এ মুহূর্তে আমরা মানব ইতিহাসে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হারে প্রজাতি হারাচ্ছি এবং এ অবস্থা চলতে থাকলে এক মিলিয়ন প্রজাতি বিলুপ্তির মুখোমুখি হবে। সবচেয়ে শঙ্কার ব্যাপারটি হচ্ছে, পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে আমাদের পরিচিত প্রতি চারটি প্রজাতির একটি এই গ্রহ থেকে হারিয়ে যাবে । জীববৈচিত্র্যের এমন সঙ্কটময় মুহূর্তের মধ্যে এ বছর পালিত হবে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
প্রতি বছর ৫ই জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হয় পরিবেশ দিবস। মানুষ আর পরিবেশের দূরত্ব ঘুচিয়ে এক সবুজ নির্মল পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে দিবসটিকে গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।
১৯৬৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালীন জাতিসংঘের কাছে মানব পরিবেশ সম্পর্কিত একটি সম্মেলন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব দেন অধিবেশনে উপস্থিত সুইডিশ প্রতিনিধিরা। প্রস্তাবনায় বলা হয়,
“সমন্বয় সাধনের সুবিধার্থে এবং মানব পরিবেশ সম্পর্কিত অত্যন্ত জটিল সমস্যাগুলোর বিষয়ে সদস্য দেশগুলোর আগ্রহের দিকে মনোনিবেশ করার জন্য এমন সম্মেলন আয়োজন জরুরী।”
সে প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫-১৬ জুন অনুষ্ঠিত হয় মানব পরিবেশ সম্পর্কিত জাতিসংঘের প্রথম সম্মেলন, যেটি ‘স্টকহোম সম্মেলন’ নামেও বেশ পরিচিত।
আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্পর্কিত সমস্যা ও সমাধান কিংবা ভবিষ্যত ভাবনাগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘের প্রথম এই বৃহত্তম সম্মেলনকে দেখা হয় পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিকাশের একটি মাইলফলক হিসেবে। স্টকহোম সম্মেলন পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার কীভাবে একসাথে কাজ করতে পারে, সে সম্পর্কে ধারণা তৈরি করেছিল। এ সম্মেলন থেকে পাওয়া ধারণা এবং পরিকল্পনাগুলো বিগত বছরগুলোর প্রতিটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন এবং পরিবেশ বিষয়ক চুক্তিতে প্রতিফলন রেখেছে।
এ সম্মেলনেই প্রথমবারের মতো পরিবেশ দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক সুপারিশ আসে৷ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ১১৪টি দেশ অংশগ্রহণ করে। একইসাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের প্রায় চার শতাধিক সংস্থা অংশ নেয়। অংশগ্রহণকারী সকল দেশের প্রতিনিধিরাই ঐকমত্যে পৌঁছান যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এখনই মানব পরিবেশকে বাসযোগ্য করে তোলার পরিকল্পনা করা উচিত৷ পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উন্নত করার প্রচেষ্টায় সরকার এবং জনগণকে এক হয়ে কাজ করার প্রতি জোর দেওয়া হয় ১৩ জুন সম্মেলনের ১৪তম প্ল্যানারি মিটিংয়ে। এ লক্ষ্যে ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে মনোনীত করার সুপারিশ করা হয় সাধারণ সম্মেলনে। একইসঙ্গে পরিবেশ ব্যবস্হাপনায় আলাদা একটি সংস্থা গঠনের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয় সম্মেলনে, যেটি পরে ‘ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম’ (UNEP) নামে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ পরিবেশ বিষয়ক বিশেষায়িত এই সংস্থাটিই বর্তমানে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আয়োজনগুলোর মূল সমন্বয়ক। সংস্থাটির সদর দপ্তর কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে৷ একই বছর ১৫ ডিসেম্বর, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৭তম সম্মেলনে পরিবেশ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
থিম আর আয়োজক শহর নির্বাচন
