রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দুই বাসের মাঝে চাপা পড়ে প্রথমে হাত হারিয়েছিলেন তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজিব হোসেন। দুই বাসের প্রতিযোগিতায় একটি হাত হারালেও আরেকটি হাত তখনো শরীরের সাথে যুক্ত ছিল। হয়তো ভাবছিলেন সে হাতটি দিয়েই বাকি জীবন চালিয়ে নিবেন কোনো রকমে। ছোট দুই ভাইকে মানুষ করলে বাকি জীবন হয়তো তারাই তার দেখাশোনা করবে। তবে খুব বেশি দূর ভাবার সময় পাননি। প্রথমে হাত শরীর ত্যাগ করেছে, তারপর আত্মাকাটা হাত নিয়ে রাজিব চলে গেছেন পরপারে।
রাজিব মারা যান গত ১৬ই এপ্রিল (২০১৮)। তার মৃত্যুর চারদিনের মাথায় আবারো সড়ক দুর্ঘটনা। এবার বাসের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে পা হারান রোজিনা। এক সাংবাদিকের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ ছিল তার। মহাখালি থেকে ফেরার পথে পা হারান। তখনও জানতেন না যে পায়ে ভর করে আর কখনো হাঁটা হবে না তার। রাজিবের মৃত্যুতে তখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব। তাই রোজিনাকে বাঁচাতে চিকিৎসা চলছিল পুরোদমে। আমরা ভেবেছিলাম রাজিব মারা গেলেও রোজিনা এ যাত্রায় হয়তো বেঁচে যাবে। কিন্তু আমাদেরকে মিথ্যা প্রমাণ করে রোজিনাও চলে গেছে না ফেরার দেশে।
এই মৃত্যুগুলোকে বিচ্ছিন্ন মনে হতেই পারে। কিন্তু সবগুলো ঘটনাকে একত্র করে আমরা যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে এগুলোকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন বলার উপায় থাকে না। বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থার সার্বিক চিত্র ফুটে ওঠে রাজিব, রোজিনাদের কাটা হাতে-পায়ে।
বিগত কয়েক বছরের অবস্থা
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যানে বিগত কয়েক বছরের চিত্র অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উঠে আসে। বিগত ২০১৬ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪,৩১২টি। ২০১৭ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪,৯৭৯টিতে। সড়ক দুর্ঘটনা যেখানে কমার কথা, সেখানে বেড়েছে ১৫.৫ শতাংশ। প্রতিদিন ১৩ থেকে ১৪টি সড়ক দুর্ঘটনা আজ যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত এবং নিহতের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫,০৫৫ জন। এক বছরের মধ্যে নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ২২.২ শতাংশ। ২০১৭ সালে নিহতের সংখ্যা ৭,৩৯৭ জন। আহতের সংখ্যাও তুলনামূলক হারে বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে। ২০১৬ সালে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল ১৫,৯১৪ জন আর ২০১৭তে আহত হয়েছে ১৬,১৯৩ জন। বিগত দু বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতির নিয়ম অনুসরণ করে দুর্ঘটনা বাড়ছে ক্রমবর্ধমান হারে। ২০১৭ সালে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ জন মানুষ বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। সাধারণত জাতীয় পত্রিকা, আঞ্চলিক এবং অনলাইনের তথ্যের মাধ্যমে এই পরিসংখ্যানটি তৈরি করে থাকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (সরকারি) হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৭২ হাজার ৭৪৮ জন। আহতের সংখ্যা প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক। সরকারি হিসাবের বাইরে অনেক সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে যেগুলোর খবর কোনো পত্র-পত্রিকায় স্থান পায় না। এরকম হিসাব মিলিয়ে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায় বলে মনে করছে বেসরকারি বিভিন্ন সূত্র। বেসরকারি সূত্র অনুযায়ী প্রতিদিন প্রায় অর্ধশত মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। ঘণ্টায় প্রায় ২ থেকে তিন জন!
সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো নিয়ে রোর বাংলায় বিস্তারিত একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো কী কী?’ শিরোনামে। তাই সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো আর উল্লেখ করলাম না। আগ্রহী পাঠক প্রয়োজনে সেখান থেকে পড়ে নিতে পারেন।
আইন ও তার প্রয়োগ
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার উপর গবেষণা চালিয়েছেন। গবেষণা করে তারা বলেছেন, ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ চালকের বেপরোয়া মনোভাব আর ৫৩ শতাংশ কারণ অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণে গাড়ি চালক দায়ী। এক্ষেত্রে অবশ্যই গাড়ির চালক নির্ধারণ করতে হবে অত্যন্ত দায়িত্বের সাথে। এবার দেখি সেই দায়িত্ববানরা তাদের দায়িত্ব কীভাবে পালন করছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, লাইসেন্স আছে এমন যানবাহন চালকের সংখ্যা বাংলাদেশে ১৮ লাখ আর যানবাহনের সংখ্যা ৩৩ লাখ! সরকারি হিসাব মেলাতে গেলেও ১৫ লাখ লাইসেন্সবিহীন চালক তার বাহন নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ায় আমাদের সামনে। এমন নয় যে কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে অবগত নয়, কিন্তু তারা প্রচণ্ড রকমের উদাসীন। মাঝে মাঝেই রাস্তা-ঘাটে সার্জেন্টদেরকে দেখা যায় বিভিন্ন বাস থামিয়ে লাইসেন্স চেক করতে। তখন হয়তো একটা ফোনকল কিংবা কিছু নগদ অর্থ বাসে অবস্থানরত যাত্রীদেরকে নিরাপদেই ঠেলে দেয় ঝুঁকির মুখে।
