মধ্যম মাত্রার একটা ভূমিকম্প হলেই ঢাকা পরিণত হবে মৃত্যুপুরীতে- এরকম সতর্কবার্তা আমরা প্রায়ই শুনি। এ ধরনের সতর্কবার্তা শুধু টেলিভিশনের টকশোতে উপস্থিত বক্তাদের কথার কথা না। দেশের নামকরা স্থপতি, প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গরা আছেন এই তালিকায়। তারা ছাড়াও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও বিভিন্ন সময় এ ধরনের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন।
এক হিসেব অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে মাত্র ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলেই ঢাকা শহরের প্রায় ৭৮ হাজার ভবন পুরোপুরি ধ্বসে পড়বে। অন্য এক হিসেব অনুযায়ী, ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে ঢাকা শহরে নিহত হবে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ, আহত হবে আরও অন্তত ২ লাখ মানুষ।
এই আশঙ্কাগুলোর কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু তারপরেও আমরা বাড়ি বানানোর সময় বিল্ডিং কোড না মেনে, প্রয়োজনীয় জায়গা ছাড় না দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতিতে বাড়ি নির্মাণের মাধ্যমে আমরা যেন নিজেদের মৃত্যুপরোয়ানায় নিজেরাই সই করি। আমাদের চিন্তাভাবনা প্রায় সময়ই হয় এরকম- “কই, সবই তো ঠিকঠাক চলছে, বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ তো হচ্ছে না!” যথেষ্ট ঝুঁকি থাকার পরেও এই যে অনাগত বিপদকে গুরুত্ব না দিয়ে সবকিছুকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখার প্রবণতা, একেই বলা হয় নরমালসি বায়াস (Normalcy Bias) বা নরমালিটি বায়াস।
এই বায়াস মানুষের প্রকৃতিগত সমস্যা। এটি এমন এক মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, যেখানে কোনো বিপর্যয় ঘটার আগ পর্যন্ত, এমনকি বিপর্যয়ের শুরুতেও মানুষ সেটার প্রকৃত ব্যাপ্তি এবং নিজেদের জানমালের উপর তার প্রভাবকে অবমূল্যায়ন করে। তাদের কাছে মনে হয়, যেহেতু এ ধরনের বিপর্যয় অতীতে ঘটেনি, তাই ভবিষ্যতেও ঘটবে না।
মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাগুলোর মধ্যে নরমালসি বায়াস অনেক বেশি ক্ষতিকর। এর কারণে যথেষ্ট লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও মানুষ কোনো বিপর্যয় ঘটার আগে পুরোপুরি প্রস্তুতি নেয় না। ফলে অনেক সময়ই তাকে এর প্রায়শ্চিত্য করতে হয় নিজের জীবন দিয়ে।
নরমালসি বায়াস কেন ঘটে তার কয়েকটি ব্যাখ্যা আছে। কিছু কিছু বিজ্ঞানী একে বিবর্তনবাদের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তাদের ব্যাখ্যা অনেকটা দুই বন্ধু এবং ভালুকের আক্রমণের গল্পের মতো। প্রকৃতিতে শক্তিশালী শিকারী প্রাণীর আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার জন্য মাঝে মাঝে নিশ্চল ভূমিকা বেশ ভালো কাজ দেয়।
অনেকে এই বায়াসকে মানুষের ঝুঁকি নেওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা হিসেবেই ব্যাখ্যা করেন। মানুষ সব সময়ই বিপদকে অগ্রাহ্য করে সামনে ছুটে যায়। তারা দুর্গম পাহাড়ে চড়ে, ষাঁড়ের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে, বিপজ্জনকভাবে মোটর সাইকেল বা রেসিং কার চালায়, রোলার কোস্টারে চড়ে। সেরকমই বিপদ হবে জেনেও তারা সেই বিপদকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে। ‘যখন ঘটবে তখন দেখা যাবে’- এরকম একটা মনোভাব পোষণ করে।
বিপদে পড়ার পরেও মানুষ অনেক সময় নরমালসি বায়াসের আচরণ করে, এর কারণ হিসেবে আরেকটি ব্যাখ্যা আছে মানুষের মস্তিষ্কের কাজ করার প্রক্রিয়ার মধ্যে। আগে থেকে ধারণা না থাকলে সাধারণভাবে মানুষ নতুন কোনো তথ্য প্রক্রিয়া করতে ৮ থেকে ১০ সেকেন্ডের মতো সময় নেয়। বিপদের মুখে অতিরিক্ত মানসিক চাপে এই প্রক্রিয়া আরো বিলম্বিত হয়ে যায়। মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়লে সবকিছু বুঝে উঠতেই সময় লেগে যায় অনেকটা, তাতে যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়। তখন আর কিছু করার থাকে না বলেই মস্তিষ্ক অনেকটা হাল ছেড়ে দেয়।
