পরনিন্দা যখন বুমেরাং
বুমেরাং হচ্ছে একধরনের অস্ত্র যা হাওয়ায় ভাসিয়ে মারতে হয়। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে অস্ত্রটি আবার যিনি ছুঁড়েছেন তার হাতেই ফিরে আসে। এটি খুবই বিখ্যাত প্রাচীন অস্ত্র। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের একটি উপন্যাসে লালমোহনবাবু এই বুমেরাং ব্যবহার করেছিলেন। পরনিন্দা হচ্ছে অন্যের ব্যাপারে যা-তা কুৎসা রটিয়ে বেড়ানো। ধরা যাক, কোনো একজন লোক এমন চরিত্রের যিনি অন্যের অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে খারাপ কথা বলে বেড়ান সবার কাছে। তিনি মনে করেন, সবার সামনে কিছু লোককে বাজেভাবে উপস্থাপন করতে পারছেন এভাবে।
কিন্তু তার এই ধারণা কি সঠিক? অন্তত সাইকোলজির গবেষণা তা বলে না। সাইকোলজি বলে, কোনো ব্যক্তি যদি অন্যের ব্যাপারে খারাপ বিশেষণে কথা বলে থাকেন তাহলে শ্রোতারা ঐসব বিশেষণের সাথে ব্যক্তিটিকেই যুক্ত করে দেখবেন। সব সময় সচেতনে না, অবচেতনেও। যেমন, আপনি আরেকজনের ব্যাপারে আপনার বন্ধুদের বললেন- সে তো চোর, বাটপার আর দুর্নীতিবাজ। আপনার বন্ধুরা এসব বিশেষণের সাথে আপনার চরিত্রকে মিলিয়ে বিচার করবে। আবার আপনি যদি অন্যদের ব্যাপারে ভালো ভালো কথা বলেন তাহলে শ্রোতারা পরবর্তীতে আপনার চরিত্রের সাথেও ঐ ভালো বিশেষণগুলো যুক্ত করে দেখবে। মানুষের সাইকোলজির এই ব্যাপারটিকে গবেষকেরা নাম দিয়েছেন ‘স্পন্টেনাস ট্রেইটস ট্রান্সফারেন্স’। ইংরেজি এই শব্দগুচ্ছের বাংলা করা যায় স্বতঃস্ফূর্ত বিশেষণ স্থানান্তর।
মাঝে মাঝে যেসব রাজনীতিবিদ কথায় কথায় অন্যান্য রাজনীতিবিদকে দুর্নীতিবাজ, প্রতারক ইত্যাদি বলেন, জনগণ কিন্তু ধরে নেয় ব্যক্তিটি নিজেই দুর্নীতিবাজ। সমালোচকদের ক্ষেত্রেও এমন হয় বলে দেখেছেন গবেষকেরা। যেমন: কোনো সমালোচক যদি অন্য লেখকদের মূর্খ, অশিক্ষিত ইত্যাদি বলতে থাকেন, তাহলে পাঠকেরা সমালোচককেও এসব বিশেষণের সাথে যুক্ত করে দেখেন। সুতরাং অহেতুক নিন্দার ব্যাপারে সাবধান। এগুলো বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। অন্যকে ছোট বানাতে গিয়ে আপনি নিজেই ছোট হয়ে যাবেন।
কিন্তু তাই বলে কি ন্যায্য সমালোচনা করবেন না? কেউ চুরি করলে তাকে চোর বলবেন না? কেউ বাজে লিখলে তাকে বাজে লেখক বলবেন না? কেউ দুর্নীতি করলে তাকে দুর্নীতিবাজ বলবেন না? ন্যায্য হলে অবশ্যই সমালোচনা করবেন। এটা সততা। চোরকে চুরি করতে দেখে যে বলে না ঐ ব্যক্তি চোর, এই নীরব থাকা ব্যক্তিও চোরের সহচর বা অংশীদার। তাই ন্যায্য সমালোচনা কাম্য। উপরে অহেতুক নিন্দার কথা বলছি, যা অকারণে করা হয় অন্যকে ছোট করতে। আবার অনেক লোক আছে যাদের স্বভাবই হয়ে যায় আড্ডায় সবসময় অন্যদের ব্যাপারে নিন্দামূলক কথা বলতে থাকা। এগুলো থেকে বিরত থাকা উচিৎ।
এ যেমন কাকতাল
কাকতালীয় শব্দটির সাথে প্রায় সবাই পরিচিত। নাটক-সিনেমার শুরুতে প্রায় সময়ই লেখা থাকে এই গল্পটি যদি কারো জীবনের সাথে মিলে যায় তাহলে তা কাকতালীয়। এই কাকতালীয় শব্দটি এসেছে কাক ও তাল থেকে। একদা এক তাল গাছের নিচে বসেছিল একজন লোক। গাছে ধরেছিল পাকা তাল এবং বসেছিল এক কাক। হঠাৎ কাক উড়ে গেল ও একটি তাল পড়ে গেল। লোকটি ধরে নিতে পারে কাক ওড়ার সাথে বোধহয় তাল পড়ার সম্পর্ক আছে। কিন্তু কাকতালীয় শব্দ দিয়ে বোঝানো হয় আসলে তাল এমনিতেই পড়েছে, কাক এমনিতেই উড়ে গেছে, এ দুটির মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। নাটক-সিনেমার গল্পের ক্ষেত্রেও এমন অর্থ। লেখক নিজ কল্পনা ব্যবহার করে লিখেছেন, আপনার জীবন থেকে কাহিনী নেননি, কিন্তু মিলে যেতে পারে, তবুও মনে রাখবেন আপনার জীবন ও আমাদের গল্পকারের ভাবনা ভিন্ন।
