সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখলেন ওমুক কিংবা তমুকের নিউজ, যাচাই না করেই ঢুকে পড়লেন নিউজের ভিতরে এবং যথারীতি শেয়ার। সারাদিন একূল ওকূল ঘুরে বেড়ালো নিউজটা। হঠাৎ করেই দেখলেন নিউজটা সত্য নয়, এমনকি দেখলেন এই ধরনের ঘটনা কস্মিনকালেও ঘটেনি। হ্যাঁ কথা সত্য, গুজবে সায় দেয়ার ফাঁকে আপনার কানটাও কাটা যেতে সময় বেশি লাগবে না বৈকি।
মূল কথা হচ্ছে যা পড়বেন এবং যা শুনবেন তা পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করবেন না। তথ্যের সত্যতা যাচাই করে তবেই তা বিশ্বাস করা উচিত। কেননা গুজব থেকেই পৃথিবীর ইতিহাসে এক ডজনের বেশি খতরনাক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট বার্থোলোমিউ এবং পিটার হ্যাসাল ‘অ্যা কালারফুল হিস্টোরি অব পপুলার ডেলিউশনস’ বইয়ে গুজব সম্পর্কে বলেন, ”গুজব হলো এমন একটি ব্যাপার যার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই।” বিভিন্ন সময়ের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে সুবিধা নিতেই গুজব ছড়ানো হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহজলভ্য হওয়ার কারণে বর্তমানে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা আরো বেশি বাড়ছে। খবরের পেছনের খবর না জেনে অনেকেই গুজবে কান দিয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এবার পৃথিবীর ইতিহাসে যে গুজবগুলো সত্যিকার অর্থেই বাস্তব জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল সেগুলোর দিকে নজর দেয়া যাক।
ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুই বাচ্চাদের রক্ত দিয়ে গোসল করছেন
রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের সময়ে প্যারিসের রাস্তা থেকে অদ্ভূতভাবে গায়েব হতে লাগলো শিশুরা। এরই মাঝে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে রাজা পঞ্চদশ লুই বাচ্চাদের রক্ত দিয়ে গোসল করছেন। কেননা শিশুর রক্ত দিয়ে গোসল করলে রাজার কুষ্ঠ রোগ সেরে যাবে। এ কথা শুনেই শিশুদের পিতা-মাতারা তেলে বেগুনে জ্বলে রাজপথে ভাংচুরে নেমে পড়েন। কিন্তু পরে সত্যটা যখন জানা গেলো; তখন মেনে নিলো এটা একটা গুজব ছিল। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্যারিসের রাস্তা থেকে বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন; এটা সত্য ছিলো। তবে রাজার রক্ত গোসলের জন্য নয়। নতুন আইন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে রাস্তায় যাতে কোনো ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা না ঘটে, সেজন্যই তারা শাস্তিমূলক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বাচ্চাদের ধরে নেন। কিন্তু শিশুদের রক্ত দিয়ে পঞ্চদশ লুইয়ের গোসলের ব্যাপারটা বানোয়াট ও গুজব ছিলো।
ভূমিকম্পে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে লন্ডন
১৭৬১ সালের গোড়ার দিকে ছোট পরিসরের দুই দুইটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয় লন্ডনে। ভূমিকম্প ছোট পরিসরের হলেও তা মানুষের মধ্যে বেশ ভালোভাবেই ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে অনেকেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এর মাঝে একটি খবর চাউর হয়। ১৭৬১ সালের ৫ এপ্রিল বড় একটি ভূমিকম্পে মাটির নিচে মিশে যাবে লন্ডন। এ খবর শোনার পর লন্ডন শহরের জনগণের বড় একটি অংশ ৫ এপ্রিলের আগেই লন্ডন ছেড়ে অন্য শহরে চলে যান। যারা যেতে পারেনি, তারা খালি মাঠে আশ্রয় নেন। কিন্তু মজার ব্যাপার ছিলো, ৫ এপ্রিল তেমন কিছুই হয় নি। কেননা ভূমিকম্পের বিষয়টি পুরোটাই গুজব ছিলো। গুজবের সত্যতা যাচাই-বাছাই না করেই মানুষ লন্ডন ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
ইহুদিরা খ্রিস্টানদের কুয়ায় বিষ ঢেলে দিচ্ছে
মধ্যযুগে হঠাৎ করে ‘ব্ল্যাক প্লেগ’ ছড়িয়ে পড়েছিল। ঠিক এ সময়েই একটি গুজব ডালপালা মেলতে শুরু করেছিল। গুজবটি ছিলো- এই ব্ল্যাক প্লেগ থেকে বাঁচতেই শয়তানের প্ররোচনায় ইহুদিরা নাকি খ্রিস্টানদের কুয়ায় বিষ ঢেলে দিচ্ছিল। এর আকস্মিক প্রতিক্রিয়ায় কয়েক হাজার ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল। এক ফ্রান্সেই খ্রিস্টানদের কুয়ায় বিষ দেয়ার অভিযোগে ৫ হাজার ইহুদিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। এছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ইহুদিদের ভিটে-মাটি ছাড়া করা হয়েছিল এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ ঘটনার পুরোটাই ছিলো গুজব। গুজব কত ভয়ঙ্কর পরিণতি বয়ে আনতে পারে এ ঘটনাটি তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