তবে কারণ যেটাই হোক না কেন, আমাদের আশেপাশের অধিকাংশ মানুষই নরমালসি বায়াসের শিকার। এক হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ নরমালসি বায়াসে আক্রান্ত হয়েছে। বাকি ৩০ শতাংশের মধ্যে অর্ধেক বিপদের মুখে আতঙ্কিত হয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কেবলমাত্র ১৫ শতাংশই ঠাণ্ডা মাথায় যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার পাশাপাশি ইতিহাসেও এর বেশ বড় কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। ৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ভিসুভিয়াস পর্বত থেকে সৃষ্ট অগ্নুৎপাতের কারণে পম্পেই নগরী পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। নিহত হয়েছিল এর প্রায় ১৬ হাজার অধিবাসী। কিন্তু এই আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হঠাৎ করে ঘটেনি। চূড়ান্ত বিস্ফোরণের আগে যে কয়েক ঘণ্টা ধরে লাভার উদগীরণ দেখা যাচ্ছিল, তাতে শহরবাসীর নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট সময় এবং সুযোগ ছিল। কিন্তু কারণে তারা সেটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি।
এর আরেকটি বড় উদাহরণ হলো হলোকাস্ট বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের উপর চালানো গণহত্যা। নাৎসিবাহিনী হঠাৎ এক সকালে ইহুদিদেরকে নির্মূলের সিদ্ধান্ত নেয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই ইহুদিদের উপর তাদের বিদ্বেষের লক্ষণ ফুটে উঠছিল। তারা ইহুদিদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তাদেরকে ভিন্ন আইডি কার্ড সাথে রাখতে বাধ্য করা হয়েছিল, বাহুর উপর হলুদ রংয়ের তারকা চিহ্নবিশিষ্ট ব্যাজ পরতে বাধ্য করা হয়েছিল।
সোজা কথায়, মানুষ হিসেবে তাদের সকল অধিকার একে একে হরণ করে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও লাখ লাখ ইহুদি বিপদের মাত্রা অনুমান করতে না পেরে পোল্যান্ডসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে রয়ে গিয়েছিল। নরমালসি বায়াস থেকে যদি সে সময় মানুষ মুক্ত হতে পারতো তাহলে হয়তো হলোকাস্টে ক্ষয়ক্ষতিও অনেক কম হতো, বিশ্বের ইতিহাসও হতো অন্যরকম।
এই বায়াস ক্ষতিকর হলেও এর বিপরীতে যে কিছু মানুষ বিপদে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, সেটাও কোনো সমাধান না। অথবা নরমালসি বায়াসের শিকার মানুষেরা যেরকম বিপদ দেখেও না দেখার ভান করে, তার বিপরীতে কেউ যদি সামান্যতম বিপদের সম্ভাবনা দেখামাত্রই সেটার প্রতিকার করার উদ্যোগ নিতে শুরু করে, তাহলে পৃথিবীতে টেকাই তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেটা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে বিপদের সম্ভাবনা, বিপদের মাত্রা সম্পর্কে অনুমান করা এবং সে অনুযায়ী আগে থেকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
নরমালসি বায়াস এড়ানোর প্রথম ধাপ হচ্ছে আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে, ঘটনাবলি সম্পর্কে এবং ইতিহাস সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখা। ভূমিকম্পে কী ভয়াবহ ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, এটা জানা না থাকলে অনেকে বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেবে না। কিংবা ভূমিকম্প ঘটনার সময় বা পরে কী করতে হয়, সে সম্পর্কে ভালো জ্ঞান না থাকলেও অনেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হাল ছেড়ে দিতে পারে। তাই কোন পরিস্থিতিতে কী ধরনের বিপদ ঘটতে পারে, সেই বিপদের মাত্রা কতটুকু হতে পারে, তাতে কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে এবং তা থেকে সম্ভাব্য স্বল্প খরচে এবং স্বল্প প্রচেষ্টায় কীভাবে মানুষ উদ্ধার পেতে পারে, এসব বিষয়ে ভালো ধারণা রাখাই হচ্ছে নরমালসি বায়াস থেকে বাঁচার প্রথম শর্ত।
একইসাথে নরমালসি বায়সজনিত বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের বিধি-নিষেধকে গুরুত্বের সাথে নেওয়ার অভ্যাস তৈরি করা উচিত। কোনো সরকারের দেশ পরিচালনায় বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, ব্যর্থতা থাকতে পারে, কিন্তু তারা যখন ভূমিকম্প বা সাইক্লোন থেকে বাঁচার জন্য সতর্কবার্তা বা দিক নির্দেশনা দেয়, তখন নিজেদের জীবনের স্বার্থেই সেটাকে গুরুত্বের সাথে নেওয়া উচিত।
বিল্ডিং কোড মেনে একটি বাড়ি বানাতে গেলে হয়তো কয়েক লক্ষ টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে, ভবনের সামনে-পেছনে নির্ধারিত জায়গা ছেড়ে দিলে হয়তো রুম একটা কম হবে, কিন্তু ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ডের সময় হয়তো এই ছাড়ের বিনিময়েই আপনার মূল্যবান জীবন বেঁচে যেতে পারে। এসব কিছুর চেয়ে নিশ্চয় আপনার জীবনের মূল্য বেশি।