একটা সময় ছিল যখন ভিডিও গেমস খেলা শখের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সেই শখ যদি নেশায় পরিণত হয়, তাহলে তা বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে, কখনও কখনও হতে পারে ভয়ঙ্কর কিছু অপরাধের কারণ। নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন, ভিডিও গেমস খেললে সেটা কীভাবে বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে কিংবা কোনো অপরাধের কারণ কীভাবে হবে? সেরকমই কিছু ঘটনার বর্ণনা দিতেই আমাদের আজকের লেখা।
কল অফ ডিউটি: মডার্ন ওয়ারফেয়ার টু
পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম খুনীদের একজন হলো নরওয়ের আন্দ্রে ব্রেভিক। ২০১১ সালের জুলাই মাসের ২২ তারিখ, সে নরওয়ের সরকারি ভবন ও এক রাজনৈতিক যুবশিবিরে হামলা চালিয়ে হত্যা করে প্রায় ৭৭ জন মানুষ।
সে তার প্রথম হামলাটি চালিয়েছিল একটি ভ্যানের মাধ্যমে। ভ্যানটি নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জেন্স স্টলেনবার্গের কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ইউরোপিয়ান সময় বেলা ৩টা ২৫ মিনিটের মাথায় বিস্ফোরিত হয়। সেই বিস্ফোরণে নিহত হয় ৮ জন এবং আহত হয় সর্বমোট ২০৯ জন। তবে এখানেই শেষ নয়।
এর ঠিক দুই ঘণ্টা পরে চালানো হয় দ্বিতীয় হামলাটি। ব্রেভিক পুলিশের পোশাক পরে এক ফেরিতে করে বাস্কারুডের উটোয়া দ্বীপে পৌঁছায় এবং যুবশিবির লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। তার এই আচমকা আক্রমণে ১১০ জন মানুষ আহত হয় এবং এর মধ্যে ৬৯ জন পরে মৃত্যুবরণ করে। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের বন্ধু এবং নরওয়ের রাজকুমারীর সৎ ভাই। ঘটনার কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে ব্রেভিককে উটোয়া দ্বীপ থেকে গ্রেফতার করে। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে ২২ জুন পর্যন্ত তার বিচারকার্য পরিচালনা করা হয় এবং বিচারের এক পর্যায় সে সব দোষ স্বীকার করে নেয়।
ব্রেভিক ছিল ডানপন্থী মতবাদে বিশ্বাসী এক চরমপন্থী। এছাড়া সে প্রাচীন অডিনতত্ত্বেও বিশ্বাস করতো; যদিও সে তার জবানবন্দীতে বলেছে, সে ধার্মিক নয়। একটা সময় সে নিজেকে জাতীয়তাবাদী যোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা শুরু করে। সে মনে করতো, অনেক ইউরোপীয় দেশের তরুণ সমাজই কথিত ইসলামী জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে এবং কোনো এক সময় তার দেশেরই মুসলিম সহ অন্যান্য অভিবাসীরা নরওয়েজিয়ানদের বিশুদ্ধ রক্তের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আর সেই হুমকিরই বীজ বপন করছে নরওয়ে লেবার পার্টি। তাদেরকে ঠেকাতেই সে কয়েক বছর পরিকল্পনার পর হামলা দুটি চালায়। বিচারে তার ২২ বছরের জেল হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রেভিকের এই হামলার সাথে ভিডিও গেম কীভাবে জড়িত?
ব্রেভিকের দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী, সে ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ারক্র্যাফট ও কল অফ ডিউটি: মডার্ন ওয়ারফেয়ার টু-এর একজন একনিষ্ঠ খেলোয়াড় ছিল। ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ারক্র্যাফট গেমটি বিনোদনের জন্যে খেললেও সে কল অফ ডিউটি: মডার্ন ওয়ারফেয়ার টু গেমটি ব্যবহার করতো ট্রেনিং সিমুলেটর হিসেবে। গেমটিকে ত্রিমাত্রিক রূপ দেওয়ার জন্য সে একধরনের হলোগ্রাম ডিভাইস ব্যবহার করতো এবং তার খেলা গেমের সেই সংস্করণে ‘নো রাশিয়ান’ নামের এক বিশেষ মোড ছিল, যেখানে গেমারকে এক বিমানবন্দরে নির্দোষ বেসামরিক নাগরিকদের উপর সন্ত্রাসী হামলা চালাতে হতো!
