Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জানতে চান আপনি কতটুকু সৃজনশীল?

ছেলেটি পড়াশোনায় নিতান্তই সাধারণ। খেলাধুলোতেও যে তার অসাধারণ কোনো নৈপুণ্য দেখতে পাওয়া যায়, তা-ও নয়। মেধাবী বলতে যা বোঝায় এই ছেলেটির বেলায় তা কখনো বলা যাবে না। ছোটবেলায় তাই বাবা-মা চেয়েছিলেন ছেলে বড় হয়ে আর পাঁচজনের মতোই বাঁধাধরা কোনো মাইনের চাকরি করবে। ছাপোষা সংসারে এর থেকে বেশি স্বপ্ন দেখার জায়গাই বা কোথায়? কিন্তু ছেলেটির মনোজগত তো সেই কথা বলে না। এভাবে ভাবেনিও সে কোনোদিন। সে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে ভালবাসে। ধীরে ধীরে প্রকৃতির নানা রং জায়গা করে নিতে থাকে তার ক্যানভাসে। রংতুলি নিয়ে গড়ে ওঠে তার একান্তই নিজস্ব এক সৃষ্টির জগৎ।

একজন সৃজনশীল ব্যক্তি পড়ালেখার গন্ডির বাইরে নিজেকে সৃষ্টিশীল কোন মাধ্যমে ব্যপ্ত করত পছন্দ করেন; Source: Pinterest Josh

আমাদের চারপাশে প্রায় সময় এধরনের কারো সাথে দেখা আপনি পেতেই পারেন। চেনা জগৎ, জানাশোনা এবং চিন্তা-ভাবনার বাইরে এরা চায় অন্যভাবে ভাবতে। কেউ ছবি আঁকে, কেউ গান গায়, কেউ মনের আনন্দে কবিতা-গল্প লেখে, কেউ আবার অঙ্ক কষতে ভালবোসে। আর তাদের এই সৃষ্টিশীল চিন্তা-ভাবনার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে একেকটা ‘মাস্টারপিস’। এসব সৃজনশীল লোকেরাই সমাজকে এগিয়ে নেয়, পৃথিবীতে নির্মাণ করে সৃষ্টিশীলতার এক নতুন জগৎ। আর তাই সৃজনশীলতার আরেক নাম সৃষ্টিশীলতা।

সৃজনশীলতার পিছনে জিনগত প্রভাবই কি দায়ী?

অনেকেই বলে থাকেন, সৃষ্টিশীলতা জিনগত। অনেকাংশে তা সঠিকও বটে। এই সৃজনশীলতার পেছনে এক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। আমাদের সকলের মধ্যেই কম-বেশি সুপ্ত সৃষ্টিশীলতা রয়েছে। কারো মাঝে তা প্রকাশিত হয়। কারো মধ্যে তা সুপ্তই থেকে যায়। কেউ তা প্রকাশ করতে পারেন, কেউ পারেন না। এই সৃজশীলতা বিকাশের জায়গাটিতে কিন্তু ব্যক্তির চারপাশের পরিবেশ ও সমাজের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। অনেকের চিন্তা-ভাবনার খোরাক জোগায় এই পরিবেশই।

সৃজনশীলতা কি কোনো মানসিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ?

গবেষকদের মতে, সৃজনশীলতা হচ্ছে একধরনের মানসিক অবস্থা, ‘অ্যা স্টেট অফ মাইন্ড।’ একজন সৃজনশীল ব্যক্তির মাথার মধ্যে নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা প্রতিনিয়ত ঘুরতে থাকে। তখন তাদের মনের মধ্যে প্রচন্ড অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। সৃজনশীল এসব মানুষেরা অনেকেই তাই খুব মুডি হন, এমনকি  বেশ খানিকটা ভাবুক প্রকৃতিরও হন। এসব সৃষ্টিশীল মানুষদের কারো কারো সকালবেলায় মাথার মধ্যে চিন্তার ঢেউ খেলে যায়, তো কেউ আবার রাতে শান্ত পরিবেশে নতুন পরিকল্পনা করতে ভালবাসেন।

তবে সবার মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্যগুলো সবসময় দেখা দেবে তা না-ও হতে পারে। সৃজনশীলতা নিয়ে এত কৌতুহলের ফলেই আজকাল গবেষণা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। সৃজনশীলতার মাপকাঠি নির্ণয়ের জন্য তাই সাহায্য নেওয়া হচ্ছে নানা ব্রেন অ্যাসেসমেন্ট টুলের, যেমন- ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং, ইলেক্ট্রো এনসেফ্যালোগ্রাফি ইত্যাদির। অনেক গবেষণাই এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ, তবে সৃজনশীলতার ব্যাখ্যা নিয়ে কৌতুহলের কোনো নিরসন নেই।