এরকম এক বড় কাকতাল আবিষ্কার করেছিলেন একজন বড় মনোবিজ্ঞানী। তার নাম আইভান পাভলভ। কুকুরদের নিয়ে তিনি গবেষণা করছিলেন। খাবার দিলে তাদের মুখে কী পরিমাণ লালারস জমে এসব ব্যাপার স্যাপার। পাভলভ দেখলেন, তিনি কক্ষে ঢুকলেই তার কুকুরদের মুখে লালা চলে আসছে। এমনকি হাতে খাবার নিয়ে না আসলেও লালা ঝরতে থাকে। ব্যাপার কী তা তিনি বুঝতে চাইলেন। এরপর কুকুরদের খাবার দিতে শুরু করলেন একটি নির্দিষ্ট ঘণ্টা বাজিয়ে। তিনি লক্ষ্য করলেন, ঘণ্টা বাজালেই কুকুরদের মুখে লালা চলে আসে, এমনকী খাবার না দিলেও।
এই পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি দিলেন তার ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং তত্ত্ব। অর্থাৎ কিছু ব্যাপার আছে যা ঘটলে অন্য আরেকটি ঘটনা ঘটে; যেমন, ঘণ্টা বাজলেই কুকুরের মুখে লালা চলে আসে বা লোকে একটি ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনা মিলিয়ে দেখে। এই ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিংয়ের ব্যাপার আমাদের মধ্যেও আছে। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বড় বড় কোম্পানিগুলো তা ব্যবহার করে। যেমন, কোনো আনন্দ উৎসব, খেলাধুলা ইত্যাদিতে যে ব্র্যান্ডগুলো স্পন্সর করে, মানুষেরা তাকে ঐসব ঘটনার সাথে মিলিয়ে দেখে। আবার কোনো শোকের দিন, বড় মানুষের মৃত্যুশোক ইত্যাদিতে যারা স্পন্সর করে, তাদেরকে ঐসব ঘটনার সাথে মিলিয়ে দেখবে মানুষ।
অনেক ক্ষেত্রে আরো মারাত্মকভাবে মেলানো হয়। যেমন, প্রাচীন পারস্যে রাজাদের কাছে খারাপ সংবাদ নিয়ে যেত যে দূত, তাকে মেরে ফেলা হতো। অলক্ষুণে বলে একটি শব্দ প্রচলিত আছে। ঘর থেকে বের হবার পরে একজন লোককে দেখলেন, দেখার পরপরই কলার খোসায় বিরাট এক আছাড় খেলেন। তখন ভাবলেন, ঐ লোকের মুখ দেখে বের হয়েছিলাম, তাই আজ আমার এই দশা। এছাড়া, আগেকার বাংলা ফিল্মে দেখবেন খারাপ সংবাদ নিয়ে আসলে ভিলেন কীভাবে তার দলের লোকদের গুলি করে মারে।
কিন্তু এসব ক্ষেত্রেই আমরা ভুলভাবে বিচার করি। বাস্তবে দুই ঘটনার মিল নেই, এরা কাকতাল মাত্র। যে খারাপ খবর নিয়ে আসছে সে দোষী না। আপনি যদি পারস্যের প্রাচীন রাজাদের মতো এমন হন যে লোকে আপনাকে দুঃসংবাদ দিতে ভয় পায়, তাহলে আপনি কিছু বড় সমস্যায় পড়তে পারেন। ধরা যাক, আপনার ব্যবসা আছে, গুদামে আগুন লেগেছে, কর্মচারীরা দুঃসংবাদ দিতে ভয় পেলে সংবাদ পেতে পেতেই আপনার গুদাম পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে। তাই কোনো প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার হলে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যেন কর্মীরা দুঃসংবাদ আপনার কাছে আগে আগে পৌঁছায়। ওয়ারেন বাফেট তার কর্মচারীদের বলেন, তোমাদের কাজ হলো যত দ্রুত পারা যায় দুঃসংবাদ আমাদের কাছে পৌছে দেয়া। সুসংবাদ নিয়ে ভাববে না। কারণ সুসংবাদ এমনিতেই পৌঁছাবে আমাদের কাছে, দেরীতে পৌঁছলেও সমস্যা নেই।
তাছাড়া, কোনো ব্যবসায়ী না হলেও আপনার এ বিষয়ে নজর থাকলে ভালো। অহেতুক কোনো মানুষকে অলক্ষুণে, অপয়া ইত্যাদি বলার মতো অন্যায় থেকে বিরত থাকতে পারবেন তাহলে। তাতে নিজের লাভও হতে পারে। যেমন, বেশী দাম মানেই ভালো জিনিস এমন একটি ব্যাপার আমাদের মধ্যে আছে। পাভলভের কুকুরের মতো আমরা এটা শিখেছি যে বেশী দাম হলে জিনিস ভালো হয়। আসলেও সাধারণত এমনই হয়। কিন্তু আমাদের এই প্রবণতার সুযোগ নিতে পারে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী। বাড়িয়ে দিতে পারে একটি পণ্যের দাম অন্যটির চাইতে, কেবলমাত্র আমাদের ঠকাতে। এক্ষেত্রে ভালো দাম মানেই ভালো জিনিস এই অন্ধ বিশ্বাস এর চাইতে গুণমান বিচার করে ভালোমন্দ বিচারই শ্রেয়।
ফিচার ছবি- Brandon Robbins/Getty