গর্ভধারণ প্রতিটি নারীর জন্য এক ঐশ্বরিক অনুভূতি। যখন আপনি গর্ভধারণ করেন, আপনার স্বাস্থ্য ও পুষ্টি এই দুইটি বিষয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ গর্ভাবস্থায় আপনি কেবল মাত্র নিজের জন্য সুস্থ থাকেন না বা সঠিক পরিমাণ পুষ্টি গ্রহণ করেন না, আপনি আপনার গর্ভের সন্তানের জন্যও প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে নিজের সুস্থতা নিশ্চিত করেন। এই সময়টায় আপনার দরকার পর্যাপ্ত ভিটামিন, মিনারেলস, ক্যালসিয়াম ও নিউট্রিশন আপনার পেটের ভেতরের একদম নতুন মানব শিশুটির জন্য। গর্ভাবস্থায় আপনি যদি স্বাস্থ্যকর ডায়েট প্ল্যান অনুসরণ করতে চান, জুসিং হবে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি।
গর্ভাবস্থায় জুস খাওয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ?
হবু মায়েদের জন্য তাজা ফল ও সবজি খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু গর্ভাবস্থায় সব সময় ফল বা সবজি খাওয়া সহজ হয় না। অনেকের ফল খেতে গেলেই বমিভাব দেখা দেয়, আবার অনেকের দীর্ঘ সময় ধরে ফল বা সবজি চিবিয়ে খাওয়ার মতো ইচ্ছেই থাকে না। কিন্তু গর্ভবতী মা ও তার অনাগত সন্তানের জন্য এই সবজি ও ফল গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে এসব ফল ও সবজি জুস বানিয়ে পান করা অনেকটাই সহজ। এতে করে প্রয়োজনীয় সব নিউট্রিশনও পাওয়া যায়, আর হবু মা এবং গর্ভের সন্তান উভয়ের জন্য দরকারি পানীয় চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়।
গর্ভাবস্থায় মায়েদের জন্য উপকারী যে জুসগুলো
প্রতিদিন আপনার পছন্দ অনুযায়ী তাজা ফল ও সবজির জুস বানিয়ে পান করতে পারেন। আজ এই লেখায় গর্ভবতী মায়েদের জন্য উপকারী ৮টি জুস নিয়ে বিস্তারিত বলবো।
গাজরের জুস
গাজরে প্রচুর পরিমাণে আয়রন, বিটা-ক্যারোটিন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন এ, বি, ই এবং অন্যান্য আরও প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান রয়েছে, যা গর্ভবতী মায়েদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। গাজরের পুষ্টিগুণ অনাগত শিশুর চোখের দৃষ্টিশক্তি উন্নয়ন করার একটি দুর্দান্ত উপায়। এই জুস হবু মায়ের যকৃত পরিস্কার রাখে এবং শরীরের সমস্ত টক্সিন পরিস্কার করতে সাহায্য করে। শুধু এই নয়, গাজরের জুস গর্ভবতী মায়ের হজম শক্তি বৃদ্ধি, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, রক্তে শ্যুগারের পরিমাণ সঠিক রাখার পাশাপাশি মা ও শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গাজরের ভিটামিন এ এবং ই উপাদান গর্ভবতী মায়ের ত্বকের সুস্থ ও উজ্জ্বল রাখে। এছাড়াও গাজরের জুস অতিরিক্ত চুল পড়ার সমস্যা কমিয়ে আনে। তবে মনে রাখতে হবে, দিনে এক গ্লাসের বেশি গাজরের জুস পান করা যাবে না।
শসার জুস
শসা ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফাইবার, মিনারেলস ও ফলেট সমৃদ্ধ যা গর্ভবতী নারীর সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে দারুণ উপকারী। উচ্চ ফাইবার ও লো-ক্যালোরি সমৃদ্ধ এই সবজি গর্ভাবস্থায় মায়ের জন্য সঠিক ওজন প্রদান করতে সাহায্য করে। শসার মিনারেলস ও সোডিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। যেহেতু গর্ভাবস্থায় পেট ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে, শসার স্কিন টাইটেনিং উপাদান এমতাবস্থায় গর্ভবতী মায়ের জন্য অত্যধিক প্রয়োজনীয়। এছাড়া গর্ভকালীন দাঁত ও মাড়ির নানাবিধ সমস্যার প্রতিরোধে শসার জুস উপকারী।
জুস করার জন্য গাঢ় রঙ এবং দৃঢ় দেখে শসা বাছাই করুন। প্রয়োজনে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন নিয়মিত শসার জুস পান করার ক্ষেত্রে।
কমলার জুস
কমলাকে ভিটামিন সি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের পাওয়ার হাউজ বলা হয়, যা কিনা হবু মা ও গর্ভের সন্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কমলার জুসের ভরপুর পুষ্টি উপাদান গর্ভাবস্থায় ফ্লু ও ঠাণ্ডার প্রাকৃতিক প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। খনিজ পদার্থ শোষণ বৃদ্ধি করতে লোহা সমৃদ্ধ খাবারের সঙ্গে কমলা জুস পান করুন।
কমলার অন্যতম উপাদান ফলেট (Folate) শিশুর জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ করে এবং প্রথম ত্রৈমাসীর সময় এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি মায়ের গর্ভের ক্রমবর্ধমান শিশুর টিস্যু, লাল রক্তকোষ ও প্লাসেন্টা গঠনে এবং উন্নয়ন করতেও সহায়তা করে। কমলার জুস বুক জ্বালা পোড়ার কারণ হতে পারে, তাই অতিরিক্ত কমলার জুস পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আপেলের জুস
