সুস্থ গর্ভধারণ ও গর্ভে থাকা শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য চাই গর্ভবতী মায়ের শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ। সেজন্য গর্ভাবস্থায় কী কী খাবার খেলে একজন গর্ভবতী মা এসব চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ করতে পারবেন সেই সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন সকলের। আজকের আয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি নিয়েই।
১। প্রোটিন
গর্ভাবস্থার ৯-১০ মাস সময়কে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম ৩ মাসকে ‘1st trimester’, মাঝের ৩ মাসকে ‘2nd trimester’ ও শেষের ৩ মাসকে ‘3rd trimester’ বলা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে, একজন গর্ভবতী মায়ের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় trimester-এ প্রতিদিন যথাক্রমে ১, ৯ ও ৩১ গ্রাম অতিরিক্ত প্রোটিন প্রয়োজন হয়। আর এ প্রোটিনের চাহিদা পূরণে খাবার তালিকায় থাকা দরকার মাছ, বিভিন্ন ধরনের ডাল, ডিম, গরুর দুধ ও মুরগির মাংস।
২। ভিটামিন এ
গর্ভস্থ শিশুর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বেড়ে ওঠা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কার্যকর থাকা, দৃষ্টিশক্তি সঠিকভাবে কাজ করা এবং সার্বিকভাবে বেড়ে ওঠায় ‘ভিটামিন এ’ প্রয়োজন। গর্ভে থাকা শিশু যেহেতু সব পুষ্টি মায়ের মাধ্যমেই পায়, তাই গর্ভবতী মায়ের শরীরে ভিটামিন এ-এর এই চাহিদা পূরণ হওয়া দরকার। WHO-এর মতে, একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ৮০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে খাবারের তালিকায় থাকা চাই মুরগির কলিজা, ডিম, গাজর, আম, গাঢ় কমলা ও হলুদ রঙের ফল এবং গাঢ় সবুজ রঙের শাক-সবজি।
৩। ভিটামিন ডি
ভিটামিন ডি শরীরে ক্যালসিয়ামের শোষণ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসকে হাড়ের জন্য কার্যকরী করে। গর্ভবতী মায়ের শরীরে ভিটামিন ডি-এর অভাব হলে শিশুর সার্বিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং মায়েরও গ্যাস্টোলিন ডায়াবেটিস সহ নানান ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। WHO এর মতে, গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন শরীরে ৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন ডি এর চাহিদা থাকে। ভিটামিন ডি পাওয়া যাবে দুধ, কমলার জুস, ডিম, মাশরুম ইত্যাদি খাবারদাবারে।
৪। ক্যালসিয়াম
গর্ভকালীন সময়ের শেষ ৩ মাসে গর্ভবতী মায়ের শরীরে ক্যালসিয়ামের চাহিদা বেড়ে যায়। যদিও গর্ভাবস্থার প্রথম থেকেই স্বাভাবিক চাহিদার তুলনায় তুলনামূলকভাবে ক্যালসিয়ামের চাহিদা বেড়ে যায়, তবুও শেষের ৩ মাস চাহিদাটা সবচেয়েতে বেশি থাকে। WHO এর মতে, একজন গর্ভবতী মায়ের দিনে ১০০০ মিলিগ্রাম এবং বিশেষ করে শেষ ৩ মাসের প্রতিদিন ১২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া দরকার। ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবারের মাঝে আছে টক দই, দুধ বা দুধ জাতীয় যেকোনো খাবার, গাঢ় সবুজ রঙের শাক-সবজি, মাছ ও ছোলা।
৫। আয়রন
আয়রন শরীরে হিমোগ্লোবিন ও এনার্জি তৈরিতে সাহায্য করে, গর্ভস্থ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং স্নায়ুতন্ত্র বিকাশ করে। শরীরে আয়রনের অভাবে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। Institute Of Medicine (IOM) এর মতে, গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ২৭ মিলিগ্রাম আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া দরকার। তাই গর্ভাবস্থায় প্রতিদিনের খাবারে গরুর মাংস, কলিজা, মসুর ডাল, মাছ, কলিজা, পালং শাক ও সবুজ শাক-সবজি রাখা ভালো।
৬। জিংক
জিংক শরীরের প্রত্যেকটি অংশের বিভিন্ন ধরনের কার্যক্ষমতা সক্রিয় রাখে এবং টিস্যু ও কোষ গঠনে ভূমিকা রাখে। এমনকি গর্ভে থাকা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও বেড়ে ওঠায় জিংক গুরুত্বপূর্ণ। WHO এর মতে, গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩ মাস ১১ মিলিগ্রাম, দ্বিতীয় ৩ মাস ১৪ মিলিগ্রাম ও শেষের ৩ মাস ২০ মিলিগ্রাম করে জিংক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া দরকার। কলিজা, গরুর মাংস, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদিতে পাওয়া যাবে জিংক।
৭। আয়োডিন
