Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশেষ শিশুদের বাবা-মায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা

ননদের বাচ্চার জন্মদিন আজ, মহুয়ার মনে খুব চেনা অস্বস্তিকর অনুভূতিটা প্রবল হচ্ছে তাই। শিমুল, মহুয়ার ননদ, দাওয়াত করতে এসে হাসিখুশিভাবে কথাবার্তার ফাঁকেই বুঝিয়ে গেছে, মহুয়াকে তার বাচ্চার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে খুব সতর্ক থাকতে হবে। কিছুতেই যেন মহুয়ার অস্বাভাবিক ছেলের কারণে তার মেয়ের জন্মদিনের আয়োজন মাটি না হয়! মহুয়ার এই কয় বছরে এসব বাঁকা কথা সয়ে গেছে, নীরবে মাথা ঝাঁকিয়ে ননদকে বুঝিয়ে দিলো যে, নিজের ছেলেকে সে সামলে রাখবে। শিমুল তবুও মনে সন্দেহ নিয়ে বিদেয় হলো, আর মহুয়া বসে রইলো বুকে পাথরচাপা কান্না পুষে। এই কান্না তো দীর্ঘদিনের জমানো, আরো দীর্ঘদিন একে পুষতে হবে। বাচ্চাটা যে তারই নাড়িছেঁড়া ধন, তা সে যতই অস্বাভাবিক হোক!

মিশুক, মহুয়া-নাদিম দম্পতির একমাত্র সন্তান। বয়স দশ, কিন্তু তা কেবল শরীরেই। মনের বেলায় মিশুক হয়তো জীবন এখনো শুরুই করেনি! না সে কাউকে সহ্য করতে পারে সহজে, না সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে সক্ষম। এই পৃথিবীতে তার যা কিছুটা ভাব আছে, এক মায়ের সাথেই। বাবাকেও দূরের মানুষ ভাবে মিশুক। হবে না-ই বা কেন, নাদিম তো কখনো মিশুকের কাছাকাছি আসার চেষ্টাটুকুই করে দেখেনি। বাচ্চা তার প্রতিবন্ধী, এই নিয়ে সমাজে কম অশান্তি পোহায় না সে। ওসব ঝক্কি সামলে ঘরে এসে বাচ্চাকে আদর-সোহাগ করা তার পোষায় না। ঐ কাজ মহুয়ার একার। মা হবার দায় বড্ড ভারী! মহুয়া না পারে দায় এড়াতে, না পারে ভার সবটা সইতে। কান্নাটুকুও বুঝি তার একারই।

নিজেকে আরেকবার সাহস দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মহুয়া। সন্ধ্যায় শিমুলের বাসায় যাবার জন্য মিশুককে বুঝিয়ে খানিকটা সহজ করতে হবে। আর একান্তই যদি মিশুক না মানতে চায়, সমাজ এবং আত্মীয়তার খাতিরে এই অবুঝ বাচ্চাটাকে ঘরে ফেলে রেখেই তাকে বের হতে হবে নাদিমের সাথে। ননদের ঘরে হাজিরাটুকু না দিলে বদনাম হবে যে। আত্মীয়রা নিন্দা করবে, ননদের ঘরের লোকেরাও চারটা বাজে কথা বলে ফেলবে। তার বাচ্চার এসব ঝামেলার জন্য কি দুনিয়ার সব কাজ থেমে থাকবে? সেটা মানবে নাকি কেউ?

সব শিশুর বেড়ে ওঠাই হোক আনন্দের; Source: 30Seconds

প্রতিবন্ধী নাকি বিশেষ শিশু?

