বগুড়ায় এক শিশু জন্ম নেয়ার পরেই কথা বলে উঠেছে, দশ মিনিটের মধ্যে মৃত্যুও হয়েছে তার। এর আগে বলে গেছে করোনাভাইরাসের মহৌষধের কথা। কিছুদিন আগেও ইনবক্সে,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিতজনদের টাইমলাইনে, এমনকি অনেক জনপ্রিয় পেজেও ছড়িয়ে পড়ে এই গুজব। একদল এই তথ্য বিশ্বাস করে শেয়ার করতে থাকে, আরেকদল এই তথ্য শেয়ার করা মানুষজনকে নিয়ে হাসাহাসি করার জন্য শেয়ার করতে থাকে।
মানুষজনের অবস্থা আজকাল এমন হয়েছে যে, রাতে ঘুমোতে যায় একধরনের খবর পড়ে, সকালে উঠে দেখে নতুন তত্ত্ব চলে এসেছে। রকমারি এসব গুজবের ভিড়ে কী নেই! ফ্রি নেটফ্লিক্স অ্যাকাউন্টের খবর, কয়েক গিগাবাইট ইন্টারনেট প্যাকেজ উপহারের পোস্ট, মধ্যরাতে হেলিকপ্টার থেকে রাসায়নিক ছিটানোর তথ্য কিংবা গোপন সূত্রে পাওয়া ভয়ানক ফোন রেকর্ডিং। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতি বেলায় ভিন্ন ভিন্ন এসব গুজব ছড়িয়ে পড়ছে আশঙ্কাজনক হারে।
ভয়ঙ্কর এই পরিস্থিতিতে ভাইরাসের পাশাপাশি চারিদিক থেকে ছেঁকে ধরছে গুজব। কখনো ইনবক্সে, কখনো বা কারো পোস্টে। কারো কারো বাসায় মুরব্বিরাও ভাইবার, ইউটিউবে দেখা অদ্ভুত সব চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগের চেষ্টা করছে। ত্রিশ সেকেন্ড নিঃস্বাস আটকে রেখে পরীক্ষা করে দেখছে তাদের কোভিড-১৯ হয়েছে কি না! আপনি আমি একা না, পুরো পৃথিবী যেমন ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তেমনি যুদ্ধ করছে এ ধরনের গুজব এবং মিথ্যা সংবাদের বিরুদ্ধেও।
বিশ্বজুড়ে গুজবের রকমফের
বাংলাদেশি এক চিকিৎসকের ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর কথা মনে আছে? যেখানে তিনি দাবি করেন, ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় করোনা ছড়ায় না। সেই ভিডিওর এই অংশটি ভাইরাল হয় কলকাতায়ও।
ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর উদ্দেশ্যে ভাইরাল করা হয় একটি ভিডিও, যাতে দেখা যায় টুপি এবং পাঞ্জাবি পরা কিছু যুবক প্লেট চেটে খাচ্ছে। বলা হয়, তারা করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। আসলে সেই ভিডিওটি ২০১৮ সালের। এই ভিডিওতে যে যুবকদের দেখা যাচ্ছে, তারা মুসলিমদের দাউদি বোহরা গোষ্ঠীর। সেটি বোহরা মুসলমানদের একটি রীতি।
এমনকি গত কিছুদিন আগে বাংলাদেশে গ্রেফতার হওয়া নকল স্যানিটাইজার তৈরি করা চক্রের ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয় ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে।
ইনবক্সে হালকা গরম পানিতে লেবুর শরবত খাওয়ার মেসেজ পেয়েছেন তো। এই একই মেসেজ ভিন্ন ভাষায় ইতালিতেও ঘুরছে।
ভাইরাস ধরার ভয়ে মানুষ রাস্তায় ফেলে দিয়েছে টাকা এমন একটি এডিটেড ছবি ঘুরছে তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে।
চিন্তা করুন তো, গুজবের শক্তি কতটা ভয়ঙ্কর হলে পাকিস্তানি নিউজ চ্যানেল ‘ডন’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের মৃত্যু সংবাদ প্রচার করে! এদিকে গত মার্চে এরকমই এক গুজব থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্বাস করে ইরানে মিথানল পান করে মারা গেছে একশোরও বেশি মানুষ। কী? অংক মেলাতে বসে পড়লেন? গত কিছুদিন ধরে কিন্তু আমাদের দেশেও মিথানল সংক্রান্ত মিথ্যে তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে।
আপনার-আমার কাছে এসব গুজব হাস্যকর মনে হলেও বিশ্বজুড়ে এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। ইংল্যান্ডে গত একমাসে প্রায় ৫০টি ফাইভ-জি টাওয়ার পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে করোনাভাইরাস ছড়ানোর দায় দিয়ে। ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের তরঙ্গ নাকি মানব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস ল্যাবরেটরিতে তৈরি না ঘোষণা দেয়ার পরও আরেকদল দাবি করছে যে বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিল গেটস করোনা ভাইরাস তৈরি করেছেন ব্যবসায়িক ভাবে লাভবান হওয়ার জন্য।
এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্টও তার সংবাদ সম্মেলনে নানা রকম ভুল তথ্যর ওপর ভিত্তি করে বক্তৃতা দিচ্ছেন হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া এসব গুজব ঠেকাতে ফেসবুক আশ্রয় নিয়েছে মেশিন লার্নিং পদ্ধতির, যার মাধ্যমে বারবার শেয়ার হওয়া ছবি এবং পোস্ট বিশেষ নজরদারির আওতায় চলে আসছে। হোয়াটসঅ্যাপে পরিবর্তন এসেছে মেসেজ ফরোয়ার্ড করার নিয়মে। আগের মতো চাইলেই কোনো মেসেজ একসাথে একাধিক কন্টাক্টের সাথে শেয়ার করা যাচ্ছে না আর।
করোনাভাইরাস বিষয়ক গুজব প্রতিরোধে কিছু সাবধানতা
বেশিরভাগ গুজবেই বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন নানা চিকিৎসার কথা বলা হচ্ছে। এসব পদ্ধতি প্রয়োগ করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। আসুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো কিছু শেয়ার করার আগে খবরের উৎস যাচাই করি। বন্ধু এবং আত্মীয়দের পোস্টে প্রশ্ন করি। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং প্রথম সারির নির্ভরযোগ্য পেজগুলো থেকে তথ্য যাচাই করে শেয়ার করি। চিকিৎসা বিষয়ক যেকোনো তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে যাচাই করে তারপর শেয়ার করি। মনে রাখবেন, আপনার শেয়ার করা দুই লাইনের একটি মিথ্যে পোস্ট কারো অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
করোনাভাইরাস বিষয়ে আরো জানতে বাংলাদেশ সরকার অথবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনলাইন কোর্স করতে পারেন। মনে রাখবেন, এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস থেকে বেঁচে থাকার প্রমাণিত পদ্ধতি হলো বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এগুলো ছাড়াও অনলাইনে যেসব গবেষণা, চিকিৎসা পদ্ধতির কথা পড়ছেন সেসবই ভবিষ্যত সম্ভাবনার খবর, প্রমাণিত কোনো পদ্ধতি নয়। তাই ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন; দুই লাইনের কোনো কিছু শেয়ারে আগে সেটার যথার্থতা নিয়ে দু-চার মিনিট বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে নিন, দু-চার মিনিট অনলাইনে পড়াশোনাও করে নিন। আপনার এমন সচেতনতাই হয়ে উঠবে করোনাভাইরাসের দিনগুলোতে প্রতিরোধের অন্যতম শক্তিশালী ও যুক্তিযুক্ত হাতিয়ার।