গত ২১শে জুলাই এক ইন্দোনেশিয়ান ফেসবুক ব্যবহারকারী Sahrie Stoner প্রথম ফেসবুকে দুটি ভিডিও ক্লিপ এবং তিনটি ছবি প্রকাশ করে জানান, ইসরায়েল আল-আক্বসা মসজিদ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ২৭টি জঙ্গী বিমান পাঠিয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ্র বিশেষ কুদরতে বিশেষ ধরনের পাখি এসে সেগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে! তার এই পোস্ট ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এটি ভাইরাল হয়ে যায়। মাত্র ৯ দিনেই তার পোস্টে ১ লাখের উপরে রিঅ্যাকশন পড়ে। এর মধ্যে পোস্টটি শেয়ার হয় দেড় লাখের বেশি বার এবং পোস্টটিতে কমেন্ট করেন অর্ধ লক্ষের বেশি মানুষ। ভিডিও দুটোর একটি দেখা হয় ১ কোটির বেশি বার ও অন্যটি ১২ লক্ষের বেশি।
রিঅ্যাকশন এবং কমেন্টগুলো দেখলে বোঝা যায়, অধিকাংশ মানুষই ভিডিও এবং ছবিগুলোকে সত্য বলে ধরে নিয়েছে। কারণ রিঅ্যাকশনগুলোর মধ্যে ‘লাইক’, ‘লাভ’ ও ‘সারপ্রাইজড’ এর তুলনায় ‘হা-হা’ রিঅ্যাকশনের সংখ্যা খুবই কম! আর কমেন্টও বেশিরভাগ ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’ বা এ জাতীয় কথা এসেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ইসরায়েলের মতো সামরিক পরাশক্তির ২৭টা যুদ্ধ বিমান ধ্বংসের মতো বিশাল ঘটনা ঘটে, তাহলে সেটা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াতে কেন আসছে না? অথবা ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলন কর্মীরা অথবা হামাসের পক্ষ থেকেই বা কেন এ ব্যাপারে কোনো বিবৃতি আসছে না? কেন শুধুমাত্র ইন্দোনেশিয়ার এক অখ্যাত ফেসবুক ব্যবহারকারীর পোস্টের উপর সবাই ভরসা করছে? তবে কি ভিডিওটি এবং সংশ্লিষ্ট দাবিটি সত্য নয়? চলুন, জানা যাক কী আছে সেই স্ট্যাটাস এবং ভিডিওতে এবং সেটা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য।
কী আছে এই স্ট্যাটাসে?
মূল স্ট্যাটাসটি ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় লেখা। গুগল ট্রান্সলেট থেকে স্ট্যাটাসটিকে অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায়, তার বাংলা হচ্ছে মোটামুটি এরকম:
সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।
২৭টি ইসরায়েলি জেট এবং মিজাইল ফাইটার ফিলিস্তিনের আল-আক্বসার দিকে যাচ্ছিল, সেগুলো আকাশে কোনো কারণ ছাড়াই বিস্ফোরিত হয়েছে।
এবং দৃশ্যগুলোর কিছুক্ষণ আগে মানুষ ফিলিস্তিনের আকাশে মেঘের মধ্য দিয়ে পাখির মতো অদ্ভুত আকৃতির একটি প্রাণী দেখতে পেয়েছিল (সম্ভবত ফেরেশতা)।
আল্লাহ যদি কিছু চান, তাহলে তিনি বলেন “হও”, আর তা হয়ে যায়।
কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য এই স্ট্যাটাস?
