প্রায় শত বছর ধরে পৃথিবীর মানুষ শুধুমাত্র দুটো জিনিসের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে ‘ভালো-খারাপ’ এই শ্রেণীতে ভাগ করে এসেছে। সে দুটি ভিত্তি হলো জিডিপি বা ‘গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্ট’, যার অর্থ একটি দেশ সারা বছর কত অর্থোপার্জন করে। আরেকটা মানদণ্ড হলো সেই দেশের বেকারত্বের হার কেমন, কম না বেশি? এই দুটি মানদণ্ড দিয়ে মোটামুটি চটজলদি একটি মন্তব্য করে দেওয়া যায় যে, দেশটি আসলে উন্নত নাকি অনুন্নত।
সমস্যা হলো, যদি একটি দেশকে বিচার করতেই হয়, তবে শুধু জিডিপির একটি গাণিতিক সংখ্যা দিয়ে দেশটির স্বরূপ জানা, বোঝা যাবে না। বিশেষ করে যখন নাগরিক সুযোগ সুবিধা, নিরাপত্তা, বসবাসযোগ্য পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়গুলো সামনে আসবে তখন জিডিপি ব্যাপারটির কোনো প্রাসঙ্গিকতাই থাকে না।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সামাজিক উন্নতি সূচকের কথা, সামাজিক উন্নতি সূচক নির্ভর করে নাগরিকদের শিক্ষার সহজলভ্যতা, খাদ্য, সাশ্রয়ী মূল্যের বাসস্থানের নিশ্চয়তা ইত্যাদির উপর। এই জিনিসগুলো নিশ্চিতকরণে অনেক সময়ই দেখা যায় যে, উন্নয়নশীল অনেক দেশ অনায়েসেই ধনী, উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে পেছনে ফেলে দেয়।
ফলে একটি কঠিন প্রশ্ন সামনে চলে আসে তা হলো ‘আসলে কী কী বিষয় একটি রাষ্ট্রকে সঠিকভাবে চালিত করে?’ দুর্নীতি দমন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা নাকি শিক্ষার বিস্তার ঘটানো আর স্বল্পমূল্যের চিকিৎসা সেবা দেওয়া? বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এবং সুশাসন নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এ জাতীয় বিভিন্ন প্রশ্নের আলোকে কিছু নীতিমালা তৈরী করেছে একটি ‘উচ্চ কার্যকরী সমাজ’ এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে।
তবে এটা নিশ্চিত ভাবেই জেনে রাখুন যে, শুধু টাকার থলে কত বড় তা দিয়ে দেশটি ভালো না খারাপ তা নির্ধারণের সুযোগ নেই, যদিও টাকা থাকলে নাগরিকদের প্রাপ্য সুবিধাগুলো দিতে অনেকাংশে সুবিধাই হয়। তাই Social Progress Index এর প্রধান নির্বাহী মাইকেল গ্রিন বলেছেন, “মোটামুটিভাবে বলতে গেলে ধনী রাষ্ট্রগুলোর সামাজিক উন্নতির উচ্চধারা আছে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পারলে ব্যাপারটা খারাপ হয় না। কিন্তু আমরা গবেষণায় এটাও পরিষ্কার দেখেছি যে, সামাজিক উন্নতি শুধু অর্থনৈতিক উপাদান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, জিডিপিই শেষ কথা নয়।”
সামাজিক উন্নয়ন সূচক হলো এমন একটি সূচক যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সামাজিক অবস্থার তথ্যের সমষ্টি। এসব তথ্যের মূল বক্তব্য একটাই, তা হলো একটি দেশ কিভাবে তার নাগরিকদের সেবা করছে। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বের নানা দেশের সামাজিক উন্নয়ন সূচকের অবস্থান দেখে আমেরিকার মতো উন্নত দেশের নাগরিকদেরও মনে হতে পারে যে, “আজই ডেনমার্ক বা নিউজিল্যান্ডে চলে যাই।”
ডেনমার্ক থেকে নিউজিল্যান্ড- সমাজটা কেমন?
ইউরোপের নরডিক রাষ্ট্রগুলো বরাবরই সামাজিক নিরাপত্তায় এগিয়ে। তার মধ্যে ডেনমার্ক আবার তার প্রতিবেশী ফিনল্যান্ড, সুইডেনের থেকেও এগিয়ে। ২০১৭ সালে ডেনমার্ক ‘নাগরিক মৌলিক চাহিদা’ যোগানে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছে, যার মধ্যে আছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি।
ডেনমার্কের প্রতিটি নাগরিকের কাছেই (তার আর্থিক অবস্থা যা-ই হোক না কেন) স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা এবং শিক্ষা খুবই সহজলভ্য। ছাত্ররা সহজেই সরকারের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা পেয়ে থাকে। সামাজিক ব্যবস্থাটা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, একজন কর্মী অসুস্থ হলে শুধু একটি ফোনকল করেই ছুটি নিতে পারেন, এজন্য তাকে কোনো দরখাস্ত করতে হয় না।
অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড পাশাপাশি দেশ হলেও দুই দেশের সামাজিক অবস্থা, নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদিতে রয়েছে প্রচুর পার্থক্য। নিউজিল্যান্ডই ১৮৯৩ সালে প্রথম নারীদের ভোটাধিকার দিয়েছিলো। নিউজিল্যান্ডের যেকোনো নাগরিক ৬৫ বয়স হলেই সরকার থেকে ভরণপোষণ পেয়ে থাকেন। তাদের কারো উপর নির্ভর করতে হয় না। শিক্ষা, চিকিৎসা সব কিছুতে নিশ্চয়তা তো রয়েছেই।
এসব সূচকের প্রয়োজনীয়তা কী?