ডুম: কলম্বাইন হাই স্কুলের গণহত্যা
১৯৯৯ সালের এপ্রিলের ২০ তারিখ। বেলা বাজে তখন ১১টা ১৯ মিনিট। তখনই হঠাৎ করে কলোরাডোর কলাম্বাইন স্কুলে ঘটে যায় এক ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড। স্কুলেরই দুই সিনিয়র ছাত্র হ্যারিস ও ক্লেবল্ড ট্রেঞ্চকোট পরিহিত অবস্থায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে স্কুলের ক্যাফেটেরিয়াতে প্রবেশ করে সেখানে অবস্থানরত ছাত্রছাত্রীদের উপর প্রচণ্ড গুলি বর্ষণ শুরু করে। প্রায় ১১টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত গোলাগুলির পর তারা ১২ জন শিক্ষার্থী ও একজন শিক্ষককে হত্যা করে এবং আহতের করে ৩৩ জনকে। ১২টার কিছু সময় পর তারা নিজেরা আত্মহত্যা করে।
প্রাথমিক অবস্থায় কোনো কারণ না জানা গেলেও, ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যে পুলিশী তদন্তের পর বেশ কিছু তথ্য আলোতে আসে। এর একটিতে জানা যায়, তারা দুজনেই স্কুলের অন্যান্য শিক্ষার্থীর দ্বারা হয়রানির শিকার হতো। অনেকেই তাদেরকে ‘দ্য লুজারস অব দ্য লুজারস’ বলে প্রায়ই টিটকারী মারত। প্রায় চার বছর সেসব হয়রানীর শিকার হওয়ার পর তারা এই পথ বেছে নেয়। অবশ্য পরে সে তথ্যটি নাকচ করে দেওয়া হয়। কলম্বাইনের পঞ্চম বার্ষিকীর দিন, এফবিআই এর প্রধান তদন্তকারী ও কয়েকজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ একটি সংবাদ নিবন্ধে তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন। সেখানে লেখা হয়, হ্যারিস ছিল একজন ক্লিনিকাল সাইকোপ্যাথ, অন্যদিকে ক্লেবল্ড প্রচণ্ড বিষণ্ণতায় ভুগত। তাদের এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারণ হিসেবে ধারণা করা হয় ক্রোধ, বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক অসুস্থতার পাশাপাশি ডুম গেমের নেতিবাচক প্রভাব।
তারা দুজনেই এই গেমের প্রচণ্ড ভক্ত ছিল। এমনকি হ্যারিস এই গেম নিয়ে স্কুলের একটি প্রজেক্টও লিখেছিল। পরে সে নিজে গেমের বিভিন্ন লেভেল তৈরি করে সেগুলো অনলাইনে ছাড়তে শুরু করে। তার বানানো লেভেলগুলোর নাম ছিল ‘দ্য হ্যারিস লেভেলস’। সেই লেভেলগুলোর তীব্র সহিংসতা থেকে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছিল, এর সাথে কীভাবে সেই হত্যাকাণ্ড এক সুতোয় মেলে।
ডুম: ইভান রামসি
১৯৮১ সালে জন্ম নেওয়া এই ছেলেটির শৈশবের কথা শুনলে মনে হবে যেন, ‘কীভাবে একজন খুনী তৈরি করা যায়’ সেটার ম্যানুয়াল পড়ছেন। প্রক্রিয়াটি শুরু হয় যখন তার বয়স যখন মাত্র সাত বছর! পুলিশের সাথে গোলাগুলির কারণে তার বাবাকে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনার পর তার মা নিয়মিত প্রচুর মদ্যপান করলে, শেষমেশ ইভান ও তার ভাইবোনকে ফস্টার হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি ইভান একবার যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়। এছাড়াও, একটু বোকাসোকা স্বভাবের ছিল বলে স্কুলের সহপাঠীরা প্রায়ই তাকে ‘বুদ্ধি প্রতিবন্ধী’ বলে খেপাত।
ছোটবেলা থেকে নানা ধরনের নিপীড়ন সহ্য করতে করতে সে একসময় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে। তার বয়স যখন ১৬ বছর, তখন তার বাবা প্যারোলে ছাড়া পায় এবং বাবার মুক্তির এক সপ্তাহ পরেই ছেলে নিজেই অপরাধ করে বসে। দিনটি ছিল ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ। ইভান একটি শটগান নিয়ে তার স্কুলে যায়, প্রথমে স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ও পরে একজন ছাত্রকে খুন করা সহ আরও দুজনকে আহত করে। পরে সে নিজে আত্মহত্যা করতে বসলে, গুলি করার আগেই পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলে এবং তাকে নিরস্ত্র করে। পুলিশের জানানো তথ্য অনুযায়ী, মোট বিশ জন মানুষ তার এই অপরাধের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিল। এমনকি এর মধ্যে দুজন তাকে শটগান চালানো শিখিয়েছে।
