সুন্দর সুস্থ-সবল এই পৃথিবীটা হঠাৎ করে যেন অসুস্থ হয়ে উঠল। হঠাৎ করে আবিভূর্ত হলো এক মহামারি। মুহূর্তের মধ্যেই তছনছ করে দিল চতুর্দিক। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারির কথা, যখন সবাই খবরে দেখত, চীনে এক মহামারি এসেছে এবং বিনাশ করছে মানুষের প্রাণ, তখন আমাদের সকলের কল্পনায় আসেনি যে, এ মহামারি আমাদের দেশে হানা দেবে একদিন।
দেখতে দেখতে খুব কম সময়ের ব্যবধানেই মার্চ মাসে বাংলাদেশেও দেখা দিল করোনার প্রকোপ। সেই মার্চ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত চলছে সেই ভয়াবহতা। সামনে আর কতদিন এরকম চলবে, আমরা কেউ বলতে পারি না। সারা বিশ্বে মহামারি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কেড়ে নিচ্ছে অজস্র প্রাণ। করোনাকালে মানুষের জীবনে এসেছে অনেক বৈচিত্র্য। করোনা কারো জীবনে ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচিত হলেও অধিকাংশ মানুষের জীবনেই এটি কাল হয়ে এসেছে। অনেকে হারিয়েছে সর্বস্ব। মানুষের জীবনধারায় এসেছে এক বিরাট পরিবর্তন। করোনায় নেতিবাচক কয়েকটি বিষয়ের একটি হলো শিশুদের মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি।
ইন্টারনেটের এই যুগে সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। মানুষ খবর থেকে শুরু করে নাটক, চলচ্চিত্র, খেলা সবকিছু টিভির চেয়ে এখন মোবাইলে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আগের মতো পরিবারের সকলে একসাথে বসে কোনো অনুষ্ঠান দেখা আর হয়ে ওঠে না। একসময় ছিল, যখন মানুষ পরিবারের ছোট শিশুসহ সকলকে সাথে নিয়ে বসে ‘ইত্যাদি’, ‘মিনা কার্টুন’, ‘সিসিমপুর’, খেলাধুলা, বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান দেখত। এখন আর সেই দিন নেই। এখন মানুষ অনলাইনে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করে। এবং করোনার সময়ে মানুষের মোবাইল ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা একদিকে যেমন বড়দের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলছে, তেমনি শিশুদেরকেও প্রভাবিত করছে।
দৈনিক সমকালে রওশন আক্তার ঊর্মির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইউনিসেফের তথ্যানুসারে বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। আর প্রতিদিন ১ লাখ ৭৫ হাজার, অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়সই ১০ বছরের কম।
একটি শিশু যদি সর্বক্ষণ পরিবারের মানুষদের মোবাইল, ট্যাব ব্যবহার করতে দেখে, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তার সেই জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। এ আকর্ষণ থেকে তারাও মোবাইল ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছে। শিশুর জেদ সামাল দিতে পরিবারের মানুষজনও তাদের হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছে। অনেক অভিভাবক শিশুর এই আসক্তিকে ‘যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা’ হিসেবে গণ্য করছেন। কিন্তু তারা কল্পনাও করতে পারছেন না, শিশুর এ আচরণ ভবিষ্যতে কী ধরনের বিপত্তিতে ফেলতে পারে।
টাইমস অভ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৬৫ শতাংশ শিশু করোনার সময় ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়েছে।
কিছুদিন আগে কথা হয়েছিল এক মায়ের সাথে। তিনি জানালেন, তার ছোট মেয়ে মেহজাবিনের কথা। বয়স প্রায় ৭ বছর। বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার প্রস্তুতি চলছে। করোনার প্রাদুর্ভাবে তা বর্তমানে থেমে আছে। করোনার আগে বাসার নিচে নিয়মিত খেলত সে। তবে এখন আর তার খেলা হয় না। বাসায় একা একা খেলতে ভালো লাগে না তার। বাবা-মা দুজনেই কর্মজীবী। বাবা বাসা থেকে অফিস করেন, মাকে নিয়মিত যেতে হয় বাইরে। তার মা জানালেন, একটা সময় মেহজাবিন মোবাইল বা ট্যাবে কার্টুন দেখে দেখে খাবার খেত। হাতে মোবাইল না দিলে খেত না। স্বামী-স্ত্রী মিলে খুব কষ্টে তাকে সেই নেশা থেকে বের করে এনেছেন এবং বাসার নিচে খেলবার সুযোগ থাকায় পরে সে আর এসব ডিভাইস হাতে নিত না।
কিন্তু করোনা আসার পর থেকে তার বাসার নিচে গিয়ে খেলবার সুযোগটাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন বাসায় সবাই বন্দিদশা পার করছে। এ সুযোগে মেহজাবিন নতুন করে মোবাইলের নেশায় আসক্ত হয়েছে, যা সামাল দেওয়া তার বাবা-মার পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা বিশ্বে শিশুদের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে।
২০১৯ সালে গার্ডিয়ান কমনসেন্স মিডিয়ার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ৫৩ শতাংশ ১১ বছর বয়সী শিশুর স্মার্টফোন আছে। ১২ বছর হতে হতে এ সংখ্যা ৬৯ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশের শিশুরাও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে এ সংখ্যা যেন দিন দিন বাড়ছে।