এই সমাজে চলতি ভাষায় বাচ্চাগুলোকে প্রতিবন্ধীই বলা হয়। একটু সুন্দর করে বলতে গেলে বিশেষ শিশু বলা হয়ে থাকে। আপনিও নাহয় তা-ই বললেন, কেননা তাদের কিছু বিশেষ অবস্থাই তো তাদেরকে প্রতিবন্ধকতায় ফেলছে। ওই বিশেষ অবস্থাগুলো না থাকলেই তো বাচ্চাগুলো দিব্যি ঠিকঠাক থাকতো! সৃষ্টিকর্তা কোন বাচ্চাকে কেমন অবস্থায় এই পৃথিবীতে উপহার হিসেবে পাঠান, আগে থেকে তা কে বলতে পারে? তবে কেন বলুন তো, জন্মের আগে যে বাচ্চার অপেক্ষায় কারো ঘুম উবে যেত, জন্মানোর পরই কিংবা বড় হবার সময় সেই বাচ্চার অন্যরকম হবার দোহাইয়ে তাকে ‘প্রতিবন্ধী’ মোড়কে জড়িয়ে নিজেদের থেকে আলাদা করে দেওয়া?

বইপত্রে এই শিশুদের নাম ‘স্পেশাল নিডস চিলড্রেন’ বা ‘চিলড্রেন উইদ স্পেশাল নিডস’। অর্থাৎ তারা সেসব শিশু যাদের কিছু বিশেষ চাহিদা থাকে, বিশেষ দেখভালের প্রয়োজনীয়তা থাকে যা অন্য সাধারণ শিশুদের চেয়ে আলাদা। এরা বিশেষ হতে পারে শারীরিক কিংবা মানসিক, যেকোনো দিক থেকেই।

প্রতিটি শিশুই পবিত্রতম উপহার; Source: momjunction.com

বাবা-মায়েরও হবে বিশেষ জীবন

যারা অনেকদিন ধরে এমন কোনো বাচ্চা লালনপালন করে চলেছেন, তারা তো নিজেরাই জানেন এই যুদ্ধ কতটা কঠিন। যুদ্ধে কখনো আমাদের গল্পের মহুয়ার মতো মা বেচারি একলা থেকে যায়, নাদিমরা বাবা হয়ে গা বাঁচিয়ে চলে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই গল্পটা খুব সাধারণ যে, এমন একটা শিশু নিয়ে মা একাই আজীবন যুদ্ধ করছে। আবার কখনো হয় উল্টোটাও। বাবাও পরম মমতায় বাচ্চাটিকে আগলে রাখে, দৃঢ় ছায়া হয়ে পাশে পথ চলে। যেটাই হোক না কেন, আপনি যদি একজন বিশেষ শিশুর অভিভাবক হয়ে থাকেন এবং এই সত্যিটা আপনার জীবনে নতুন এসে থাকে, তাহলে আপনার কিছু কথা জেনে রাখা উচিৎ যা আপনাকে সামনের দিনগুলো সম্পর্কে ধারণা দেবে। আপনার জন্য অনাগত দিনগুলো কেমন হতে পারে, এখানে কথা হতে যাচ্ছে তা নিয়ে।

বিশেষ বলে যেন ভালোবাসার কমতি না হয়; Spurce: SheKnows

নিজের বিবেচনাবোধে আস্থা রাখুন

পাশের বাসার বাচ্চাটিও আপনার বাচ্চার সমবয়সী। ঐ বাসার ভাবী প্রায় সময়ই আপনার বাচ্চা নিয়ে এটা-সেটা উপদেশ দিচ্ছে। তার বাচ্চাকে সে এভাবে পালছে, আপনিও তা করছেন না কেন! আর প্রতিনিয়ত সেসব উপদেশ আপনাকে যেন পাগল করে তুলছে। আপনি বিরক্ত, ক্লান্ত এবং হতাশ! কেন বলুন তো? যখন আপনি এটুকু বুঝেই গেছেন যে, ঐ ভাবীর বাচ্চা আর আপনার বাচ্চার মাঝে ফারাক আছে, তবে কেন দুটো বাচ্চার লালনপালন একই রকম হতে পারে বলে ভেবে মরছেন? হ্যাঁ, সব বাচ্চাই প্রায় এক রকমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখায়, কিন্তু তা একটা নির্দিষ্ট মাত্রা অবধি ঠিক আছে। আপনার শিশুর সমস্যা আপনি একবার চিহ্নিত করে ফেললে তারপর অন্য বাচ্চাদের সাথে তাকে গুলিয়ে বসবেন না। তাতে সব দিকেই আপনাদের ক্ষতি হতে পারে, বিশেষ করে আপনার বাচ্চাটির। আপনার শিশুর জন্য আপনি নিজের বিবেচনাবোধ খাটান, তার ভালোটা আপনিই সবচেয়ে বেশি বুঝবেন।