মূলত এটাই বিশ্বাস করে হয় যে, খুন করার সময় ইভান আসলে ডুম গেমটিকে অনুকরণ করছিল। ডুম গেমার হিসেবে তার পরিচিতি ছিল; এমনকি যে বন্দুক দিয়ে সে হত্যাকাণ্ড চালায়, একই বন্দুক সে গেম খেলার সময় প্রায়ই ব্যবহার করতো। ইভানের বাবাও মিডিয়াকে জানান যে, তিনি বিশ্বাস করেন তার ছেলে গোলাগুলির সময় ডুম গেম অনুকরণ করছিল। শেষমেশ এক সাক্ষাৎকারে, ইভান নিজেও তার অপরাধের জন্যে সেই গেমকেই দায়ী করে। বিচারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ১৯৯ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে ২০৬৬ সালে তাকে প্যারোলে বের হবার সুযোগ দেওয়া হয়। বর্তমানে ইভানের বয়স ৩৮ বছর অর্থাৎ জেল থেকে বের হওয়ার সময় তার বয়স হবে ৮৫ বছর।
হালো ৩: ড্যানিয়েল প্যাট্রিক
এই ঘটনাটি ঘটে ২০০৭ সালে। পছন্দের হালো থ্রি গেম না খেলতে দেওয়ার কারণে ড্যানিয়েল প্যাট্রিক নামের এক মার্কিন কিশোর তার বাবা-মাকে খুন করে বসে। তাদের বাসায় হালো থ্রি গেমটি খেলা নিষেধ ছিল। কিন্তু সে নিষেধ অমান্য করে গেম খেলার কারণে বাবা-মা তার কাছে থেকে গেমটি বাজেয়াপ্ত করেন। সেদিন রাতে সে বাবার ৯ মিলিমিটার পিস্তল দিয়ে তার মাকে হত্যা করে এবং বাবাকে গুরুতরভাবে আহত করে। বাবা-মা দুজনকে গুলি করার পর সে গেমটি নিয়ে ফ্যামিলি ভ্যানে করে পালিয়ে যায়।
সেদিন প্যাট্রিকের বড় বোন ও তার স্বামী ক্লিভল্যান্ডের খেলা দেখতে পিত্রালয়ে পৌঁছে বাবা-মাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে সাথে সাথে পুলিশকে ফোন করে। এর কিছুক্ষণ পর হালো থ্রি গেমটি সহ পেট্রিককে গ্রেফতার করা হয়।
বিচারের দিন প্যাট্রিকের আইনজীবী আদালতে যুক্তি দেখায়, স্নো-বোর্ডিং দুর্ঘটনায় শয্যাশায়ী হওয়ার পর প্যাট্রিক হালো থ্রি গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। আর বাইরে বের হতে পারতো না বলেই সে সারাদিন সেই গেম নিয়ে পড়ে থাকতো, যার কারণে একসময় সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। উকিলের এই কৌশলে সেদিন আদালতে কাজ হয়নি। বিচারক প্যাট্রিককে দোষী সাব্যস্ত করে ২৩ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন।
গ্র্যান্ড থেফট অটো ৪: পলোয়াত চিনো
২০০৮ সালের এপ্রিল মাসের কথা। এই মাসের শেষের দিকেই মুক্তি পাবে রকস্টার গেমের ‘গ্র্যান্ড থেফট অটো ৪’ গেমটি। শিশু-কিশোরদের মধ্যে যারা গেম খেলে তাদের কাছে এই সিরিজটি বেশ ভালোই জনপ্রিয়। স্টুডিও প্রতিবার নতুন গেমের ঘোষণা দিলে প্রায় সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে গেমটির জন্য।
আর সবার মতো থাইল্যান্ডের ১৮ বছর বয়সী কিশোর পলোয়াত চিনোও অপেক্ষা করছিল গেমটির জন্য। কিন্তু সমস্যা হলো, তার বাবা-মার সেটা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। শেষমেশ কোনো উপায় না পেয়ে সে ঠিক করে, গেমে যেরকম টাকা ছিনতাই করে, সে-ও সেই উপায়ে টাকা জোগাড় করে নেবে।
পরিকল্পনা মোতাবেক এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ছুরি ধরে টাকা চাওয়ার পর ড্রাইভার টাকা দিতে অস্বীকার করলে চিনো ড্রাইভারকে ছুরি দিয়ে মারাত্মকভাবে আঘাত করে। এর কিছুক্ষণ পর পুলিশ বডি ও ট্যাক্সি সহ চিনোকে গ্রেফতার করে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সে বছর থাইল্যান্ডে ‘গ্র্যান্ড থেফট অটো ৪’ গেমটি নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর থেকে থাইল্যান্ডের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় সেই দেশে এই ধরনের নৃশংস গেম বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।