সড়ক দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই ঘটে চালকের অসাবধানতার কারণে। কিন্তু চালক কেন সবসময়ই অসাবধান থাকে? এক্ষেত্রে বাসের চালকরা দোষ দিচ্ছেন রাস্তার অব্যবস্থাপনা এবং মালিক পক্ষকে। আন্তঃজেলা বাস চালকদের সমিতির একজন নেতা জাকির হোসেন বিপ্লব বিবিসিকে বলছেন,
“লোকাল বাসগুলো প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালায়। সেজন্য অনেকসময় দুর্ঘটনা ঘটে। চালকদের চাকরির নিশ্চয়তা নাই। তার ওপর মালিকদের দ্বারা তারা চাপে থাকে। কারণ মালিকদের ক্যাশ (নগদ টাকা) কম হলে অনেক ড্রাইভারের চাকরি চলে যায়”।
বাসমালিকরা আবার পাল্টা দোষ দিচ্ছেন চালকদের ওপর। তারা মনে করছেন, মাদকসেবনের উদ্দেশ্যে বাসচালকরা দ্রুতগতিতে বাস চালানোর চেষ্টা করে থাকে। অধিক ট্রিপ দিতে পারলে বেশি টাকা আয় করে তারা নিজেদের ইচ্ছামতো মাদক গ্রহণ করে। এছাড়া রাজধানীর ট্রাফিক সিস্টেম এবং রুট পারমিটকেও এই বেপরোয়াপনার জন্য দায়ী করেন তারা।
২০১৩ সালে ঢাকায় যানবাহন চলাচলের জন্য ১৫৬টি রুট ঠিক করা হলেও বর্তমানে প্রায় ৩০০ রুটে যানবাহন চলাচলের অনুমতি পেয়েছে। এতে করে যানবাহনের সমস্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি চালকদের মধ্যে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। চালকদের নিয়ন্ত্রণে আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে।
২০১৭ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইনে বলা হচ্ছে, চালকের লাইসেন্স পেতে হলে ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি পাস করতে হবে এবং সাধারণ চালকের বয়স হতে হবে ১৮। পেশাদার চালকের বয়স ন্যূনতম ২১ হতে হবে। চালকের হেলপারেরও লাইসেন্স থাকতে হবে, অন্যথায় এক মাসের জেল আর চালকের লাইসেন্স না থাকলে ছয় মাসের জেল অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালালে অথবা রুট না মানলেও রয়েছে শাস্তি। তবে তা শুধু রয়েছে কাগজে কলমেই। বাস্তবে চালকরা এসব আইনকে থোরাই পাত্তা দেয়!
প্রতিকার
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শামসুল হক একে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করতে চান। তিনি বলেন,
“পরিবহন খাতের বিশৃংখলা, এটা হয়তো পদ্ধতিগতভাবেই আমরা তৈরি করেছি। কিন্তু এর বেনিফিসিয়ারি পরিবহন খাতে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো রাজনীতিতে এত বেশি জড়িত হয়ে গেছে, যে জন্য আমি মনে করি, এখন রাস্তায় পরিস্থিতি আসলে টেকনিক্যাল সমস্যা নয়। এটা রাজনৈতিক সমস্যা”।
যানবাহনকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে পারলে চালকদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব হ্রাস পাবে বলে মনে করেন তিনি। কারণ চালকেরা ধরেই নেয়, দুর্ঘটনার কারণে তার কোনো সাজা হবে না। তবে রাজনীতিকরা তা মানতে নারাজ। তারা মনে করেন, অল্প রাস্তায় অধিক যানবাহনের ফলে এই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। সেসব দেশের মধ্যে অনেক দেশেই রাস্তার তুলনায় যানবাহন তুলনামূলকভাবে বেশি।
সমস্যা সমাধানে সকল পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে বলে করেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, অনিয়মের সংস্কৃতির কারণেই বর্তমানে এই অবস্থা। এ ব্যাপারে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন,
“একজন মানুষ রাস্তায় নেমে যখন দেখবে যে রাস্তায় সবকিছু পদ্ধতিগতভাবে চলছে, তখন তিনিও নিয়ম মানার প্রতি উৎসুক হবে। বাস থামা, যাত্রী ওঠানো, রাস্তা পারাপার এমন সব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকলেও কেউই নিয়ম মানে না এবং সেই নিয়মের বাস্তবায়নও নেই”।
দুর্ঘটনা নিরসনে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া কর্তৃপক্ষ এবং ট্রাফিক পুলিশ এবং সাধারণ জনগণকে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশন সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন তারা।
বিশ্লেষকরা মনে করেন দায়িত্বে অবহেলার কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এর দায় যেমন চালকের তেমনি কর্তৃপক্ষের। এ ব্যাপারে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রধান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন,
“আমরা শুধু চালকের শাস্তি চাই না, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি আমরা দাবি করেছি। সেটা যারা লাইসেন্স প্রদান করেন তারা হতে পারেন, গাড়ির মালিক হতে পারেন, রাস্তায় ত্রুটি থাকলে প্রকৌশলী হতে পারেন”।
যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে যদি সকল নিয়মকানুন সঠিকভাবে মানা হতো, কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক পর্যন্ত সবাই যদি যার যার দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করতো তাহলে হয়তো আজ রাজিব-রোজিনারা বেঁচে থাকতো। কাউকেই হাসিমুখে বাসা থেকে বের হয়ে লাশ হয়ে ফিরতে হতো না, বরণ করতে হতো না আজীবনের পঙ্গুত্ব। তাই সকলেরই দাবি সড়ক দুর্ঘটনার পেছনের কারণগুলো বের করে এনে সে সমস্যাগুলো সমাধান করা হোক এবং দুর্ঘটনা বন্ধে সকল ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
ফিচার ইমেজ- ডিএনএইন্ডিয়া