হৃদয়বিদারক কিংবা ভয়ানক বিমান দুর্ঘটনা তো মাঝে মাঝেই হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ খামখেয়ালিপনা এবং পরিমাপের এককের গণ্ডগোলের জন্য বিমানের সবাইকে অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার ভিতর দিয়ে যেতে হবে, এমন ঘটনা বোধহয় খুব বেশি নেই। ১৯৮৩ সালে এমনটাই ঘটেছিল কানাডার একটি বিমান Air Canada Flight 143 এর ভাগ্যে। ইতিহাসে এই ঘটনা ‘গিমলি গ্লাইডার’ বলে পরিচিত।
দিনটি ছিল ২৩শে জুলাই, ১৯৮৩। Air Canada Flight 143 এডমোন্টন যাচ্ছিলো সেন্ট্রাল কানাডার মন্ট্রিল থেকে। প্রায় ৩ ঘণ্টার ফ্লাইট। ফ্লাইটে ছিল ৮ জন কেবিন ক্রু এবং ৬১ জন যাত্রী। দিনটির আবহাওয়া ভাল ছিল। তাই দুর্ঘটনার জন্য যেমন পরিবেশ প্রয়োজন, আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। তাছাড়া Flight 143 ছিল সেসময়ের আধুনিক বিমানগুলোর মধ্যে একটি। নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং নকশা দিয়ে তৈরি হয়েছিল এটি। সেটি ছিল হোয়াইট বডি ৭৬৭ জেট বিমান। বিমান চালকের আসনে বসে ছিলেন অভিজ্ঞ বব পিয়ারসন এবং তার একজন ফার্স্ট অফিসার। বব পিয়ারসন এর আগে মোট ১৫ হাজার ঘণ্টা আকাশে কাটিয়েছেন এবং তার ফার্স্ট অফিসারের অভিজ্ঞতা ছিল সাত হাজার ঘণ্টার। পিয়ারসনের আবার ছিল গ্লাইডিংয়ের অভিজ্ঞতাও।
প্লেনটি যখন ৩৯,০০০ ফুট উপরে তখন হঠাৎ করেই প্লেনের জ্বালানী কমে যাওয়ার সংকেত শোনা গেল। পাইলট দুজনই অবাক। কারণ, এমন হবার প্রশ্নই আসে না। তারা বিষয়টিতে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। তাদের কাছে মনে হলো, হয়তো এটি ভুল সংকেত। কিন্তু একটু পরে আবার একই সংকেত বাজা শুরু করলো। এবার তাদের দুজনের টনক নড়ল। দুই দুই বার নিশ্চয় এমনি এমনি সংকেত দিচ্ছে না। কোনো সমস্যা নিশ্চয় আছে। তখনও তাদের আরও ৭০০ মাইল পাড়ি দেওয়া বাকি। আরেকটু সময় যেতে যেতে প্লেন এর বাম পাশের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, ফুয়েল প্রায় শেষ! তখন প্লেন শুধু ডানপাশের ইঞ্জিন নিয়ে চলছিলো। পিয়ারসনের কাছে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ফুয়েল ছাড়া প্লেন চালানো তো আর সম্ভব না। তাছাড়া তারা তখন এত ওপরে যে, দুটো ইঞ্জিনই যদি বন্ধ হয়ে যায় তখন বিমান ‘ফ্রি ফল’ করবে, যেটা অবশ্যই ভয়ঙ্কর।
বাম পাশের ইঞ্জিন বন্ধ হবার সময় প্লেন যেখানে ছিল, সেখান থেকে কাছাকাছির মধ্যে এয়ারপোর্ট ছিল উইনিপেগ নামক কানাডার আরেকটি জায়গায়। মাত্র ১২০ মাইল দূরে। এরকম সময়ে কাছাকাছি কোথাও নামাটাই যুক্তিযুক্ত । কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত। এর মধ্যে যদি ডান পাশের ইঞ্জিনও বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এটুকু দূরত্বও অতিক্রম করা সম্ভব না-ও হতে পারে। কিন্তু তাদের মাথায় কোনোভাবেই আসছে না যে এরকম হবার কারণটি কী। কেন এত তাড়াতাড়ি ফুয়েল শেষ হয়ে গেল?
