়ে দিতে থাকে সে নারীর দিকে। ভড়কে যাবেন না যেন, এই আশ্বাসবাণীগুলোও যৌন নিপীড়কদের একটি কৌশল! একসাথে একাধিক কণ্ঠ যখন একদিকে তার জামা ছিড়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে সাহায্যের কথাও বলছে, তখন সে নারী কেবল অধিকতর হতাশা এবং দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত হন।
আক্রমণকারীদের সবচেয়ে ভয়ানক যে ব্যাপারটি, তা হলো ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার। ছুরি, চাকু, ব্লেড সহ নানা প্রকার ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে তারা ঘেরাও এর মধ্যে থাকা নারীর পোশাক কেটা ফেলার চেষ্টা করে! ভুক্তভোগী আহত নারীদের হাসপাতালে ভর্তির পর দেখা যায় যে, অনেক নারীর যোনি এবং পায়ুপথে পিন, ছোট পেরেক বা পিন সদৃশ কোনো লৌহখণ্ড প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে! ২০০৬-১১ সাল পর্যন্ত অন্তত শতাধিক তাহাররুশের ঘটনা ঘটে মিশরে। তবে বিশ্ব মিডিয়ায় এ ব্যাপারটি প্রথম গুরুত্ব পায় ২০১১ সালেই। সে বছর যে রাতে হোসেনি মোবারকের পতন ঘটে, সে রাত থেকেই পুরো কায়রো জুড়ে তাহাররুশের ঘটনা নাটকীয়ভাবে বাড়তে শুরু করে। শুরুটা হয় আফ্রিকান নারী সাংবাদিক লারা লোগানের উপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে।
আমেরিকান সিবিএস টিভি নেটওয়ার্কের সাংবাদিক লারা লোগান হোসেনি মোবারকের পতনের খবর সংগ্রহ করতে গেলে তার উপর হামলা হয়। পুলিশ এসে উদ্ধার করতে করতে অন্তত ২০০ মানুষ প্রায় ৩০ মিনিট যাবত তার উপর যৌন নিপীড়ন চালায়, যার একটি ভিডিও ইউটিউবে ভাইরাল হয়ে যায়। আর তাতেই আন্তর্জাতিক মিডিয়া সরব হয়ে ওঠে এই ঘৃণ্য যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে। শুধু সেই এক রাতেই নিপীড়কদের আক্রোশের শিকার হয় অন্তত ২০০ জন নারী, যাদের মধ্যে ফরাসি সাংবাদিক ক্যারোলিন শিনজ, ব্রিটিশ সাংবাদিক নাতাশা স্মিথ, মিশরীয় সাংবাদিক মোনা এলতাহাউ, হানিয়া মোহিবসহ ১৮ জন সাংবাদিকও ছিলেন। ২০১২-১৪ সাল পর্যন্ত মিশরে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে তাহাররুশের ঘটনা ঘটে প্রায় ৫ শতাধিক!
২০১৪ সালের ৮ জুন, প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে ঘটে যায় সবচেয়ে পৈশাচিক তাহাররুশের ঘটনা। ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, শতাধিক মানুষ এক বিবস্ত্র নারীর উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। আক্রমণ শুরুর কয়েক মূহুর্তেই ঐ নারীর আবায়া বা বোরকা ছিড়ে ফেলা হয়। চিৎকার করতে করতে মূর্ছা গেলেও সে নারীর উপর আক্রমণ চালিয়েই যায় দুষ্কৃতিকারীরা! তাকে ভিড়ের মধ্য থেকে উদ্ধার করতেও ২০ মিনিট লেগে যায় পুলিশের। গ্রেফতার করা হয় ৭ জনকে। আহত ঐ নারীকে দেখতে সেদিন রাতেই হাসপাতালে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ। পরে তার নির্দেশে ইউটিউব থেকে ঐ ভিডিওটি সরিয়ে ফেলা হয়।
এই ঘটনার পর থেকেই মিশরের নারীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। দিকে দিকে প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়লে গ্রেফতার হতে থাকে অনেক সক্রিয় হামলাকারী। ২০১৫-১৬ সালে তাহাররুশের আদলে কিছু যৌন হামলার ঘটনা ঘটে জার্মানিতে। ফলে ধারণা করা হচ্ছিল, তাহাররুশ ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু সে দেশের সরকার তা শক্ত হাতে দমন করে। ২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির ঘটনাটির সাথেও অনেকে তাহাররুশের সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছেন। ২০১৬ সালের পর মিশরে থেকে তাহাররুশ একরকম বিদায় নিয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক দাবি করেন। প্রতিবাদ, সচেতনতা, নারীবাদী ও নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন সমূহের সক্রিয় ভূমিকা এবং কঠোর আইন, এই ঘৃণ্য অপরাধ বন্ধে সহায়ক হয়েছে বলে তাদের দাবি। ‘শেহেরজাদে’ বা ‘টেল মি আ স্টোরি’ এবং ‘৬৭৮’ এর মতো সচতনতামূলক চলচ্চিত্রও এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।
তাহাররুশ আবার ফিরে আসুক, তা কোনো সুস্থ মানুষই কামনা করবে না। তথাপি, এই অপরাধ প্রবণতা থেকে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষের শেখার আছে অনেক কিছু। নারীদের উপর যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের কারণ হিসেবে আমাদের দেশে প্রায়শই একটি কথা শোনা যায় যে, এসবের পেছনে নারীর পোশাকই দায়ী। কিন্তু মিশরে যে নারীরা বিকৃত কামলিপ্সার শিকার হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই তথাকথিত ‘শালীন’ পোশাক পরিহিত ছিলেন। তারপরও তাদের উপর আক্রমণ স্পষ্টতই বলে দেয়, যৌন হয়রানি নারীর পোশাক নয়, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত।
অন্যদিকে, অনেক বিশ্লেষকের মতে, তাহাররুশের পেছনে গোঁড়াদের প্রবল নারী বিদ্বেষী মনোভাব কাজ করে। নারীরা যেন রাস্তায় বেরিয়ে আসতে ভয় পায় এবং নিজেদের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখে, সে উদ্দেশ্য পরোক্ষভাবে এই অপরাধে মদদ দিয়েছে। এই উদ্দেশ্যে সফল হতে পারলে, তবেই তো নারীদের উপর পুরুষের কর্তৃত্ব বজায় রাখা সম্ভব! আর বিকৃত কামাসক্তি তো আছেই। এ ধরণের অপরাধের সমাধান একটাই, আর তা হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নীতি-নৈতিকতার শিক্ষার প্রসার এবং নারীদের সাহসীভাবে এগিয়ে আসা ও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।
ফিচার ছবি: dnaindia.com