গর্ভাবস্থায় আয়োডিনের অভাব হলে গর্ভে থাকা সময় থেকে শুরু করে জন্মের ৩ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুর বুদ্ধির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এছাড়াও আয়োডিনের অভাবে গর্ভে থাকা শিশুর মৃত্যুর সম্ভাবনাও থাকে। এটি থাইরয়েডকেও সুস্থ রাখে। তাই গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন প্রায় ২০০ মিলিগ্রাম আয়োডিনযুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে WHO। আয়োডিন যুক্ত খাবারের মাঝে আছে আয়োডিনযুক্ত লবণ, সামুদ্রিক মাছ, পনির, টক দই, গরুর দুধ ইত্যাদি।
৮। কোলিন
‘কোলিন’ ভিটামিন বি কমপ্লেক্সগুলোর মধ্যে একটি। গর্ভাবস্থায় কোলিন মেরুদণ্ড এবং মস্তিষ্কের বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে এছাড়াও গর্ভে থাকা শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশ করে। Institute Of Medicine (IMO) এর মতে, একজন গর্ভবতী মায়ের দিনে ৪৫০ মিলিগ্রাম কোলিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া প্রয়োজন। ডিমের কুসুম, ব্রোকলি, সামুদ্রিক মাছ, চিনাবাদাম, দুধ, কলিজা ও গরুর মাংসে পাওয়া যাবে কোলিন। তবে সামুদ্রিক মাছে কোলিনের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি।
৯। Docosahexaenoic Acid (DHA)
DHA হলো ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডগুলোর মধ্যে একটি। এটি গর্ভে থাকা শিশুর দৃষ্টিশক্তি ও রক্ত কোষ বিকাশের সহায়ক। বিশেষ করে শেষের ৩ মাস DHA গর্ভে থাকা শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে কাজ করে। তাই গর্ভবতী মায়ের DHA সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া বেশ প্রয়োজন। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ২০০ মিলিগ্রাম এমন খাবার খাওয়া দরকার যাতে DHA আছে। সামুদ্রিক মাছ ও ডিমে পাওয়া যাবে DHA।
১০। ফলিক এসিড
গর্ভবতী মায়ের শরীরে ফলিক এসিডের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ না হলে গর্ভস্থ শিশু সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না এবং জন্মের সময় শিশুর ওজন কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খেয়াল রাখতে হবে যেন গর্ভাবস্থার প্রথম কয়েক সপ্তাহ ফলিক এসিডের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ হয়। কারণ বিশেষ করে সেই সময়টিতে গর্ভবতী মায়ের শরীরে ফলিক এসিডের অভাব হলে গর্ভস্থভশিশুর উপর এর প্রভাব পড়ে। IMO এর মতে, গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন ৬০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। ফলিক এসিডযুক্ত খাবারের মাঝে রয়েছে ব্রোকলি, ভাত, মসুর ডাল, কমলার জুস, পালং শাক ও পাউরুটি।
১১। পটাশিয়াম
পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং শরীরে ফ্লুইডের সঠিক ব্যালেন্স বজায় রাখে হার্টবিট ও এনার্জি লেভেলকে স্বাভাবিক রাখে। পটাশিয়ামযুক্ত খাবারগুলো হলো মিষ্টি আলু, কিসমিস, ব্রোকলি, টক দই, মসুর ডাল, পালং শাক ও কমলার জুস।
১২। ভিটামিন বি-১২
ভিটামিন বি-১২ শরীরে রক্ত কোষ উৎপাদনে সাহায্য করে এবং ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেটের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে শরীরে এনার্জি এনে দেয়। WHO এবং IMO এর মতে, একজন গর্ভবতী মায়ের দিনে ২.৬ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন বি-১২ দরকার। ভিটামিন বি-১২ সমৃদ্ধ খাবার হলো গরুর মাংস, টুনা মাছ প্রভৃতি।
১৩। ভিটামিন সি
ভিটামিন সি এর সাহায্যে শরীর সহজেই শাকসবজি থেকে আয়রন শোষণ করে নিতে পারে, রক্তশূন্যতার সম্ভাবনা কমায় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। IOM এর মতে, একজন গর্ভবতী মায়ের দিনে ৮৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। যেসব খাবারে ভিটামিন সি আছে তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো আঙুর, টমেটো, ব্রোকলি, আম, পেয়ারা, আমলকি ও পালং শাক।
Trimester ভেদে গর্ভাবস্থার একেক সময়ে একেক পুষ্টি উপাদানের চাহিদা কম-বেশি হয়। এখানে যেসব উপাদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার বাইরেও রিবোফ্লাভিন, ভিটামিন বি৬ সহ আরও কিছু উপাদানের চাহিদা থাকে। এখানে লক্ষ্য করলে দেখতে পারবেন যে, একই খাবারের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান রয়েছে। যেমন- ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি ও প্রোটিন আপনি একই সাথে পাবেন ডিম থেকে। তাই গর্ভাবস্থায় আপনি কী কী খাবার প্রতিদিন খাবেন তার একটি রুটিন বানিয়ে নিতে পারেন সহজেই।