‘নারী’ শব্দটা মনের মাঝে কীসের ছবি আঁকে? মা, বোন, প্রেমিকা, স্ত্রী, বান্ধবীসহ আরো কত অবয়ব! আলোচনা হচ্ছে নারীকে নিয়ে। তবে চলুন না, আজ লৌকিক রঙ্গমঞ্চে গ্রিনরুমের ভেতর ঘটে যাওয়া তাদের কিছু জীবনকথা শুনি।
মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া সাধারণ মেয়ে লিনা। ভার্সিটিতে যাবার উদ্দেশ্যে খুব সকালে রওনা হয়ে তাকে বেশ খানিকটা সময় বাসস্ট্যান্ডেই কাটিয়ে দিতে হয়। চোখের সামনে পুরুষ যাত্রীরা ধাক্কাধাক্কি করে হলেও বাসে উঠে পড়ে। “ছেলেমানুষ হলে এই কষ্টটাও করা যেত, তবু সময় মতন অফিসে তো পৌঁছতে পারতাম!” লিনার সাধারণ মনে প্রতিদিন এই কথাটা ঠিক এই সময়েই দোল খেলে যায়। মানুষ যায় আসে, লিনা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে হাতের রাইট ডিরেকশন থেকে আসা কোনো পাবলিক বাসের দিকে।
এবার মানুষের সংখ্যা আগের চেয়ে কিছুটা হলেও কম। তবে উঠে পড়া যাক! লিনার সাথের পুরুষ যাত্রীগুলো ওর পরে বাসস্ট্যান্ডে আসলেও বাসে ওঠার সময়ে এ ব্যাপারে তোয়াক্কা করার প্রয়োজন বোধ করে না। বরং বাসে ওঠার সময় একটা পুরুষালী হাত লিনার গায়ে অযাচিতভাবে বুলিয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় সামনে পিছনে তাকিয়ে লিনা বুঝল না, কার কাজ এটা। মনে প্রচণ্ড রাগ নিয়ে উঠে পড়ল বাসে।
এই বাসেরই পেছনদিকে বসে থাকা যাত্রীদের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যাক। বৃষ্টি বাসে চড়ে অফিসে যাচ্ছে। বাস চলতে শুরু করেছে। প্রথম দর্শনে ভদ্রলোক গোছের চল্লিশোর্ধ্ব এক পুরুষ বসে আছে বৃষ্টির ঠিক পাশেই। কিছুক্ষণ পর সে খুবই অস্থিরভাবে নড়াচড়া শুরু করলো। সিটে যথেষ্ট যায়গা থাকা সত্ত্বেও হাত-পা ছড়িয়ে রাজকীয়ভাবে বসে আছে। এবার হাতটা কায়দা করে কিছুক্ষণ পরপরই প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বৃষ্টিকে ছোঁয়ার চেষ্টা তার। এত বছর পাবলিক বাসে যাতায়াতের অভ্যাসে বৃষ্টি খুব ভালো করেই জানে, কোনটা অনিচ্ছাকৃত স্পর্শ আর কোনটা ইচ্ছাকৃত।
গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বৃষ্টি বললো, “কী সমস্যা আপনার, এত জায়গা থাকতে আপনি আমার দিকে সরে আসছেন কেন? ভদ্রভাবে বসেন।” বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে এবার লোকটার লেকচার দেয়া শুরু। যার সারমর্ম হচ্ছে- ইদানীংকার ইয়াং মেয়েগুলো ফোকাস খাওয়ার জন্য এমন করে। সে তার বাবার বয়সী লোক, তারপরেও বৃষ্টি জেনে-বুঝে একটা নাটক করতে চাইছে। এতই যখন সমস্যা তাহলে পাবলিক বাসে না উঠে প্রাইভেট কারে গেলেই পারে ইত্যাদি। বাসের অন্যান্য পুরুষ বা মহিলা যাত্রীদের মুখে তখন কুলুপ পড়েছে।