নানা ধরনের সূচক দিয়ে পুরো বিশ্বের মধ্যে একটি দেশের অবস্থান কোথায় তা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এসব সূচকের সাথে রাষ্ট্রের আর দশটা ব্যাপার জড়ানো থাকে, ফলে দেশটা আদতে কেমন প্রকৃতির তা জানা যায়। জানা যায়, দেশটি কি আগের থেকে উন্নতি করলো, নাকি পিছিয়ে গেলো, না যা ছিলো তা-ই থাকল। ঠিক তেমনি দেশটি ভবিষ্যতে কেমন করবে, ১০ বছর পরে দেশটি কোথায় গিয়ে পৌঁছবে সেসব ভবিষ্যদ্বাণীও করা হয়। যেমন- বিজনেস ইনসাইডারের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ আগামীতে বাণিজ্যে ‘এশীয় বাঘ’ এ পরিণত হবে, এটাও নানা সূচকের উপর নির্ভর করে করা ভবিষ্যদ্বাণী।
‘উন্নত দেশ’ হতে টাকার সম্পর্ক কী?
যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরা যাক। জিডিপির সূচক হিসেবে এটি বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের একটি, কিন্তু সামাজিক উন্নতির সূচকের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতিবেশী কানাডার ধারেকাছেও তারা নেই। এ কারণে অভিবাসীদের অধিকাংশেরই এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় যাওয়ার ঝোঁক বেশি, যার অবস্থান বিশ্বে ১৮ তম।
আবার বেকারত্বের হারের দিকে বিচার করার ব্যাপারটাও দেখা যাক। গত একশ বছর ধরেই বেকারত্বের হারের উপর ভিত্তি করে উন্নত-অনুন্নত নির্ধারণ করা হতো। তেমনটাই তো স্বাভাবিক, কারণ চাকরির টাকা মানুষের জীবনমান উন্নত করে। কিন্তু এই ধারণা এখন আর কাজ করছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের গবেষণায় বেকারত্বের হারের সাথে সামাজিক উন্নতির কোনো সম্পর্ক খুঁজে পায়নি। কারণটা হলো চাকরি পেলেও গত কয়েক দশকে কাজের ধরণ পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় সব কাজ এখন জীবনমান উন্নত করার মতো ক্ষমতা রাখে না।
‘আইনের শাসন’ আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উন্নত রাষ্ট্র তৈরীতে। আইনের শাসনের মূল অর্থ হলো সরকারের জবাবদিহিতা, মানবাধিকার সংরক্ষণ, ন্যায্য ও আইনগতভাবে সকল কাজ সমাধা হওয়া। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, World Justice Index এর ২০১৬ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, আইনের শাসন ভালো থাকলে দেশের সামগ্রিক উন্নতি তো হয়ই, পাশাপাশি মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে, স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি হয়েছে এবং গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাপারটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও এর থেকে উন্নত রাষ্ট্র গঠনে আইনের শাসন কী কী ভূমিকা রাখে তা বোঝা যায়।
পাশাপাশি আইনের শাসন ভালো হলে দেশে অপরাধ প্রবণতা কমে যায়। ফলে দেশের সামাজিক জীবনে স্বস্তি থাকে এবং মানুষের নিরাপত্তাবোধ বাড়ে, ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি হয়। অর্থাৎ একটি শক্ত আইনী কাঠামো দেশের উন্নতির জন্যে দরকারী।
সুশাসনের ভূমিকা
একটি বিষয় নিশ্চিতভাবে জেনে রাখুন, আপনি এসব সূচককে গুরুত্ব সহকারে নিন বা না নিন, এগুলোকে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ, নামীদামী প্রতিষ্ঠান সবাই বিবেচনায় রাখে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেমন তাদের নীতি নির্ধারণে ‘সামাজিক উন্নয়ন সূচক’কে কাজে লাগাচ্ছে। ঠিক একইভাবে ডিজনি কর্পোরেশন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ‘World Governance Index’ এর সাহায্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কোন দেশে তারা তাদের পণ্য উৎপাদনের জন্য কারখানা তৈরী করবে।
সবশেষে, যে সিদ্ধান্তে আসা যায় তা হলো আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি মূলত দুটি জিনিস একটি দেশ কেমন তা নির্ধারণ করে- সামাজিক উন্নতির গতি প্রকৃতি আর সুশাসন। আগে বোঝার চেষ্টা করুন, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সেবা দিতে কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং কত দৃঢ়ভাবে সে প্রতিজ্ঞা তারা পালন করে। শুধু কংক্রিটের কাঠামোই উন্নতি নয়, বরং সুশাসন না থাকলে সে কংক্রিটের কাঠামো বোঝাতেও পরিণত হতে পারে। World Governance Index এর অর্থনীতিবিদ আর্ট ক্রের মতে, “একবার সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে স্থিতিশীল একটি উন্নত দেশ তৈরী হওয়ার পথে কোনো বাধাই থাকে না, কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাটাই খুব কঠিন কাজ।”
ফিচার ছবি- thedialogue, Alex Wong