১৯৭৪ সালে প্রথম উদযাপনের সময় থেকেই প্রতি বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের জন্য নির্দিষ্ট একটি থিম বা বিষয় নির্ধারণ করে দেয় জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, সমসাময়িক পরিবেশগত উদ্বেগের বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্যই থিম নির্বাচনের ভাবনাটি এসেছে। একইসাথে প্রতি বছর যেকোনো একটি শহর বা দেশকে দিবসটির মূল আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শহর বা দেশ নির্বাচনের ক্ষেত্রে থিমের ব্যাপারটি জড়িত। সাধারণত সংশ্লিষ্ট থিমে যে শহর বা দেশ সাফল্য পেয়েছে এবং পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারটিতে আয়োজক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, সে শহর বা দেশকেই নির্বাচন করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত শহর বা দেশটি নানান আয়োজনে নির্ধারিত থিমের উপর সচেতনতা, এই থিমে তাদের সাফল্য এবং পরিবেশগত গুরুত্বের দিকটি তুলে ধরে। ১৯৭৪ সালে প্রথম পরিবেশ দিবসের থিম ছিল ‘Only One Earth’। আয়োজক শহর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্পোকান।
আয়োজনে বাংলাদেশ
জাতিসংঘের সদস্যদেশ হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশেও প্রতি বছর পালিত হয় পরিবেশ দিবস। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় দিবসটির মূল আয়োজন করে থাকে। দিনটিতে দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণের আয়োজন থাকে প্রতি বছর। ২০১৯ সালেও সারা দেশে বিক্রি ও বিতরণের জন্য ৬৯ লাখ ৪৫ হাজার চারা উৎপাদন করা হয়েছিল, এর মধ্যে ১০ লাখ চারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ জনগণের মাঝে বিতরণ করার কথা জানানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
এছাড়া দিনটিতে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ‘জাতীয় পরিবেশ পদক’ প্রদানের প্রচলন রয়েছে। এছাড়া র্যালি, আলোচনাসভার মতো কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সারা দেশে দিবসটির উদযাপন সীমাবদ্ধ।
ভাবনায় জীববৈচিত্র্য
এ বছর পরিবেশ দিবসের ৪৭তম আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছে কলম্বিয়া। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে স্পেনের মাদ্রিদে জলবায়ু বিষয়ক কোপ (Conference of Parties) সম্মেলন চলার মধ্যেই জাতিসংঘের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। কলম্বিয়াকে এ আয়োজনে সহযোগিতা করছে জার্মানি। এ বছর দিবসটির থিম নির্ধারণ করা হয়েছে জীববৈচিত্র্য।
আয়োজকরা বলছেন, বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য এমন এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যখন প্রায় দশ লক্ষাধিক উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। জীববৈচিত্র্যকে থিম ঘোষণা করে পরিবেশ বাঁচানোর সংকল্পে মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য এটিই সঠিক সময় বলে মনে করছে জাতিসংঘ।
কতটা প্রয়োজন এই উদযাপনের?
আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি, যে বাতাসে শ্বাস নিই, তৃষ্ণায় পানি পান করি এবং জলবায়ু, যেটি আমাদের গ্রহকে বাসযোগ্য করে তোলে- এসবই প্রকৃতির নিঃস্বার্থ অবদান। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি বছর সামুদ্রিক গাছপালা আমাদের বায়ুমণ্ডলের অর্ধেকের বেশি অক্সিজেনের যোগান দেয় এবং একটি পরিপক্ব গাছ প্রায় ২২ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বিনিময়ে অক্সিজেন ছেড়ে দিয়ে মানুষের ক্লান্তিহীন উপকার করছে, বাঁচিয়ে দিচ্ছে মানুষের প্রাণ। আমাদের প্রকৃতি আমাদের যে সমস্ত সুবিধা দেয়, বিনিময়ে আমরা তার সিকিভাগ উপকারও স্বীকার করি না, ভালো থাকতে দিই না তার বেড়ে উঠায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে। জাতিসংঘ বলছে, প্রকৃতি আর মানুষের সম্পর্কের এই টানাপোড়েন মেটাতে পরিবেশ দিবস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সে ভাবনা থেকেই সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর পরিবেশ দিবসের জন্য নির্দিষ্ট একটি বিষয়কে ঠিক করা হয়। দেড়শো’রও বেশি দেশে নানান আয়োজন থাকে এই দিনটিতে।
কীভাবে উদযাপন করবেন?
বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতার মধ্যে এবার পরিবেশ দিবস ঘরে থেকেই উদযাপনে জোর দিচ্ছে জাতিসংঘ। সেক্ষেত্রে উদযাপন হতে পারে যেভাবে-
১. গাছ লাগান। বাড়ির বারান্দায়, ছাদে কিংবা আঙিনায় গাছ লাগান। পরিবেশ দিবসে গাছ লাগানোর উপরই বেশি জোর দেওয়া হয়।
২. অর্গানিক অর্থাৎ জৈব খাবার খান। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যে খাবার তৈরি করুন।
৩. এড়িয়ে চলুন গণপরিবহন, ব্যবহার করুন বাইসাইকেল।
৪. সচেতনতা তৈরি হোক আপনার ঘর থেকেই। পরিবারের সদস্যদের পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারগুলোয় সচেতন করুন।
৫. পশুপাখির প্রতি সদয় হোন। পৃথিবীতে প্রত্যেকেরই বাঁচার অধিকার আছে৷ তাদের সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন না।
৬. প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থানে বেড়াতে গিয়ে যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলে, হৈ-হুল্লোড় করে পরিবেশটাকে নোংরা করে আসবেন না।
৭. প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে ভূমিকা রাখুন।
৮. পরিবেশের সমসাময়িক সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে ভাবুন, আপনার কাছে উপযুক্ত কোনো সমাধান থাকলে সেটি পৌঁছে দিন সংশ্লিষ্টদের কাছে।
৯. পরিবেশকে তার মতো থাকতে দিন। বিরক্ত না করলে পরিবেশ তার মতো করেই বেঁচে থাকবে। বর্তমানের করোনা পরিস্থিতি সে শিক্ষাই দিয়ে যাচ্ছে আরও একবার।
জাতিসংঘের পরামর্শ
জাতিসংঘ সাতটি ক্ষেত্রে পরিবেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বলছে, এর মাধ্যমে পরিবেশ দিবস তার সঠিক উদযাপনের উপলক্ষ হতে পারে বলে অভিমত সংস্থাটির।
১. ব্যক্তিগতভাবে আমরা কী কিনছি, কীভাবে ব্যবহার করছি- সেটা আরও একবার ভাবা৷
২. ব্যক্তিগত খাতে পরিবেশগতভাবে টেকসই ব্যবসায়ী মডেল কাজে লাগানোয় জোর দেওয়া।
৩. কৃষিক্ষেত্রে প্রকৃতির ক্ষতি না করে উৎপাদন সমৃদ্ধ করা।
৪. গণখাতে সরবরাহ চেইন ও অর্থায়নে পরিবেশগত দিকটি বিবেচনায় রাখা।
৫. সরকারিভাবে বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাসস্থল নিরাপদ করে তোলায় সচেষ্ট হওয়া।
৬. তরুণদের এক সবুজ ভবিষ্যতের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিজেদের মূল ভূমিকায় রাখা।
৭. সংগ্রাহক হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় প্রকৃতিকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা।
শুধুমাত্র এই দিনটিতেই পরিবেশ সচেতনতায় ভূমিকা রেখে বছরের বাকি দিনগুলোয় পরিবেশকে ভুলে থেকে, দূষণ নামের ভয়াবহতার মাধ্যমে পৃথিবীকে অসুস্থ করে তুলে পরবর্তী প্রজন্মকে হুমকির মুখে ফেলে দেবার আগে আরেকবার ভাবুন। ৫ই জুন সচেতনতা সৃষ্টির দিন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন, পরিবেশকে নতুন চোখে দেখার দিন, পরিবেশ সংরক্ষণের কাজে নিজেকে জড়ানোর দিন। এই দিনের কাজ, এই দিনের শিক্ষা ছড়িয়ে দিন সারা বছর জুড়ে। তবেই পরিবেশ দিবস পাবে তার সার্থকতা।