আসল ঘটনা ছিল এমন। মন্ট্রিল থেকে এডমোন্টন আসার আগে এয়ারপোর্টে ফ্লাইট ক্রুরা গ্রাউন্ড ক্রুদের জিজ্ঞেস করে যে, প্লেনে কতটুকু তেল আছে। ফ্লাইট ক্রুরা জানতো যে, তাদের এডমোন্টন যেতে লাগবে ২২,৩০০ কেজি তেল। কানাডা তখন কিছুদিন আগেই মেট্রিক সিস্টেমে পরিমাপ করা শুরু করেছে। আগে তেলের পরিমাণ পরিমাপ করা হতো পাউন্ডে। যা-ই হোক, গ্রাউন্ড ক্রুরা জানালো, ৭,৬৮২ লিটার তেল আছে। তখন ফ্লাইট থেকে জিজ্ঞেস করা হলো, তেলের ক্ষেত্রে লিটার থেকে কেজিতে আনার কনভার্শন ফ্যাক্টর কত। গ্রাউন্ড থেকে উত্তর আসলো, ১.৭৭। তখন ফ্লাইটে হিসেব করে বের করা হলো, তাদের এখন আছে ১৩,৫৯৭ কেজি তেল এবং গ্রাউন্ডে বলা হলো আরও ৪,৯১৭ লিটার যোগ করতে।
আসলে যেখানে সমস্যা হয়েছিল সেটি হচ্ছে- গ্রাউন্ড ফিল্ডের লোকজন ভুল করেছিল। তারা আগের কনভার্শন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলো। ১.৭৭ ছিল আসলে লিটার থেকে পাউন্ডের কনভার্শন ফ্যাক্টর, লিটার থেকে কিলোগ্রামের নয়। তারা অভ্যস্ত ছিল আগের পরিমাপক এককের সাথে। তাই এই বিশাল ভুলের ঘটনাটি ঘটে যায়। আসলে তখন প্লেনে ছিল ৬,১৭২ কেজি ফুয়েল। আরও ২০,০৭৫ লিটার ফুয়েল যোগ করতে হতো। অর্থাৎ মাত্র ৪৫% ফুয়েল নিয়ে প্লেনটি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। অথচ কে জানতো যে, সামনে কী খারাপ সময় অপেক্ষা করছে।
বামপাশের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরে ডানপাশেরটিও বন্ধ হয়ে যায়। দুটি ইঞ্জিনই বন্ধ হয়ে গেলে প্লেনকে আসলে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এ সময় পাইলটের আর তেমন কিছুই করার থাকে না। কারণ, প্লেন তখন নিচে নামতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু ততদিনে আধুনিক একটি প্রযুক্তি চলে এসেছিলো যে, যদি কোনো জরুরী অবস্থা দেখা দেয় তখন প্লেন থেকে Ram Air Turbine (RAT) নামের ছোট একটা যন্ত্র অটোম্যাটিক বের হয়ে আসে। এই প্লেনটিরও শরীরের নিচের দিকে এমন ব্যবস্থা ছিল। সেজন্য প্লেনটিকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিলো। নাহয় প্লেন ফ্রি ফলে নিচের দিকে পরে যেতে থাকতো।
এর মধ্যে আবার আরেক সমস্যা দেখা দেয়। পাইলটরা তাদের কোঅরডিনেট দেখতে পাচ্ছিলো না, কারণ ইঞ্জিন বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে প্লেনের সকল পাওয়ার সাপ্লাই অফ হয়ে যায়। কয়েকটি যন্ত্রে ব্যাকআপ সাপ্লাই থাকে। সেই সময় ঐটুকু পাওয়ার ব্যবহার করেই তারা গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সমস্যার কথা বলেন এবং তাদের কাছাকাছির এয়ারপোর্টের দূরত্ব কত জিজ্ঞেস করেন। গ্রাউন্ড থেকে পাইলটরা তাদের উত্তর পাচ্ছিলেন, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই গ্রাউন্ডের ইঞ্জিনিয়াররাও পাইলটদের আর কোনো লোকেশন দিতে পারছিলেন না। কারণ, রাডার থেকে বিমানটি ততক্ষণে গায়েব হয়ে গিয়েছিলো। কোনোভাবে সেটি শুধু দুই দিক থেকে যোগাযোগ করতে পারছিলো। এই সমস্যা দেখা দেওয়ার পর ভিন্ন পরিকল্পনা হিসেবে গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা পুরনো একটি রাডার ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন। এই রাডারে প্লেন কোথায় আছে জানতে ট্রান্সপন্ডারের প্রয়োজন পড়ে না। এটি একধরনের পুরনো রিফ্লেকটিভ রাডার, যেটিতে পাইলটের সিগনাল ব্যবহার করে প্লেনের অবস্থান বের করা যায়। এভাবে তারা পাইলটদের তাদের অবস্থান বলে যাচ্ছিলেন।