আমেরিকান কমিউনিটি সার্ভে অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৯৪ শতাংশ ৩-১৮ বছর বয়সী বাচ্চার বাসায় ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ ছিল। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশ কম্পিউটারের মাধ্যমে এবং ৬ শতাংশ স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করত। দিন যত এগোচ্ছে, এ সংখ্যা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষার সুবাদে বাচ্চারা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ বেশি পাচ্ছে এবং অনেকে এতে আসক্তও হয়ে পড়ছে।
এনবিসি নিউজের তথ্যানু্যায়ী, ৮-১২ বছরের একটি শিশু গড়ে ৬ ঘণ্টা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করছে। করোনাকালে এ ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অভ পেডিয়াট্রিকস শিশুদের দু’ঘণ্টা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে, যেখানে শিশুরা এখন দিনের বড় একটি অংশ মোবাইলসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করছে।
দ্য গ্লোবাল টাইমস অন মানডে-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ৪০ শতাংশের বেশি চীনা অভিভাবক বিশ্বাস করেন, তাদের বাচ্চারা মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্ত। ১০-১৭ বছর বয়সী চীনা শিশুরা করোনাকালে ৪ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে, যা আগের তুলনায় স্পষ্টত অনেক বেশি।
শিশুদের এ আসক্তি থেকে মুক্ত করতে না পারলে তা অদূর ভবিষ্যতে বহু কুফল বয়ে আনবে। অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের ফলে শিশুর মস্তিষ্ক এবং চোখের ওপর চাপ পড়ছে। শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা। তাদের মানসিক বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ইলেকট্রনিক ডিভাইস। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসিক নানা রোগের সূচনা ঘটে, বিশেষ করে মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের নানা সমস্যা সৃষ্টি হয় ইলেকট্রনিক ডিভাইসের আসক্তির কারণে।
দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত সমীর কুমার দে-র এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন,
শিশুরা দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় এমনিতেই তাদের সামাজিক দক্ষতা কমে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মানবিক গুণাবলি কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে তারা স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করছে। এ ডিভাইসে তাদের আসক্তি সমাজের জন্য এক বিরাট ক্ষতি। পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকি তো আছেই। তাই আমি মনে করি, শিশুদের হাতে স্মার্ট ডিভাইস যত কম দেওয়া যায়, ততই মঙ্গল। আর বড়রা এটা ব্যবহার করলে শিশুদের দূরে রাখতে হবে। বড়দের এই রেডিয়েশন সহ্য করার একধরনের ক্ষমতা তৈরি হলেও শিশুদের সেটা নেই। ফলে ক্ষতিটা বেশি হচ্ছে শিশুদেরই।
দৈনিক সমকালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়,
সম্প্রতি ভারতের চার্টার বিশ্ববিদ্যালয় তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, স্মার্টফোনের অধিক ব্যবহারে শিশুর চোখের রেটিনা, কর্নিয়া এবং অন্যান্য অংশের ক্ষতি হওয়ার বিপুল সম্ভবনার রয়েছে। এছাড়াও অধিক সময় ধরে মোবাইল ব্যবহারে একদিকে যেমন শিশুরা পড়াশোনায় মনোসংযোগ হারাচ্ছে, পাশাপাশি তাদের মেজাজও হয়ে উঠছে খিটখিটে।
সময় নিউজে শফিকুল আলমের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেলে চোখের সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের ৩০ শতাংশ শিশু। অতিমাত্রায় মোবাইলের প্রতি আসক্তিতে মাথা ব্যথা ও পানি পড়াসহ চোখে দেখা দিচ্ছে নানা উপসর্গ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল থিসিস পার্টের এম. এস রেসিডেন্স ডা. অনিন্দিতা চৌধুরী বলেন,
আমরা যে চোখের পাতা ফেলি, এই পাতা ফেলার মধ্যেও কিন্তু একটা উপকার হয়। এতে আমাদের চোখের উপরিভাগটা ভিজে থাকে এবং শুকনা থাকে না। অনেকক্ষণ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের পাতা পড়ার এই হারটা কমে যায়।
মোবাইল আসক্তি থেকে শিশুদের মুক্ত করতে হবে পরিবারের লোকদেরই। তাদের সামনে মোবাইল বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকা উচিত, পাশাপাশি শিশুদেরও মোবাইল হাতে নেওয়াকে নিরুৎসাহিত করা দরকার। যেহেতু তারা এখন বাইরে খেলাধুলা করতে পারছে না, তাই এই সময়ে পরিবারের বড়দের উচিত শিশুদের বেশি বেশি সময় দেওয়া; দিনের একটা অংশে তাদের সাথে খেলাধুলা করা; তাদের শিক্ষণীয় গল্প শোনানো, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। মনে রাখতে হবে, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা সেই শিক্ষাটাই গ্রহণ করবে, যা নিজেদের সামনে দেখবে।