গর্ভাবস্থায় এক গ্লাস আপেল জুস আপনাকে রিফ্রেশ করার পাশাপাশি গর্ভকালীন ও পরবর্তীতে অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে। আপেল উচ্চ আয়রন সমৃদ্ধ একটি ফল, যা গর্ভবতী মায়ের রক্তস্বল্পতা দূর করে। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে যে, আপেল গর্ভের ভ্রুণের মস্তিষ্কের উন্নয়নশীলতা বাড়িয়ে তোলে। আপেলের রস ক্যালসিয়ামের একটি সমৃদ্ধ উৎস, যা ভ্রুণের হাড়ের সঠিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ। নিয়মিত আধা গ্লাস আপেলের জুস গর্ভবতী মায়ের নিদ্রাহীনতা কমায়।
তবে মনে রাখবেন, অনেক সময় অতিরিক্ত জুস গ্রহণের ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস আক্রান্ত মায়েদের জন্য অতিরিক্ত কমলার জুস গ্রহণ করার ফলে অবাঞ্ছিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। আধা গ্লাস আপেলের জুসের সাথে পানি মিশিয়ে পান করা বেশিরভাগ হবু মায়েদের জন্য নিরাপদ।
লেবুর জুস
লেবু প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন সহ আরও অনেক পুষ্টি সমৃদ্ধ একটি ফল। এসব পুষ্টি উপাদান গর্ভবতী মা ও গর্ভের সন্তান উভয়ের জন্য ভীষণ দরকারি। লেবুর জুস পান করার ফলে প্রাকৃতিকভাবে মর্নিং সিকনেস সহ বমিভাব প্রতিরোধ করা সম্ভব। গর্ভাবস্থায় লেবুর জুস জ্বর, ঠাণ্ডা ও ফ্লুর মতো শারীরিক সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করে। লেবুর রসে উপস্থিত মিনারেল, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক ও ফলেট ভ্রুণের হাড়ের গঠন ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। লেবুর জুস প্রস্তুত করতে তরতাজা লেবুর ব্যবহার করা উত্তম।
বিটরুট জুস
গর্ভাবস্থায় বিটরুট জুস ইনস্ট্যান্ট এনার্জি বুস্টারের কাজ করে। বিটরুট আয়রনে পরিপূর্ণ থাকে, যা হবু মায়েদের রক্তস্বল্পতা দূর করে। এই সবজি ফাইবারে পরিপূর্ণ, যার ফলে গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের হজম শক্তি বৃদ্ধি করার সাথে সাথে কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যারও সমাধান করে। এই বিটরুটের জুস পান করলে তা শরীরের সমস্ত টক্সিন দূর করে রক্ত শুদ্ধ করে।
যদিও বিটরুটের অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে, তা সত্ত্বেও অতিরিক্ত পরিমাণে এই জুস গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি এর সাথে আরও অন্য সবজি যোগ করে পান করা হয়। যেমন গাজর আর বিটরুট এক সাথে জুস করে পান করা উত্তম। প্রয়োজনে কিছুটা পানিও যোগ করতে পারেন, যদি জুস কিছুটা কড়া অনুভূত হয়।
নারিকেলের পানি
নারিকেলের পানি স্বাস্থ্যকর ও ফ্যাট ফ্রি, যা গর্ভাবস্থায় আপনাকে ফুরফুরে রাখবে। নারিকেলের পানি প্রাকৃতিকভাবে শরীরকে হাইড্রেটেড ও চাঙ্গা রাখে। ইলেক্ট্রোলাইটের (Electrolytes) উপস্থিতির কারণে নারিকেলের পানি ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধে সাহায্য করে। এমনকি নারিকেলের পানি বুক জ্বালা পোড়ার প্রাকৃতিক প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। জিরো কোলেস্টেরলের কারণে নারিকেলের পানি শরীরের অতিরিক্ত ওজন বাড়াতে বাধা প্রদান করে।
পেয়ারার জুস
গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা দূর করতে পেয়ারার তুলনা হয় না। এক গ্লাস পেয়ারার জুস প্রস্তুত করতে দুইটি পেয়ারা, দুই টেবিল চামচ চিনি, কয়েক ফোঁটা লেবুর রস এবং সামান্য আদার রস লাগবে। একটু পানিতে পেয়ারা দুইটি ভালোভাবে সিদ্ধ করে নিয়ে ঠাণ্ডা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এরপর লেবু ও আদার রস সহ ব্লেন্ডারে জুস করে এতে চিনি ও বরফের টুকরা মিশিয়ে পান করুন।
গর্ভবতী মায়েদের উচিৎ সব সময় সুস্থ ডায়েট অনুসরণ করা। সুষম খাদ্য গ্রহণ করার পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঘুমানো ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। এখানে উল্লেখিত সবগুলো ফল ও সবজি হবু মা আর তার গর্ভের সন্তানের জন্য উপযোগী এবং এতে উপস্থিত সব পুষ্টি উপাদান মা ও শিশুর জন্য অপরিহার্য। তারপরেও বলে রাখা ভালো, নিয়মিত এসব জুস গ্রহণ করার আগে একবার আপনার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নেবেন অবশ্যই।