ভিডিওটি না দেখেই, অথবা অন্য কোন তথ্য যাচাই না করেই, শুধুমাত্র সাধারণ বোধবুদ্ধি থেকেই এই স্ট্যাটাসের বক্তব্যকে সন্দেহজনক মনে হতে পারে। প্রথমত, ইসরায়েল যতো অত্যাচারী রাষ্ট্রই হোক, রাষ্ট্রীয়ভাবে সে অতীতে কখনোই আল-আক্বসা মসজিদ ধ্বংসের চেষ্টা করেনি। এই সংকটেও নেতানিয়াহু শুরু থেকেই বলে আসছে যে, আল-আক্বসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত যে চুক্তি বা স্ট্যাটাস কু বিদ্যমান রয়েছে, তারা সেটা পরিবর্তন করতে চায় না। এরকম প্রেক্ষাপটে হঠাৎ কোনো রকম উসকানি ছাড়াই ইসরায়েল আল-আক্বসা মসজিদ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য বিমান পাঠাবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
দ্বিতীয়ত, আল-আক্বসা মসজিদ আকারে খুব বিশাল কিছু নয়। ইসরায়েল যদি চায়, দূর থেকে দুই-তিনটি মিসাইল দিয়েই সেটা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে পারে। সেটি না করে যদি যুদ্ধবিমান পাঠাতে চায়, তাহলেও একটি বিমান থেকে দুই-তিনটি বোমা ফেলাই যথেষ্ট। মাত্র একটি মসজিদ ধ্বংসের জন্য ২৭টি বিমান পাঠানোর কোনো যুক্তিই নেই।
কী আছে স্ট্যাটাসের সাথে সংযুক্ত ছবি এবং ভিডিওতে?
Sahrie Stoner-এর পোস্টের সাথে মোট দুটি ভিডিও এবং তিনটি ছবি আছে। একটি ভিডিওর দৈর্ঘ্য ১৪ সেকেন্ড, অপরটির দৈর্ঘ্য ৫ মিনিট। আর যে তিনটি ছবি দেওয়া আছে, সেগুলো মূলত ভিডিওগুলো থেকেই নেওয়া স্ক্রীনশট। ১৪ সেকেন্ডের যে ভিডিওটি, সেটি ৫ মিনিটের ভিডিওর ভেতরেও আছে। কাজেই শুধুমাত্র ৫ মিনিটের ভিডিওটি নিয়ে আলোচনা করাই যথেষ্ট।
ভিডিওটি মূলত কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ভিডিও ক্লিপের সমষ্টি। প্রথম ক্লিপে কোনো প্লেন দেখা যায় না, শুধু দেখা যায় বিশাল আকৃতির দুটি পাখি আকাশে উড়ছে। ভিডিওর দ্বিতীয় অংশটি সিরিয়ার কোনো একটি জিহাদী গোষ্ঠীর করা ভিডিও, কারণ উপরের ডান কোণে একটি কালো পতাকার লোগো ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি সাধারণত আল-ক্বায়েদা, আইএস বা এ জাতীয় জিহাদী সংগঠনগুলো ব্যবহার করে থাকে। এখানে দেখা যায়, একটি প্লেনে আগুন লেগে সেটা ভূপাতিত হচ্ছে। প্লেনটিতে আগুন লাগার কিছুক্ষণ আগে খুব হালকাভাবে একটি পাখি বা পঙ্খিরাজ ঘোড়ার মতো কোনো একটি প্রাণীকে তার পাশ দিয়ে উড়ে যেতে দেখা যায়। ভিডিওটিতে পেছন থেকে মানুষের উল্লাস শোনা যেতে থাকে, যেখানে তারা সিরিয়ান আর্মির প্লেন ধ্বংস হচ্ছে বলে আরবিতে সিরিয়ান অ্যাকসেন্টে উল্লাস করতে থাকে।
ভিডিওর তৃতীয় অংশটি ফ্রি সিরিয়ান আর্মির লোগো বিশিষ্ট ভিডিও। এখানেও পূর্বের ক্লিপের মতোই পাখি উড়ে যায়, প্লেন ধ্বংস হয়, মানুষের উল্লাস শোনা যায়। এরপরে পরপর আরো কয়েকটি ভিডিও। কয়েকটিতে কোনো লোগো নেই, কয়েকটিতে থাকলেও স্পষ্ট না। কিন্তু সবগুলোই মোটামুটি একই রকম।
ভিডিওগুলো কি বিশ্বাসযোগ্য?