এবার চলুন বৃষ্টির অফিসে ঘুরে আসা যাক। বৃষ্টির বস শর্মিলি। মেধা আর পরিশ্রমটাকে সাথে করে এগিয়ে চলছে সদর্পে। দারুণ ব্যক্তিত্বের কারণে বস আর সহকর্মীদের মাঝেও তার লোকপ্রিয়তা। তবে এই গুণগ্রাহীদের ভিড়ে তাকে নিয়ে ঈর্ষা করার মতন মানুষও আছে বৈকি! কিছু নারী আর পুরুষ সহকর্মীর কাছে শর্মিলি শুধুই একটা সৌন্দর্যসর্বস্ব নারীদেহ। বসদের চক্ষু জুড়ানোর জন্য যার কায়দামতো ব্যবহারেই শর্মিলি এসে সাফল্যের এতটা ধাপ এ বয়সেই পার করে এসেছে বলে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। শর্মিলির কানেও আসে এই কুৎসিত গুঞ্জন, তবে নিজের কাছে সৎ থাকার আদর্শে চলা আত্মবিশ্বাসী মেয়েটা এসব কথায় কর্ণপাত না করে থাকার চেষ্টা করলেও মনটা তার মাঝে মাঝে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
মনিকা, শর্মিলির মামাতো বোন। ক্লাস সেভেনে পড়ছে। এ বয়সটাতে অন্য স্বাভাবিক ছেলেমেয়ের মতো তারও জীবনযাপনে পরিবর্তনের সূচনা ঘটেছে। যে মেয়েটা ক’দিন আগেও মাঠে খেলতে যেত, বাড়ির বাইরে পা রাখতেও ওর সংকোচ এখন তুঙ্গে। মুখে ব্রনের প্রকোপ বেড়েছে, সেটাও বয়ঃসন্ধিকালের খুব স্বাভাবিক একটা লক্ষণ। তবে পাশের বাসার আন্টি সমাজের অতিরিক্ত মাথাব্যথা ওর সংকোচকে চতুর্গুণ বাড়িয়ে তুলেছে, ফুরসত মিললেই প্রচণ্ড আফসোসের সুরে মনিকার গাল-থুতনি-কপালের দিকে বাঁকা চোখে দেখতে থাকে। মেয়েদের ব্রনের সমস্যা হয়, আবার কিছুদিন পর চলেও যায়। কিন্তু মনিকার মুখের ব্রন কেন যাওয়ার নাম নিচ্ছে না, এ নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তায় বুঝি রাতের ঘুমটাই হারাম হয়ে গেছে!
মনিকাদের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে সালেহা। বস্তিতে তার জীবনযাপন। দিন-রাত এক করে হাড়ভাঙা খাটুনির পর ক্লান্ত দেহ নিয়ে বাড়ি ফেরা সালেহার বিশ্রামের সময় নেই। তিন সন্তানের মা হয়ে থাকা ছাড়াও এক মদ্যপ স্বামীর সাথে সংসার জীবন তার। মাসশেষে কামাই করা কষ্টের অর্থ তথাকথিত স্বামীকে বুঝিয়ে দিতে হয়। নাহলে তার উপর শারীরিক কিংবা মানসিক কোনো ধরনের অত্যাচারেরই অভাব ঘটবে না। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর সমাজের চোখে ব্যবচ্ছেদ হবার ভয়ে অন্য অনেক মেয়ের মতোই সে মৌনব্রত পালন করে থাকে। রাতে ক্লান্ত চোখজোড়ায়ও এত সহজে ঘুম আসে না তার, মাথার বালিশটা ভিজে ওঠে শুধু।
উপরের যে লেখাগুলোতে ফোন কিংবা কম্পিউটার স্ক্রিনের কল্যাণে চোখ বুলাচ্ছেন, তার এক বা একাধিক অভিজ্ঞতার সাথে আপনাদের অবশ্যই পরিচিতি আছে। হয়তো শোনা, হয়তো জীবনে ঘটে যাওয়া বা ঘটমান অভিজ্ঞতা। এমন আরো অসংখ্য ঘটনার সরাসরি কিংবা পরোক্ষ সাক্ষী হতে হতে আমরা হয়তো সমাধানের কথাটাই মাথায় রাখতে পারিনি। হয় রোজকার ঘটনা হিসেবে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি, নয় নিয়তির লিখন বলে মাথা পেতে নিয়েছি। তবে ঘটনাচক্রগুলো তো ভিন্নও হতে পারত!