সাহায্য চাইতে অস্বস্তি নয়

বাচ্চাকে নিয়ে যদি অন্যদের কোনো সাহায্য দরকার হয়, সেটা চাইতে অস্বস্তি বোধ করতে থাকবেন না। প্রায়ই এমনটা হয় যে আত্মীয় বা বন্ধুরা সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত থাকে, কিন্তু নিজে থেকে এগিয়ে আসে না। আপনিও হয়তো অস্বস্তির কারণে সাহায্য চাইছেন না কারো, অথচ কখনো খুব দরকার পড়তে পারে। কাজেই নিজের প্রয়োজনে আপনি অবশ্যই সাহায্য চাইবেন

শিশু বড় হোক সমাজের সবার সাথেই; Source: Bridge Magazine

ক্লান্তিতে কাবু হবেন না

প্রচণ্ড ক্লান্ত থাকবেন আপনি। বাচ্চা পালন এমনিতেই বেশ কষ্টসাপেক্ষ ব্যাপার, সেখানে আপনার বাচ্চাটি তো অন্য দশটা বাচ্চার চেয়ে আলাদা! অন্য অভিভাবকরা দিনে যদি আট ঘণ্টা বাচ্চার জন্য কাজ করে ব্যয় করে, আপনার ক্ষেত্রে সেটা এমনকি দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে। বাচ্চার দেখভাল করা ছাড়াও তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করাটা আপনার নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাঁড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। আর এসব জিনিস আপনাকে শারীরিক ও মানসিক দু’ভাবেই ক্লান্ত করে রাখবে। রাত-দিন এক করে কাজ করতে করতে মেশিন হয়ে যাবেন না যেন। নিজের খেয়াল রাখুন, নিজের শরীর ও মনকে বিশ্রাম দিন যতটা পারা যায়। জীবনের বাকি দীর্ঘ পথটা বাচ্চার হাত ধরে পাড়ি দিতে গেলে আপনাকে তো ঠিক থাকতে হবে আগে!

ঈর্ষান্বিত হবেন না

কথাটা কেমন যেন, তাই না? কিন্তু একজন বিশেষ শিশুর বাবা-মায়ের জন্য এটা খুবই বাস্তব কথা। অন্যের সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চাকে দেখে আপনার মনের অজান্তেই ঈর্ষা বোধ হতে পারে। হতে পারে আপনার নিজের বোন কিংবা ভাইয়ের বাচ্চাই আপনাকে এই অনুভূতিটা এনে দিলো। কেননা সে ছয় বছর বয়সেই সেসব কাজ করছে, যা আপনার পনেরো বছরের বাচ্চাটা করতে অক্ষম! এমনটা হলে নিজেকে খুব ছোট ভাববেন না, কষ্ট থেকেই এসব অনুভূতি আসতে পারে মানুষের মনে। এসব নিয়ন্ত্রণ করাটা আপনার হাতে থাকলেই চলবে।