ভিডিওগুলোতে প্লেন ধ্বংস হওয়ার দৃশ্যগুলো মূলত সত্য। সিরিয়া যুদ্ধে বিদ্রোহীরা সরকারি বাহিনীর অনেকগুলো প্লেন ধ্বংস করেছে। কিন্তু স্ট্যাটাসে যেরকম দাবি করা হয়েছে যে, এগুলো আল-আক্বসার ঘটনা এবং ভিডিওতে পাখি দেখিয়ে যেরকম দাবি করা হচ্ছে, অলৌকিকভাবে পাখিগুলোর আক্রমণে প্লেনগুলো বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
প্রথমত, কয়েকটি ভিডিওতে লোগো থাকার কারণে এবং পেছনে সিরিয়ান অ্যাকসেন্টে প্লেন ধ্বংস করার দাবি করার কারণে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়, ভিডিওগুলো আল-আক্বসার আশেপাশের না, ওগুলো সিরিয়ার ভিডিও। একটি ক্লিপে পেছন থেকে একজনের কণ্ঠে পরিষ্কারভাবে সেদিনের তারিখটা বলতেও শোনা যায় – “সাবা’ ওয়া আশরিন, তামানীয়া, আলফেন ওয়া এতনাশ” অর্থাৎ ২৭/৮/২০১২। অর্থাৎ সাম্প্রতিক আল-আক্বসা সংক্রান্ত ঘটনার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এটি অনেক পুরানো ভিডিও।
দ্বিতীয়ত, যেসব ভিডিওতে লোগো নেই, সেগুলোতেও পেছনে অবিরত গোলাগুলির যে শব্দ পাওয়া যায়, তা জেরুজালেমের চেয়ে বরং সিরিয়া বা ইরাকের যুদ্ধক্ষেত্রের সাথে বেশি মিলে যায়। জেরুজালেমে পুলিশ নিরস্ত্র মুসল্লিদের উপর বর্বর আক্রমণ করলেও সেখানে ইরাক বা সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রের মতো অবিরত গোলাগুলি হয়েছে- এরকম কোনো রিপোর্ট নেই।
তৃতীয়ত, আল-আক্বসার ভিডিও হলে সবগুলো একই দিনের ভিডিও হবার কথা ছিল। কিন্তু লোগো নেই, এরকম ভিডিওগুলোরও আকাশের রং দেখে বোঝা যায়, সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন দিনের অথবা ভিন্ন ভিন্ন স্থানের ভিডিও।
চতুর্থত, কোনো ক্লিপেই পেছনের মানুষদের মুখে পাখি দেখা নিয়ে উল্লাস করতে বা অবাক হতে শোনা যায় না, সবগুলো ক্লিপেই শুধুমাত্র প্লেন ধ্বংস হচ্ছে, এটি নিয়েই উল্লাস করতে শোনা যায়।
পঞ্চমত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবগুলো ভিডিওতে পাখি বা পঙ্খিরাজ ঘোড়া যেটিই হোক, সেটি প্রতিবার একই ভঙ্গিতে একই দিক থেকে উড়ে আসে। প্রতিবারই সেটি বাম দিকের উপরের কোনা থেকে উড়ে এসে ডান দিকের একটু নিচে দিয়ে চলে যায়। এ থেকেই পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, একটি মাত্র উৎস থেকে পাওয়া পাখির ওড়ার দৃশ্য এডিট করে প্রতিটি ভিডিও ক্লিপে বসানো হয়েছে।
অলৌকিক কিছু যদি হয়েও থাকে, তাহলেও সেটি প্রতিবারই ঠিক একইভাবে কেন আসবে? আর যদি একইভাবেও আসে, তাহলে একাধিক ভিডিও যেহেতু একাধিক ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে ধারণ করেছে, তাই ভিডিওতে সেটিকে কখনো ডান দিক, কখনো বাম দিক থেকে দেখা যাওয়ার কথা ছিল।
সার্বিক বিশ্লেষণে বলা যায়, ভিডিওটি এবং এর সাথে প্রদত্ত স্ট্যাটাস দুটোতেই ইসলামের নাম ব্যবহার করে যে অলৌকিক ঘটনার দাবি করা হয়েছে, সেটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে সৃষ্ট। অনলাইনে অনেকেই বেশি লাইক পাওয়ার জন্য অথবা মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করার জন্য মানুষের ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এ ধরনের ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে থাকে। কাজেই এ ধরনের ভিডিও বা ছবি শেয়ার করার আগে আমাদের যৌক্তিকভাবে চিন্তা এবং অনুসন্ধান করে দেখা উচিত এগুলো কতটুকু সঠিক।
ফিচার ইমেজ (শিল্পীর কল্পনা থেকে আঁকা)- guibingzhuche.com