লিনা অনেকক্ষণ ধরে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে পরবর্তী বাসের অপেক্ষায়। বাসটা যথারীতি এসে থামলো। তবে আজকে বাসে ওঠার অনিচ্ছাকৃত প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়নি তাকে। না সব যাত্রী না, গোটাকতক পুরুষ যাত্রী সবার আগে বাসে ওঠার সুযোগ পেয়েও তাকালো লিনার দিকে। তাদের জন্য আজ নির্বিঘ্নে লিনা বাসে উঠেছে।
বৃষ্টির পাশে বসে থাকা লোকটি উচ্চবাচ্য করছে, তবে ঠিক বাঁ-পাশের সিটে বসা পুরুষ যাত্রীটি জোর গলায় বলতে থাকলো, সে-ও ব্যাপারটার প্রত্যক্ষদর্শী। কিছুক্ষণ পর আরো কয়েকজন বৃষ্টির পক্ষ নিয়ে কথা বলা শুরু করলো। এবার সেই ভদ্রবেশী লোকটা নিশ্চুপ, লোকলজ্জার ভয়ে বাস থেকে নেমে পড়ার অপেক্ষায় সে।
শর্মিলি আর তার স্বামী রুহিন, দুজনেই অফিস থেকে ফিরেছে। তবে আজ রুহিন শুধু নিজের সারাদিনের স্ট্রেসের কথা তোলেনি। শর্মিলির মাথায় হাত রেখে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, “How was your day?” রুহিন হয়তো জানে না, ওর এই এক বাক্যে মুহূর্তে শর্মিলির মনের ভঙ্গুরতায় ছেদ ঘটেছে। শর্মিলি ভাবে, যে কথাগুলোর ভার এতদিন অসহ্য হয়ে উঠছিলো, সে ভার আজ রুহিনকে বলে দূর করবে।
মনিকার স্কুলশিক্ষক আজ ক্লাসে বয়ঃসন্ধির সময়টার খুঁটিনাটি আলোচনা করেছেন। কথা বলেছেন সম্ভাব্য শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন সম্বন্ধে। আশ্বাস দিয়েছেন, তিনি তার ছাত্রীদের যেকোনো প্রয়োজনে সাথে আছেন। মনিকা আজ স্কুল থেকে ফিরছে, তবে কাঁচুমাচু মুখ নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে না, খুব স্বাভাবিকভাবে, প্রাণবন্ত মনিকার মতন।
মনিকার মা আজ সালেহার সাথে কাজের ফাঁকে অনেকটা সময় জুড়ে সুখ-দুঃখের গল্প বলে চলেছেন। এতদিন ধরে এ বাড়িতে কাজ করলেও আজকে সালেহার মনে হচ্ছে, মনিকার মা তার পরিচিত কেউ, তার শুভাকাঙ্ক্ষী। না, আজকেই সালেহা তার দুঃস্বপ্নের রাত্রিগুলোর কথা বলেনি। তবে খুব দ্রুত বলবে, শিক্ষিত মানুষের কাছে যদি এর কোনো সমাধান থেকে থাকে! এই ভেবে বহুদিন পরে ঘুমটা সালেহার ভালো হলো আজ।
সব প্রতিকূলতা সব নেতিবাচকতা দূর করা হয়তো সম্ভব না। তবে পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপটা নিচ্ছি তো? আজ থেকে নতুন করে ভাবতে শিখি, চলুন। চারপাশের নারীদের প্রতি আপনি কি দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন? নিজ পরিবারের নারী সদস্যদের প্রতি অন্যদের কেমন আচরণ আপনি আশা করছেন? নারীবান্ধব সমাজ তৈরিতে আপনার ভূমিকাটা ঠিকমতো পালন করছেন তো?