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি; Source: biography.com

সৃষ্টিশীল ব্যক্তিরা যেসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হন 

  • একেকজন মানুষের সৃষ্টিশীলতার কেন্দ্র একেকরকম। কেউ যদি সঙ্গীতের ব্যাপারে অসম্ভব সৃষ্টিশীল হন, তিনি ছবি না-ও আঁকতে পারেন।
  • সৃজনশীল মানুষ জীবনের ছোটখাট বিষয় থেকে অনুপ্রাণিত হন, অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হন। ‘ওপেননেস টু এক্সপেরিয়েন্স’ তাদের চারিত্রিক বিশিষ্ট্য।
  • তাদের মধ্যে পরিশ্রম করার ইচ্ছেও তীব্র থাকে। আলস্য এদের স্বভাবে নেই। কোনো নতুন সৃষ্টি আদৌ সফল হবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়। তাই অনিশ্চয়তার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াও তাদের অভ্যাস হয়ে যায়।
  • সৃজনশীলতা ‘ফ্রি ফ্লো অফ আইডিয়াজ’ এর ফলশ্রুতি। তাই একেকজন সৃজনশীল ব্যক্তির কাছে এর প্রতিফলন বা উপস্থাপন একেকরকম।
  • সৃজনশীল ব্যক্তির কল্পনাশক্তি অত্যন্ত প্রবল বলে অনেক বিশেষজ্ঞেরই মতামত। একজন চিত্রশিল্পী নতুন চিন্তা-ভাবনার ভিজুয়্যাল রিপ্রেজেন্টেশন যেমন পছন্দ করবেন, তেমনই একজন সঙ্গীতজ্ঞ অডিটোরাল রিপ্রেজেন্টেশন চাইবেন।
  • সৃজনশীল ব্যক্তিকে ‘সিচুয়েশন স্পেসিফিক’ বলা যেতে পারে। সৃজনশীলতার জন্য বুদ্ধি আর দক্ষতার প্রয়োজন। নতুন কোনো কিছু সৃষ্টি করতে গেলে তাতে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ প্রভাব ফেলে।

সৃষ্টিশীলতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

স্নায়ুবিজ্ঞানের মতে, মস্তিষ্কের বাম দিক মানুষকে বেশি ‘অ্যানালিটিক্যাল’ হতে সাহায্য করে। আর সৃজনশীলতা বা ক্রিয়েটিভিটির জন্য দায়ী ডান দিক। এমনও বলা হয়ে থাকে যে, আমাদের অবচেতন সত্ত্বা মস্তিষ্কের ডান দিকে থাকে। এটিই নতুন নতুন চিন্তাশক্তি বা নানা ধারণা  উদ্ভাবনে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মস্তিষ্কের সেরিবেলামের কিছু অংশ সৃজনশীলতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

Source: SteadyHealth.com

আমাদের মস্তিষ্কে দুটি ভাগ বা হেমিস্ফিয়ার থাকে। তার মাঝে থাকে সংযোগকারী করপাস ক্যালোসাম। গবেষণায় এটাও দেখা গিয়েছে যে, লেখক, শিল্পী বা সঙ্গীতজ্ঞদের ক্ষেত্রে এই করপাস ক্যালোসাম তুলনায় ছোট আকারের হয়।

সৃজনশীল কাজ করতে গেলে মস্তিষ্কের মিডিয়াল প্রিফন্টাল কটেক্স বা ইনফিরিয়র ফ্রন্টাল জিরাস এর মধ্যে মধ্যস্থকারী অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনার পেছনেও কিন্তু বাম দিকে ইনফিরিয়র ফ্রন্টাল জিরাস দায়ী।

গান-বাজনায় বাঁধাধরা শিল্প সৃষ্টির বাইরে বেরিয়ে কোনো ‘ইম্প্রোভাইজেশন’ চোখে পড়লে বুঝতে হবে মস্তিষ্কের মিডিয়াল প্রিফন্টাল কটেক্স হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জটিল সমস্যার সমাধানেও তো মগজাস্ত্রের প্রয়োগ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এখানে কিন্তু মস্তিষ্কের ডান দিকের হেমিস্ফিয়ারের ভূমিকা বেশি। সৃষ্টিশীলতার উপর জিনগত প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না।

হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, একটি বিশেষ জিনের প্রভাবে কিছু কিছু মানুষ গান-বাজনায় পারদর্শী হন। তারা অন্য ক্ষেত্রে পারদর্শী না-ও হতে পারেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে ইমোশনাল ট্রমা বা সাইকোলজিক্যাল ক্রাইসিস মানুষকে সৃষ্টিশীল করে তোলে। জিনের প্রভাবে মস্তিষ্ক উদ্ভাবনী চিন্তা-ভাবনা করতে প্রবৃত্ত হয়।

যাদের ক্ষেত্রে এই জিনগত প্রভাব নেই, তাদের সৃষ্টিশীলতা কিন্তু আয়ত্ত করতে হয়। তবে জিনগত প্রভাব থাকলেও, কারোর বাবা-মা যদি সৃজনশীল হন, তাহলে সন্তান কিন্তু সবসময় সেই গুণের অধিকারী না-ও হতে পারে। শুধু জিন বা আশেপাশের পরিবেশই যে অন্যভাবে ভাবতে শেখায় তা নয়। কোনো দুর্ঘটনার ফলেও আকস্মিক সৃষ্টিশীলতা জন্ম নিতে পারে। কলোরাডোর ডেরেক আমাতো বিশ্বের সেই বিরল প্রতিভাদের মধ্যে একজন যিনি মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়ার পর মিউজিক্যাল জিনিয়াস হয়ে ওঠেন। তিনি কখনো পিয়ানো বাজাতে শেখেননি। অথচ সেই মানুষটিই পেশাদার পিয়ানোবাদক হয়ে উঠলেন।

Source: Reader’s Digest

সৃজনশীলতার সঙ্গে নিউরোটিসিজমের যোগসূত্র

অনেক বিশেষজ্ঞই সৃজনশীলতার সঙ্গে নিউরোটিসিজমের যোগসূত্রের কথা বলে থাকেন। নিউরোটিসিজমের প্রধান বৈশিষ্ট্য উদ্বেগ, রাগ, অবসাদগ্রস্থতা, মুড সুইং ইত্যাদি। নিউরোটিসিজম রোগ নয়, কিন্তু প্রায় সময়ে এ বৈশিষ্ট্যগুলো মানসিক অবস্থা থেকে সৃষ্ট বলে গবেষকদের অভিমত। অনেক বিখ্যাত সৃষ্টিশীল ব্যক্তির মধ্যে এই নিউরোটিসিজমের প্রভাবের মাত্রা বেশি ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, স্যার আইজ্যাক নিউটন ও ডারউইন। নিউটন নাকি তার আবিষ্কারের পূর্বে এতটা অস্থির থাকতেন যে মাঝে মাঝে তার মেন্টাল ব্রেকডাউন সিনড্রোম দেখা দিতো।

Source: Famous Biographies

ডারউইন যখন প্রবল মানসিক চাপে ভুগতেন তখন প্রায়ই তিনি বমি বমি ভাব এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যায় ভুগতেন যা মাঝে মাঝে প্যানিকের মতো দেখা দিতো। অনেক গবেষকের মতে, অতিরিক্ত চিন্তাশক্তি প্রয়োগের ফলে এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

Source: cineavatar.it

আর সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই ধরনের নিউরোটিসিজমের প্রভাব অস্বীকার করার জো নেই। আবার আরেকদল বিশেষজ্ঞের মতে, অনেক সৃজনশীলতা মানুষ তাদের সৃষ্টিশীলতা বাড়ানোর জন্য নিষিদ্ধ ড্রাগ নেন। তাদের মুড সুইং নাকি সেই ড্রাগেরই ফল। এছাড়া সাইকোটিসিজম তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ফলে সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের নিজেদের সত্ত্বার সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকে।

সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; Source: The Indian Express

সৃজনশীলতা আসলে একটি প্রবণতা। এই সৃজনশীলতার যারা বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেন, তাদের মধ্যে কিছু করার ইচ্ছে সর্বদাই প্রবল থাকে। সৃজনশীল মানুষেরা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম হন। তবে তারা সবাই যে খুব মুডি বা বদমেজাজি তা কিন্তু নয়। যেমন, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। তিনি একেবারেই ধরাবাধা  জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন না। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বেশ সংযত। অনেক সৃষ্টিশীল মানুষের কিন্তু আবার দৈনন্দিন জীবনে চিন্তা-ভাবনার কোনো অভিনবত্ব চোখে পড়ে না। অথচ সৃষ্টিশীলতার সময় তারা সবসময় ব্যতিক্রমী!

ফিচার ইমেজ: informe2.com

Related Articles