জার্মানি-আমেরিকা কানাডা আক্রমণ করবে
ইতিহাসের পাতা উল্টালেই দেখা যায়, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কানাডা প্রাথমিক পর্যায়েই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। হিসাবমতে, কানাডা আমেরিকার ৩ বছর আগেই যুদ্ধে যোগদান করেছিল। এর মাঝে আমেরিকা ও জার্মানি কানাডা আক্রমণ করতে যাচ্ছে বলে একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে। বলা হয়েছিল যে, নায়াগ্রা এবং বাফালো অঞ্চলে যে ৮০ হাজার জার্মান সেনা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল, তারাই কানাডা আক্রমণ করবে। এতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী বেশ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে এরকম কিছুই হয়নি। আমেরিকা-জার্মানি কানাডা আক্রমন করেনি। কারন যুদ্ধ-বিগ্রহের মতো অস্থিতিশীল সময়ে ছড়িয়ে পড়া আরেকটি গুজবের মতো এটি আরেকটি গুজব ছিলো।
নির্মাণকাজ চালাতে মানুষের মাথা বলি দিচ্ছে ইন্দোনেশিয়া সরকার
১৯৩৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার গ্রামে একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে। সরকার যে বিশাল ভবনগুলো নির্মাণ করছে সেগুলো ভাঙনের হাত থেকে বাঁচাতে মানুষের মাথা বলি দিতে হবে। এর বেশ কয়েক দশক পর ১৯৭৯ সালে এসেও বোর্নিও দ্বীপে আবারো এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মানুষ রাস্তাঘাটে বের হওয়া বন্ধ করে দেয়। কারণ কখন আবার ধরে নিয়ে মাথা বলি দিয়ে দেয়। কিন্তু এসব ভিত্তিহীন গুজব ব্যতিত আর কিছুই ছিল না। যদিও সময়ের সাথে এসব গুজব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
চুইংগাম বাড়াবে যৌনশক্তি
নব্বইয়ের দশকে মধ্যপ্রাচ্যে বেশ কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো বিশেষ এক চুইংগাম, যা চিবোলে করলে যৌনশক্তি বাড়ে। অনেকেই নাকি বেশ আগ্রহ নিয়ে কিনেছিল এ চুইংগাম। মিশরের পার্লামেন্টে একজন স্থানীয় সংসদ সদস্য এ চুইংগামকে ‘ইসরাইলের ষড়যন্ত্র’ বলেও অভিহিত করেন। মিশরের তরুণদের বিপথগামী করতেই এ ধরনের চুইংগাম বাজারজাত করা হয় বলে মন্তব্য করেন ওই এমপি। এ চুইংগাম ক্রয়-বিক্রয় থেকে বিরত থাকতে মিশরের মসজিদের মাইকে পর্যন্ত ঘোষণা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এ চুইংগাম বিক্রির দায়ে অনেক দোকান-পাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেককে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু এটা গুজবই ছিল। ওই চুইংগাম ছিলো আর দশটা চুইংগামের মতো সাধারণ চুইংগাম। একবছর পর গাজাতেও স্ট্রবেরি চুইংগাম নিয়ে আরেকটি গুজব চাউর হয়েছিল।
হোয়াইট হাউজে বিস্ফোরণে ওবামা আহত
২০১৩ সালের এপ্রিলে স্বনামধন্য সংবাদ মাধ্যম এপির টুইটার একাউন্ট হ্যাক করে হ্যাকাররা। এরপর হ্যাকাররা একটি টুইট করে। টুইটে তারা উল্লেখ করে- হোয়াইট হাউজে বিস্ফোরণে ওবামা আহত হয়েছেন। এই একটি টুইট পুরো দুনিয়ার ফিন্যান্সিয়াল মার্কেটকে রীতিমতো কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। বেশ কয়েকটি কোম্পানি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে গিয়েছিল। যদিও খুব দ্রুত তারা এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল। কারণ ওবামার আহত হওয়ার খবরটি ছিলো গুজব। ওবামা আহত হননি। বরং এ টুইট দেখে তিনি হাসিতে ফেটে পড়েন। হ্যাকাররাই মূলত ভুয়া টুইট দিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।
জাদুটোনা করে পুরুষাঙ্গ চুরি
আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতে একটি খবর চাউর হয়। খবরটি ছিলো- জাদুটোনা করে পুরুষাঙ্গ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে একদল লোক। এ খবর শুনে কঙ্গোর অনেক মানুষ রাস্তায় নেমে অপরিচিত লোকদের সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পিটুনি দেয়। এতে বেশ কিছু মানুষ গুরুতর আহত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল বলেও জানিয়েছিল সংবাদ মাধ্যম। মূলত আফ্রিকার আরেক দেশ কেনিয়া থেকেই জাদুটোনার মাধ্যমে পুরুষাঙ্গ চুরির এ গুজবটি চাউর হয়। এরপর তা কঙ্গোতে বেশ ভালোভাবে চাউর হওয়ার পর হতাহতের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো ঘটেছিল।
উপর্যুক্ত অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো এড়াতেই কোনো গুরুতর সংবাদ শুনলে তা যাচাই-বাছাইয়ের পরামর্শ দেন সমাজবিজ্ঞানীরা। সভ্যতার সবচেয়ে সেরা সময়ে এসে গুজবে কান দিয়ে গজব সৃষ্টি করাটা অস্বাভাবিক বৈকি!
ফিচার ইমেজ: Shutterstock