এরপর অভিজ্ঞ বব পিয়ারসন সিদ্ধান্ত নেন, প্লেনকে গিমলি বলে এক পরিত্যক্ত এয়ারপোর্টে জরুরী অবতরণ করানো হবে। গ্রাউন্ডের ফ্লাইট কন্ট্রোল রুমে গিমলি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলো। সেখান থেকে তথ্য এলো, বিমানবন্দরটিতে কোনো কন্ট্রোল রুম নেই, টাওয়ার নেই, এমনকি রানওয়ে মাত্র একটি এবং বেশ ছোট। পিয়ারসন তার প্লেনকে সেই বিমানবন্দরেই নামাবেন বলে ঠিক করলেন। তিনি তার ফার্স্ট অফিসারকে হিসেব করে বের করতে বললেন, এখন যে গতিতে তারা নামছেন এভাবে নামলে গিমলিতে দুর্ঘটনা কতটুকু এড়ানো যাবে। তিনি হিসেব করে জানালেন, যে গতিতে তারা নামছেন এভাবে নামলে রানওয়ে থেকে বাইরে গিয়ে প্লেন ল্যান্ড করবে। এতে বিমানে আগুন লেগে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আবার যদি তারা বিমানের সামনের অংশকে নিচে খাড়াভাবে নামিয়ে দিয়ে ল্যান্ড করতে চান, এতে ভূমি স্পর্শ করার আগের মুহূর্তে প্লেনের যে গতি থাকবে, তাতেও প্লেনের ধ্বংস হবার সম্ভাবনাই বেশি।
এই সময় তারা দুটি সমাধানে আসেন। প্রথমত, প্লেনকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উচ্চতা কমিয়ে এরপর ল্যান্ড করা অথবা সাইড স্লিপ প্রয়োগ করে ড্র্যাগ ফোর্স বাড়িয়ে দেওয়া। এতে গতি অনেকাংশে কমানো যাবে। পরের কাজটি করার মধ্যে ঝুঁকি থাকলেও, গ্লাইডিং করার মাধ্যমে কাজটি করা যেতে পারে। কমার্শিয়াল ফ্লাইটে এমনটি আগে কখনও করা হয়নি। পিয়ারসন প্লেনকে বাম পাশে কাত করে গ্লাইডিং করে করে রানওয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন। এর মধ্যে আবার আরেক কাণ্ড ঘটে গেল। ল্যান্ডিং গিয়ার নামানোর সময় পেছনের দুটি ঠিকভাবে নামলেও সামনের নোজ গিয়ার ঠিকভাবে নামেনি। প্লেনের ইঞ্জিন বন্ধ থাকার জন্য গিয়ারগুলোকে ম্যানুয়ালি গ্রাভিটি ড্রপ করানো হয়েছিল। যার জন্য সামনের নোজ গিয়ার ঠিকভাবে নামানো যায়নি। প্লেন যখন রানওয়ের কাছাকাছি তখন ফার্স্ট অফিসার লক্ষ্য করেন যে, জায়গাটিতে অনেক মানুষের আনাগোনা। আসলে রানওয়েগুলো তখন স্পোর্টস কার রেস প্রতিযোগিতায় ব্যবহার করার হচ্ছিলো এবং সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিলো। জায়গাটা অনেকটা পিকনিক স্পটের মতো বানানো হয়েছিলো। রানওয়ের কাছে এসেই পাইলট দক্ষতার সাথে প্লেনটিকে সোজা করে ল্যান্ড করালেন এবং এর সামনের অংশ মুখ থুবড়ে পড়ল। মূলত এই মুখ থুবড়ে পড়ার কারণেই প্লেনের ঘর্ষণ বেড়ে যায় এবং এর গতি আস্তে আস্তে কমে যায়। তাছাড়া জায়গাটিতে স্টিলের বেরিয়ার দেওয়া ছিল, যার সাথে প্লেনটি লেগে যায় এবং আস্তে আস্তে গতি কমতে থাকে।
এই দুর্ঘটনা থেকে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি গঠন এবং অনুসন্ধান করার পর ধরা পড়ে যে, আসল ঘটনা ছিল ভেতর এবং বাইরের স্টাফদের পরিমাপের এককের গণ্ডগোলের জন্য। এই ঘটনা থেকে এই শিক্ষাই পাওয়া যায় যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত যেকোনো কাজে বৈজ্ঞানিক একক বা ইউনিট ছাড়া যেকোনো সংখ্যাই আসলে অর্থহীন।