আপনার বাচ্চাও আর সবার মতো ভালোবাসা পাক; Source: Pinmyhair

নিজেকে একা ভাববেন না

যতই সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে চান না কেন, দশজনের কথার মাঝে যখন তাদের বাচ্চাদের স্বাভাবিক কাজকর্মের গল্প শুনবেন, একলা অনুভব করবেন আপনি। তাদের বাচ্চারা এত এত পড়া শিখছে, নিজের হাতে খাচ্ছে, জামা পাল্টাচ্ছে, এসব কথার ভেতর আপনি নিজের ভিন্ন রকম গল্প নিয়ে গুটিয়ে যেতে চাইবেন। আর তখনই একলা লাগতে থাকবে আপনার। হতে পারে আপনার নিজেকে খুব নির্বাসিতও লাগবে। সন্তানের জন্য এমন জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে ঠিকই, তবে যুক্তি ভুলে গিয়ে নয়। হয়তো পাশে বসা আর দুজন মানুষ আপনাকে একা করে দিচ্ছে না, আপনিই নিজেকে একা ভাবছেন। অকারণ ভাবনাগুলো কম প্রশ্রয় দেয়াটা শ্রেয়। জীবন তাতে সহজ হবে নিশ্চিতভাবেই।

মন খারাপ কিংবা দুর্ভাবনা ঝেড়ে ফেলুন; Source: worshipgh.com

সংকোচ ঝেড়ে ফেলুন

স্বাভাবিকভাবে বাবা-মায়েরা বাচ্চাকে নিয়ে গল্প করতে বেশ পছন্দ করে। আপনিও হয়তো তা-ই করতেন, যদি আপনার বাচ্চাটা অন্যরকম না হতো! একজন বিশেষ শিশুর বাবা-মা হিসেবে কারো কাছে বাচ্চার গল্প করাটা আপনার মনে সংকোচ তৈরি করতে পারে। চাইলেও আপনি নিজে থেকে কাউকে আপনার বাচ্চা সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন না, এমন ঘটনা প্রায়ই হতে পারে আপনার সাথে।এমন মানুষদের সাথে বেশি সময় কাটাতে পারেন যারা আপনার এই জীবনকে খুশিমনেই মেনে নিয়েছে, যারা নিজেরাই আপনার বাচ্চার গল্প জানতে আগ্রহী। মন থেকে যাবতীয় সংকোচ ঝেড়ে ফেলুন, আপনার বাচ্চা কিংবা আপনি কেউই কোনো অন্যায় করেননি।

ভীতির সাথে বসতি নয়

ভয় জিনিসটা মনের গভীরে গেঁড়ে বসতে পারে আপনার। বাচ্চার জন্য কি যথেষ্ট করতে পারছেন? কিছু বাদ যাচ্ছে না তো? কিংবা ওর ভবিষ্যৎ কী? সমাজে একটু স্বাভাবিকভাবে বাঁচার জায়গা কি ওর হবে কখনো? হাজারটা ভয় বাস করবে আপনার মনে, যার কোনোটাই হয়তো অমূলক নয়। এগুলো সামলেই পথ চলতে হবে আপনার প্রতিনিয়ত। আপনি তো আছেন বাচ্চার সাথে, যুদ্ধ করে যাচ্ছেন ওকে ভালো একটা জীবনের জন্য তৈরি করতে, আপনারা নিশ্চয় একেবারে হেরে যাবেন না।

আপনার শিশুর ভবিষ্যৎ আপনিই নির্মাণ করুন; Source: BabyCenter

কথা এখানেই শেষ নয়। এমন আরো অনেক জিনিস আছে যা নিত্যদিন আপনি দেখবেন, অনুভব করবেন, এমন আরো অনেক সত্যের মুখোমুখি হতে হবে রোজ। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে এই জীবনের সব বিপত্তি ঠিক পেরিয়ে যেতে পারবেন, তার জীবন খানিকটা হলেও সহজ করে দিতে পারবেন, এই বিশ্বাস নিয়েই পথচলা হোক আপনার। মিশুকেরাও সমাজে স্বস্তি আর ভালোবাসার একটা জায়গা পাক, বিরক্তি বা ঘৃণার নয়।

ফিচার ইমেজ- Firefly Community

Related Articles